তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

অতএব পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে আমরা অনুধাবন করিতে পারি যে, ভারতীয় সংগীতের রস ও ভাবের প্রসঙ্গ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। তাদের নির্লিপ্ত করে রাখা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আবার পন্ডিত ভাতখন্ডে প্রবর্তিত ‘হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতি’ আলোচনায় ফিরে আসি। প্রথমতঃ শ্রুতি যে দুই প্রকার এবং তার ব্যবহারও যে পৃথক এটিও ভাতখন্ডেজী সঠিকভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেননি। দুই প্রকার শ্রুতি হল ‘অন্তর-শ্রুতি ও ‘স্বর- শ্রুতি বা শ্রুতি–জাতি। তিনি প্রাচীন ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করে স্বরের পরে শ্রুতির স্থাপন করেছেন। যা উচিত ছিল স্বরের পূর্বে স্থাপন। প্রাচীন সংগীত শাস্ত্রের গ্রন্থগুলি সম্পর্কে পন্ডিত ভাতখন্ডের স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। যেমন পন্ডিতজী বলেছেন সংগীত-চূড়ামণি গ্রন্থ সংগীত-রত্নাকর গ্রন্থের অনুবর্তী গ্রন্থ। কিন্তু জগদেকমল্ল রচিত ‘সংগীত-চূড়ামণি’ গ্রন্থ শারঙ্গদেব রচিত ‘সংগীত-রত্নাকর’ গ্রন্থের (আ: ১২৪০ খ্রি:) প্রায় একশো বছর আগে রচিত। কিন্তু সংগীত চূড়ামণি গ্রন্থ অনুবর্তী নয়, পূর্ববর্তী গ্রন্থ। তিনি স্বরগ্রামের বাদী এবং রাগের বাদীকে অভিন্ন মনে করেছিলেন। কারণ স্বরগ্রামের স্বরগুলি স্থির এবং অন্তর শ্রুতি দ্বারা পরিমাপ্য। তাই,স্থির বাদী-সমবাদী স্বর ও শ্রুতি দ্বারা ব্যক্ত করা যায়। রাগের বাদী স্বর চলমান, কম্পিত, আন্দোলিত এবং অন্যান্য অলংকার দ্বারা প্রকটিত হয় বলে শ্রুতি দ্বারা মাপা যায় না, প্রয়োগ বা ব্যবহার দিয়ে বোঝাতে হয়।

ভারতীয় সংগীতে নাদবিদ্যা সম্পর্কে উৎকৃষ্ট ধারণা থাকতে গেলে মতঙ্গমুনির ‘বৃহদ্দেশী’ গ্রন্থখানি পড়া ও বোঝা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু পন্ডিত ভাতখন্ডে তাঁর নানা রচনায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি গ্রন্থখানি নাকি চোখেও দেখেননি। তাছাড়া হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতিতে (২য় ভাগ, পৃ: ৩০৭) তিনি কবুল করেছেন যে, তিনি ‘সংগীত- রত্নাকর’ গ্রন্থের কিছুই বোঝেননি।

বর্তমানে আমাদের সঙ্গীতের যা বিকৃত স্বর বলে পরিচিত, সেইগুলি দরবারী বিকৃতস্বর পারসিক প্রভাবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রাচীনকালে, একটা স্বর কতটা দুর্বল কতটা প্রবল সেগুলি শ্রুতি (অন্তর শ্রুতি) দিয়ে বোঝানো হত। শ্রুতিকে ইংরেজীতে ‘মাইক্রোটোন’ বলা হয়। যদিও ভারতীয় শ্রুতিকে সঠিকভাবে ‘মাইক্রোটোন’ বলা যায় না। যদিও ভারতীয় শ্রুতিকে কেউ কেউ মাইক্রোটোন বলেন।কারণ, শ্রুতি শ্রবনযোগ্য কিন্তু পাশ্চাত্যের মাইক্রোটোন খুবই সুক্ষ হওয়ার জন্য কর্নগোচর হয় না। ৫৩ মাইক্রোটোন – এক সপ্তক, কিন্তু আমাদের ২২ শ্রুতিতে এক সপ্তক। আমাদের শ্রুতিকে পাশ্চাত্যে অন্তরশ্রুতি বলা হয়। স্বর ও স্বরগুলি তৈরীর কাজে ব্যবহার করা হয়। ‘শ্রুতিজাতি’ সম্পর্কে পন্ডিতজী কোনো আলোকপাতই করেননি। আবার দেখা যায়, তিনি যে রাগ-রাগিনীতে স্বরের পরিচয় দিয়েছেন, সেগুলি স্থির ‘ঠাট-স্বর’ ভিত্তিক। ঠাট – স্বরকেই রাগের ভাবানুসারে নানাভঙ্গি ও অলংকারযুক্ত করতে হয় ।

সাধারণভাবে মনে হয়, পন্ডিত ভাতখন্ডেজী ছিলেন বর্তমান হিন্দুস্থানী সংগীতে প্রচলিত ১০ ঠাট  পদ্ধতির উদ্ভাবক। কিন্তু পন্ডিতজীর লেখা ‘হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতি গ্রন্থের ২য় ভাগে (৩৪৭ পৃ) দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে মনে হবে তিনি তাঁর রামপুর ঘরানা পরম্পরায় ১০ ঠাটের ব্যপারটি লাভ করেছিলেন। তিনি জনৈক ‘মুন্সী’ নামক ব্যক্তিকে দিয়ে ‘সরমায় ইসরৎ’ গ্রন্থটির মারাঠা তর্জমা করেছিলেন।

আমরা জানি, পন্ডিত ভাতখন্ডে ‘চতুরপন্ডিত’ এই ছদ্মনামের আড়ালে ‘মলক্ষ্যসংগীতম্’ নামক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থটি কার লেখা বলা শক্ত। ১৯১৬ খ্রি: রচিত A short historical survey of Indian music of upper Indian গ্রন্থে লিখেছেন যে, তিনি নাকি সংস্কৃত ভাষায় একটি সংগীত গ্রন্থ ও মারাঠি ভাষায় তার এক দীর্ঘ টীকা রচনা করেছেন। অথচ ‘হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতি’ তে (২য় ভাগ ৩০৭ পৃ:) লিখেছেন যে, সংগীত রত্নাকর (সংস্কৃতেয় লেখা) ইত্যাদি গ্রন্থ সংস্কৃত পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়ে পড়েছেন। যাইহোক, আরও মজার ব্যাপার হলো, ‘হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতি’ গ্রন্থে (১ম ভাগ, পৃ: ৮৪) তিনি এমন মন্তব্য করেছেন যাতে মনে হয়, তিনি নিজের গ্রন্থ ‘মলক্ষ্যসংগীতম্’ নিজেই কোনদিনই পড়েননি। হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতির (১ম ভাগ ১৪৬পৃ:) এক জায়গায় বলছেন ভারতের ‘নাট্যশাস্ত্র’ লুপ্ত হয়ে গেছে। অথচ লক্ষ্যসংগীতম্ এ তিনি নাট্যশাস্ত্রের উল্লেখ করেছেন, উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এইভাবে কয়েকটি মাত্র উদাহরন দেওয়া হল, আরো এমন অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে বিস্তৃত বিশ্লেষণ করা যায়।

যদিও উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের ব্যাপারে পন্ডিত ভাতখন্ডের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনীয়। আজ যে শাস্ত্রীয় সংগীত সর্বশ্রেনীর সমাজে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বহুল পরিমানে অনুশীলিত হছে এবং পদ্ধতিগত ভাবে শিক্ষার ব্যাপারে পন্ডিত ভাতখন্ডের দান অনেকখানি।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে বাংলা ও বাঙালির স্থান ঠিক কোথায়? তার কি সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে।?  ইতিহাসের পাতা থেকে, যে সব নাম উঠে আসবে একগুচ্ছ নাম, বর্ণনা করব কলকাতার বুকের সেই সব উজ্জ্বল দিন-রাত্রি, জমজমাট মেহফিলের কথা, যেখানে গান গাইছেন গওহরজান। দর্শকাসন পরিপূর্ণ করেছেন শহরের ধনী, সঙ্গীতপ্রেমী পৃষ্ঠপোষকরা। পরে এঁদেরই কারও স্মৃতিচারণে বাঙালির সোনালি দিনের কথা জানতে পারব এবং ভাল জমাটি উত্তর লেখার স্টাইলে আমরা উদ্ধৃত করব অমিয়নাথ সান্যালের ‘স্মৃতির অতলে’। কিন্তু আসল হিরে কোথায়? মানে, বাংলার মুখ হয়ে সর্বভারতীয় স্তরে রাজত্ব করেছেন, এমন হাড়ে-মজ্জায় বাঙালি ক’জন পেয়েছি আমরা?

ইতিহাস কিন্তু খুব গৌরবোজ্জ্বল? ঊনবিংশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে হিন্দুস্তানি সংগীতের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখব, বাংলায় যে ভাবে সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা হয়েছে বা বাঙালিরা যে ভাবে সর্বভারতীয় স্তরে ‘অসাধারণ শ্রোতা’র তকমা লাভ করে খুশি হয়েছে, ততখানি পূর্ণাঙ্গ শিল্পী ভারতকে দিতে পেরেছে কি না সন্দেহ।

মওজুদ্দিন খান তখন কাঁপিয়ে দিচ্ছেন সারা দেশ, যেমন তাঁর গলার জোর, তেমনই অসাধারণ গায়কি। বন্দিশি বা বোল-বনাও ঠুমরীতে সে সময় তাঁর ধারে কাছে কেউ নেই। কলকাতার গর্ব গওহরজানের খেয়াল বা ঠুমরীতে তাঁর বিস্তারিত প্রভাব রয়েছে, গওহর নিজেই সে কথা স্বীকার করেছেন একাধিক বার। কিন্তু গওহর বাঙালি নন কিন্তু বাংলা গান গেয়েছেন ,সেই সময় বাংলায় শিক্ষক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন বদল খাঁ, কিরানা ঘরানা।

কিন্তু বাঙালি তথাকথিত ‘অভিজাত’ ও ‘ভদ্র’ পরিবারের ঘরের মেয়েদের ও বধূদের ভিতর উচ্চাঙ্গ সংগীত প্রশিক্ষণ চালু করার কৃতিত্ব গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী এবং মন্মথ গাঙ্গুলী যিনি ধ্রুপদ শিখেছিলেন নাসিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে, খেয়াল শিখেছেন এনায়েত হুসেন খাঁ সাহেবের কাছে ও ঠুমরীর তালিম নিয়েছেন ভাইয়া গণপত রাওয়ের কাছে। কাজেই শিল্পীর চেয়েও বেশি প্রশিক্ষক ও বাংলায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের ধারক ও বাহক হিসেবে তাঁর সুনাম হল বেশি। আর মন্মথ গাঙ্গুলীও বহু বাইজিকে বাইজি কোঠা থেকে তুলে এনে জন সমক্ষে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, বিরাট অবদান, কিন্তু মানুষ ভুলে গেছেন, ইতিহাসে আজও উপেক্ষিত। মানুষ বাঙালি, যাঁর কণ্ঠসংগীতের খ্যাতি আসমুদ্রহিমাচল নাড়িয়ে দিয়েছিল, তিনি ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। আফসোস হয়, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটা সুস্থির হলে হয়তো ভারতীয় সংগীতের ক্ষেত্র আরও সমৃদ্ধ হতে পারত।

একই ভাবে বলা যায়, লখনউয়ের বাঙালি চিন্ময় লাহিড়ীর কথাও। স্বকীয়তায় তিনি চিনিয়েছেন শিল্পীসত্তা, কিন্তু স্বশাসন ও শৃঙ্খলার অভাব ছাপ ফেলেছে তাঁর স্থায়িত্বে। বাঙালি শ্রোতার মনে এখনও তাঁকে নিয়ে কিছু স্মৃতিমেদুরতা আছে বটে, কিন্তু সর্বভারতীয় মননে চিন্ময় লাহিড়ী বিস্মৃতপ্রায়। প্রসিদ্ধ ‘নাকুবাবু’ অর্থাৎ তারাপদ চক্রবর্তী কলকাতার উচ্চাঙ্গসংগীত মহলে অতি সম্মাননীয়। কিন্তু তিনি বাংলায় যতখানি প্রসিদ্ধ হয়েছেন, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাঁর স্বীকৃতি নিয়ে কোথাও যেন একটা প্রশ্ন যেন থেকেই গিয়েছে, অনেকেই বলেন হয়তো সেটা তাঁর লয়কারির দুর্বলতায়। সাংস্কৃতিক পীঠস্থান হিসেবে যতই সুখ্যাত হোক, বাংলার বিষ্ণুপুর ঘরানার অবদান অনস্বীকার্য। কীর্তন, টপ্পা, এমন কি খেয়ুর ও বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রভাবে অনুপ্রাণিত ও বিকশিত।

এনারাই প্রথম চেষ্টা করেছিলেন বাংলা ভাষায় খেয়াল চর্চা ও  কন্ঠ সংগীত পরিবেশন করার ব্যাপারে। কিন্তু সেটাও ইতিহাস মেনে নিল না। এটা বাংলা সংস্কৃতির একটা অবনয়ন তো বটেই, যদিও এটা ঠিক সঙ্গীতে বাংলা হিন্দি বলে কিছু নেই, যেখানেই সুরের চর্চা বা সুর আছে সেখানেই সংগীত। কিন্তু সংগীত একই সাথে আঞ্চলিক বা ঘরানা ভিত্তিক এবং আন্তর্জাতিক। কই দক্ষিণ ভারত তো তাঁদের সংস্কৃতিকে ভোলেননি আজও। তাঁরা ধরে রেখেছেন। কিন্তু সেই জায়গায় বাঙালি আজও এবং বাঙালির মনন শুধু পিছিয়ে নয় সংগীত অনেকটাই এখন ইউরো সেন্ত্রিক। এই ডিজিটাল সংগীত গ্রাস করে ফেলেছে সংগীতের  আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য গুলোকে। এখন সংগীত একটা সার্বজনীন রূপ পেতে চলেছে। যেটা যেকোন সংস্কৃতির পক্ষে একটা বিপদজনক ব্যাপার। ইউনিটি এন্ড ডাইভার্সিটি হলো মূল কথা,  আমাদের সংস্কৃতির যেটা নিচিহ্ন হওয়ার পথে হাঁটছে। দেখা যাক আগামী ইতিহাস এর কি জবাব দেয়। আমরা আছি তারই অপেক্ষায়..

দাঁড়াও পথিক বর (মধুসুধন), বিদ্যাসাগরের উত্তরসূরীরা আজ শুধু ইতিহাসের পাতায়। বন্দেমাতরম গানটার প্রথম সুর করেছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রায় আদি পুরুষ যদু ভট্টকে কেউ মনে রাখেনি। রবীন্দ্রনাথ এর গান শুধু বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়, বাড়ির আলমারিতে এক কোনে সাজানো আছে। রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই অনুমান করেছিলেন, তাই লিখলেন:;

আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। (রাগ ভৈরবী)

আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও।

যে জন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে

আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে

এই অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও।

বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া আলোয়-পাগল প্রভাত হাওয়া,

সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও।

আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও,

মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও।

আমার পরান-বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান--

তার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান।

তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁইয়ে দাও।

বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া প্রাণে-পাগল গানের হাওয়া,

সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Indian song history)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours