তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

রাগ রাগিনীর উদ্ভব এবং সংগীত শাস্ত্র সমন্ধে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য এবং সমালোচনা প্রণিধান যোগ্য। রবীন্দ্রনাথের কথায় পরে আসছি। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে বহু রাগ ও রাগিনীর উল্লেখ আছে। কিন্তু তুর্কি আক্রমণের ফলে সেই সব ইতিহাস মানে সব ব্যবহৃত রাগ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অনেকেই বলেন ইসলামের আবির্ভাবের ফলে।

এটা ইতিহাস সমর্থিত নয়। চর্যাপদ থেকে আমাদের বাংলা গানের ও রাগের  উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পাল শাসন কালেও রাগের পরিচয় পাই। কিন্তু কি বা কোন ভাব প্রকাশের জন্য কোন রাগ তৈরি হয়েছে তাঁর ইতিহাস খোঁজা খুব জরুরি। কিন্তু আমাদের সংগীত হলো গুরুমুখী বিদ্যা। ইতিহাস ওরাল। আর এইখানেই সমস্যা। তবে পারসিক ও আরবিক সভ্যতার মিশ্রনের ফলে এই রাগ রাগিনী বিবর্তিত হয়ে সমৃদ্ধ হয়। তবে প্রাচীন গৌড়ীয় (যেটা বাংলার আদি) রাগ সমূহের পুনরুদ্ধার না হলে আমাদের সংস্কৃতির একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অধরাই থেকে যাবে। এইবার দেখা যাক রবীন্দ্রনাথ কি বলছেন এই সব  ব্যাপারে।

হিন্দুস্থানী সংগীত এমন একটি কলাবিদ্যা যার রচনার নিয়ম বহুকাল আগেই সমাপ্ত হয়ে গেছে। (সংগীত-চিন্তা)। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, উত্তর ভারতীয় বা হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীত অতি প্রাচীনকালে অর্থাৎ ভরতের নাট্টশাস্ত্র,‍ বৃহদ্দ্দেশী, সংগীত-রত্নাকর, সংগীত-সময়সার, সংগীত-চূড়ামণি ইত্যাদি প্রাচীন ঐতিহ্যবা‌হী গ্রন্থের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

‘কোন কোন রাগ –রাগিনীতে কি কি সুর লাগে তা তো মান্ধাতার আমলেই স্থির হয়ে গেছে। (সংগীত-চিন্তা) কিন্তু মধ্যযুগে বৈদেশিক আক্রমণের ফলে ইন্দো-ইসলামিক সংস্কৃতির অভ্যুদয়ের কারনে দেশীয় এই ঐতিহ্যবাহী সংগীতশাস্ত্র বা বিজ্ঞানের যেমন অবলুপ্তি ঘটে, তেমনি বৈদেশিক সংস্কৃতির মিশ্রণে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন সংগীত বিধি। ফলে বারে বারে হিন্দুস্থানী বা উত্তর ভারতীয় সংগীতের ঘন ঘন রূপ পরিবর্তিত হয়। ফলে ‘বহু মতেষু প্রসিদ্ধানি” হয়ে যায়। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বিশেষ করে এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় ধর্ম, সাহিত্য, সংগীত এবং সামাজিক ক্ষেত্রে।

সংগীতের যে মৌলিক উপাদান স্বর, সুর, ভাষা ইত্যাদির সব কিছুর লক্ষনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। নিদারুন অবহেলার কারনে প্রাচীন সংগীত শাস্ত্রগুলি ক্রমে লুপ্ত হতে শুরু করে। এর অন্যতম কারণ, ঐতিহ্যবাহী মন্দিরাশ্রিত প্রবন্ধ সংগীতের রূপগুলি ক্রমশ দুর্লভ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংগীতশাস্ত্রের সঠিক ব্যাখ্যাকারগণ যাঁরা ছিলেন, বাদশাহ নবাবের ঔদাসিন্যে তাঁদের সম্প্রদায়েরও প্রায় অবলুপ্তি ঘটে।

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত যুব সমাজের কয়েকজন সংগীত পিপাসু সংগীতকে একটি উচ্চাঙ্গ বিদ্যারূপে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেন। তাঁদের মধ্যে মহারাষ্ট্রের পন্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে অন্যতম। বিশেষত উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে নিজ নিজ ভাবনা ও কল্পনানুসারে সিদ্ধান্তিক রূপ দেওয়ার কাজে তিনি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। কারণ ব্যবসায়িক দরবারী হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত মৌখিক পরম্পরায় বিশ্বাসী। অতঃপর এই শ্রেণীর অল্পশিক্ষিত -গায়ক-বাদকদের কাছে সংগীতশাস্ত্র জ্ঞান প্রত্যাশা করা যায় না।        

প্রাচীন আচার্যদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রমাণ, বরং বলা যায় প্রাচীন সংগীত শাস্ত্রের পরম্পরা প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রমানও পন্ডিত ভাতখন্ডের চিন্তাভাবনায় নিঃসৃত হয়। তাঁর গ্রন্থে উল্লেখিত যে তত্ত্ব তাঁর স্বরচিত ‘লক্ষ্যসংগীত’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর নিজের অনুধাবন করা প্রচলিত ব্যবসায়িক দরবারী সংগীতের এক নতুন তত্ত্ব তিনি সৃষ্টি করেন। সেইটিই লক্ষ্যসংগীত নামে  হিন্দুস্থানী বা উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। উনবিংশ শতকের গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং পূর্ববর্তী শাস্ত্রকারদের সংগীতসিদ্ধান্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কতটা যুক্তিযুক্ত সেই আলোচনার অবকাশ রয়েছে। তাঁর হিন্দুস্থানী সংগীতের সিদ্ধান্তগুলি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সংগীতশাস্ত্রকে বহন করে চলেছে কি না তার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করা যায়।

হিন্দুস্থানী সংগীত আলোচনার প্রসঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে যে যে দিকগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন বলে মনে করা যায়, তার মধ্যে প্রথমেই ‘হিন্দুস্থান’ বলতে কোন ভূখন্ডকে বোঝানো হয়েছে বা কেন উত্তর ভারতীয় সংগীতকে হিন্দুস্থানী সংগীত হিসাবে আখ্যায়িত কেন করা হয়, তার এক সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করা যায়। কিন্তু ‘হিন্দুস্থানী সংগীত’ কেন বলা হয়েছে পন্ডিত ভাতখন্ডে কিন্তু তাঁর নতুন সংগীতপদ্ধতির উদ্ভাবন এইরূপ বিশ্লেষণ কোথাও করেননি । যাইহোক, ‘হিন্দুস্থান’ কিংবা ‘হিন্দু’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে, তার উল্লেখ কোথাও নেই বললেই চলে। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য এই যে, আমাদের ভাষা তত্ত্বের নিয়মে স=হ, আমরা যাকে ‘আসাম’ বলি, আবার আসামের লোকেরা ‘অহম’ বলে থাকে, আবার আমরা ‘সিন্ধু’ বলি, তাকে পারস্য, আফগানিস্থানের প্রাচীন ব্যক্তিরা ‘হিন্দু’ বলতেন ।প্রকৃতপক্ষে ‘হিন্দু’ নামে একটি জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে বলে এই স্থানকে ‘হিন্দুস্থান’ বলা হয়। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Indian song history)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours