সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

এবার না সত্যি বিরক্ত লাগছে। একটু আগে একটা জরুরি ছবির ফটো ফিনিশের কাজ করছিলাম। হঠাৎ মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে নোটিফিকেশন ভেসে উঠল, "হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলেন নুসরত জাহান।" খবরের সৌজন্যে কলকাতার একটি প্রথম শ্রেণির সংবাদ মাধ্যম। যারা আবার কোনও সীমানা মানে না, অন্তত তাদের এমনই দাবি। তবে তীব্র চাটুকতায় যে তারা অধুনা অভ্যস্থ তা জনগণের সমালোচনায় স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় অহরহ। ব্রেকিং নিউজের বেলায় তো অষ্টরম্ভা। সেই কত যুগ আগে বাংলার সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল বঙ্গের শেষতম প্রকৃত ব্রেকিং নিউজ 'ট্রাম কেলেঙ্কারি' ও 'বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি'। তার পরবর্তী 'আমলাশোল' কাহিনী। ব্যাস বাঙালি সাংবাদিকতার লম্ফঝম্ফ করার দিন আপাতত শেষ। তাই আপোষের মসনদে বসে তারা আজ আমাদের ব্রেকিং নিউজ পরিবেশন করে, হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলেন নুসরত জাহান। সত্যি ডিসগাস্টিং।

ভেবেছিলাম, এসব নিয়ে কিছু লিখবো না। কিন্তু একাধিক তথাকথিত সংবাদ মাধ্যমের অতি প্রয়োজনহীন বাচালতা আমাকে সেই কলম ধরতে বাধ্য করালো। কাউকে ব্যক্তি আক্রমন করা যেমন আমার উদ্দেশ্য নয়, তেমনি আমার লেখায় কেউ আঘাত পেলে আমি আগাম দুঃখ প্রকাশ করছি তারজন্য। আবার নব্য জেন্ডার বিভাজনকারী সমর্থকদের বলবো, অনুরোধ করে আমার লেখাটির বাকি অংশটি আর না পড়লে আমি খুশি হবো। আরও একটি বিশেষতম আবেদন, লেখার মধ্যে ধর্মের ও রাজনীতির কোনও রসায়ন অনুগ্রহ করে খুঁজতে যাবেন না।

গত ২৬ অগস্ট। কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন বাংলার অভিনেত্রী তথা সাংসদ নুসরত জাহান। এযাবৎ সবটাই ঠিক। একজন সাংবাদিক হিসেবে এই নতুন মাকে সেলাম জানাই। অবশ্যই সাধুবাদ জানাই এই কারণেও যে, তিনি নানা বিতর্কের মধ্যে ভ্রুণহত্যার রাস্তায় পা বাড়াননি বলে। তাঁর নব মাতৃত্বের কারণে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেছেন। এই পর্যন্ত সবই তো সুন্দর।

কিন্তু তাই বলে, এই জন্মপর্ব ইস্যুটাকে নিয়ে বাংলার বহুল সংবাদমাধ্যমের এমন নির্লজ্জ হ্যাংলামি প্রচার দিনরাত এক করে চলবে তা ভাবিনি। অন্যদিকে, সোস্যাল মাধ্যমের কিছু লেখালেখি পড়ে এটাই মনে হলো, নুসরত বোধ হয় এই প্রসবান্তে চলতি শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম মহান মায়ের তকমা পেয়েছেন। আমি ফের বলি, নুসরতের নতুন মাতৃত্ব নিয়ে আমি একটিও নেতিবাচক মন্তব্যে রাজি নন। বরং কামনা করি নুসরত ও তাঁর নবজাতক সুন্দর ও সুস্থ থাকুক। পাশাপাশি একাংশ হুজুগে বাঙালির আদেখলাপনা শ্রেষ্ঠ মাতৃত্বকরণ দাবিরও আমি ঘোর বিরোধী। 

একটা বিতর্ক সম্প্রতি বাজার মাত করেছে। নুসরতের নব্য সন্তানের পিতা কে তা নিয়ে। এই বিতর্কের সৃষ্টি অবশ্যই করেছেন নুসরত নিজেই। কারণ তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, নিখিল জৈনকে বিয়ে করেননি। উভয়ে সহবাস করেছিলেন মাত্র। আবার সাম্প্রতিক কালে বিশেষ বন্ধু যশ দাসগুপ্তের সঙ্গে অভিনেত্রীর অন্তরঙ্গতা তো ফিসফিস গসিপের শিরোনামে। অতএব নুসরাতের নিঃসন্দেহে জানার কথা তাঁর পুত্র সন্তানের জৈবিক পিতা কে? এছাড়া প্রয়োজনে ডিএনএ পরীক্ষা তো নির্ণায়ক উত্তর সহজেই দিতে পারে । তবে এই পিতৃত্বের নাম পরিচয় প্রকাশ করা বা না করাটা সম্পূর্ণ অভিনেত্রীর নিজস্ব ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে কারও খবরদারি বর্তমান সুসভ্য সমাজ মান্যতা দেয় না।

আবার প্রকৃতিগতভাবে গর্ভধারণ করলে স্বাভাবিক নিয়মে পশু পাখি জলজ প্রাণি থেকে মানবী সবাই প্রসব করবেই, এটাই তো জাগতিক নিয়ম। ঠিক এই পরিস্থিতিতে বিশেষতঃ এই ইস্যুতে এমনতর মহান পর্বের সিংহাসনে আসীন কেন তিনি আচমকা হয়ে গেলেন, এটা আমার মাথায় ঢুকলো না। ভাগ্যিস আগ বাড়িয়ে কোন মিডিয়া স্কুপ খবর করার জন্য তখনকার দিনের নেহরু বংশীয় যুগের নার্গিসের মায়ের সাহসিকতার সঙ্গে হালফিল এই মাতৃতের তুলনা করে বসেনি, এটাই আমাদের রক্ষে।

মনে রাখতে হবে, নুসরত কিন্তু কোনও ভাবেই কোনও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির চাপে তাঁর সন্তানের পিতৃত্বের পরিচয় গোপন রাখতে সত্যি বাধ্য হয়েছেন কিনা তা কিন্তু কেউ জানি না। এমনকি এমনতর অভিযোগ নুসরত নিজেও এখনও পর্যন্ত করেননি। বরং তিনি যেচে বিষয়টি গোপন রেখেছেন বলে তাঁরই একদল নেটিজেন সমাজে জোরদার লোকের কান ভাঙাতে শুরু করেছেন। এটাও সত্য, এযাবৎ নুসরাতকে কেন্দ্র করে যাঁদের নাম দিবারাত্রির ঘুরপাক খেয়েছে তাঁদের মধ্যে কেউই যেচে নবজাতকের পিতৃত্বের দায় অস্বীকার করে প্রকাশ্যে বিবৃতিও দেননি। সেক্ষেত্রে, কেউ যদি নিজের ব্যক্তি অধিকার বলে পিতৃ পরিচয়ের বিষয়টি গোপন রেখে সন্তানের জন্ম দেন, তাহলে তা নিয়ে এতো মাতোয়ারা প্রচার হইচই কিসের তাগিদে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ বাংলার নানা শহরে নানা গ্রামে এহেন পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানের জন্মগ্রহণ সাম্প্রতিক যুগে তো আকছার লেগেই রয়েছে। কই তখন তো এই মিডিয়া কুলের নব্য মাতৃত্বের ট্যাগ লাইনের হুল্লোড়বাজি বা সোস্যাল মিডিয়ায় মহৎ মায়ের দৃষ্টান্তের কাহিনী নজরে পড়ে না।

বহু কাল আগের কথা। সময়টা আশির দশক। ভারতে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই দলে ছিলেন ব্যাটের দানব ভিভিয়ান রিচার্ডস। সেই সফরকালে অভিনেত্রী নীনা গুপ্তের সঙ্গে ভিভিয়ান রিচার্ডসকে দেখা গেছে যত্রতত্র। এর কিছুদিনের মধ্যেই নীনা গুপ্ত গর্ভবতী হোন। তিনি কিন্তু কোনও ভনিতার আশ্রয় না নিয়ে বা কোনও ন্যাকামি না করে সরাসরি সেদিন জানিয়ে দেন, তাঁর গর্ভে থাকা সন্তানের পিতার নাম স্বয়ং ভিভিয়ান রিচার্ডস। কিন্তু দুঃখের এটাই, সেই সময় ভিভিয়ান রিচার্ডস নীনা গুপ্তর পাশে তো দাঁড়ানইনি, উল্টে স্বদেশে ফিরে গিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। বরং নীনা গুপ্ত সেদিন সমস্ত সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে পুরুষের ভোগের লালসার বিরুদ্ধে চপেটাঘাত করে জন্ম দিয়েছিলেন এক কন্যা সন্তানের। নুসরতের সঙ্গে কিন্তু কোনও কেটে পড়া পুরুষের যৌন লালসার মতো তো তেমন কোনও নালিশ বা প্রতারণা ঘটেনি যার ফলে তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন। তাই নীনা গুপ্তর সেদিনের দৃষ্টান্তের সঙ্গে এদিনের নুসরত কখনই একাসনে বসে মহান মাতৃত্বের সীতাভোগ খাবার অধিকারী হতে পারেন না।

কিন্তু অধুনা বাংলার মিডিয়ার একাংশের প্রচার সর্বস্বতা দেখে মনে হয়, পিতৃ পরিচয় হীন প্রসব অলিম্পিকে এই পরিবেশন ইস্যুটা যেন স্বর্ণপদক লাভ করেছে। যেন বাংলায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নয়া-মাতৃত্বের ইভেন্ট ঘটে গেল গত কয়েকদিনে। আমি কারও মাতৃত্বকে ছোট করে দেখতে নারাজ। প্রতিটি নতুন মাকে আমি নতমস্তকে প্রণাম করি। কিন্তু তাই বলে মিডিয়ার এহেন 'কাগুজে বাগ' মার্কা পদলেহন স্কুপ খবর পরিবেশন বড্ড অস্বস্তিরও। মনে রাখা আবশ্যক মিডিয়ারও একটা সীমানা আছে, নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব মেনে সেটা লঙ্ঘন না করাই শ্রেয়।

(www.theoffnews.com - Nusrat Jahan Bengal media social media new baby)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours