তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

ভারতীয় রেল সরকারের সহযোগিতা ছাড়াই প্রথম ব্যক্তিগত উদ্যোগ্যে যে ব্যক্তি প্রথম রেললাইন পাতার কাজ করতে চেয়েছিলেন তিনি হলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ১৮৪২ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতা-  হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ পর্যন্ত রেল চালাবার পরিকল্পনা করেন, কোম্পানির নাম গ্রেট ওয়েস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুতে সেই পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেয়। পরে এলো ভারতবর্ষের অন্যতম খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির নাম মার্টিন এন্ড কোম্পানী।

এই বৃহত্তর পাইকপাড়া বাসীরা যেটা জানতেন সেটা মার্টিন এন্ড কোম্পানী লিমিটেড, কিন্তু অনেকেই জানতেন না এর রূপকার ছিলেন বাঙালি শিল্পদ্যোগী স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এই বৃহত্তর পাইকপাড়ার সাথে রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক ছিল গভীর।

পাইকপাড়ার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সেভেন ট্যাংকস এর জমি হস্তান্তরিত হয়ে যায় এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের হাতে, স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ভাইপো ডা: মতিলাল মুখোপাধ্যায় কেনেন ওই সম্পত্তি। যাইহোক একমাত্র নেটিভ হওয়ার কারণে তাঁর নাম বাদ যায়, মার্টিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯২ সালে।

কলকাতার যে রাস্তাটির নাম ছিল মিশন রোড, বর্তমানে তা আমাদের কাছে আর.এন.মুখার্জি রোড নামে পরিচিত। ডালহৌসি অঞ্চলের এই রাস্তাটা প্রায় সারাবছরই মুখর থাকে মানুষের ব্যস্ততায়, অথচ পথচলতি বেশিরভাগ মানুষই খোঁজ রাখেন না কে এই আর.এন. মুখার্জী? জিজ্ঞাসা করলে কেউ কেউ যেমন কিছুই বলতে পারেন না, আবার কেউ কেউ তেমন জানান, "উনি খুব নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন।" ব্যাস ওইটুকুই। বিদেশী অনেক ব্যবসায়ী যাকে নিজের আইডল মনে করেন, সেই মহান বাঙালি স্থপতি-ব্যবসায়ী স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে এর বেশি আর কিছুই বলতে পারেন না। এ বোধহয় একমাত্র আত্মমগ্ন, আত্মবিস্মৃত বাঙালির পক্ষেই সম্ভব। বাঙালি ব্যবসা করে না - এ যেমন বাঙালির এক বদনাম; তেমনি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কিত এই বিস্মৃতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, কোনও বঙ্গসন্তান ব্যবসা করে সফল হলেও তাঁকে মনে রাখার কোনওরকম চেষ্টা নেই এই জাতির। তাই ক্রমশই বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছেন এক কালের খ্যাতনামা এই বঙ্গতনয়।

অতীতের পাতা উল্টে খানিক পিছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখব, আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার বুকে রমরমিয়ে চলছে ব্রিটিশ জমানা। এমন সময়েই একদিন কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার ব্রাডফোর্ড লেসসি সাহেব এক চূড়ান্ত ফাঁপড়ে পড়লে একরকম তাঁর রক্ষাকর্তা হিসাবেই আবির্ভাব ঘটে রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের। ভাষাগত সমস্যার জেরে মিস্ত্রিদের কাজ বোঝাতে লেসসি সাহেব যখন বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন, তখন রাজেন্দ্রনাথই তাঁর কাছ থেকে সব বুঝে নিয়ে দেশীয় মিস্ত্রিদের তা বুঝিয়ে দেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন লেসসি। রাজেন্দ্রনাথের দিকে ছুঁড়ে দেন নতুন চ্যালেঞ্জ। কপর্দকশূন্য, অভিজ্ঞতাহীন যুবক রাজেন্দ্রনাথও সেদিন শুধুমাত্র মনের জোরেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। আর এই ঘটনাই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের টার্নিং-পয়েন্ট।

১৮৫৪ সালের ২৩ জুন বসিরহাটের ভ্যাবলা গ্রামে রাজেন্দ্রনাথের জন্ম। মাত্র ছ'বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা মায়ের কাছেই। নানা বিপর্যয়, অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে শৈশব কাটলেও, নিজের মেধার জোরেই তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। আসলে সে সময় শিবপুর বসিরহাটের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্লাস প্রেসিডেন্সির ক্যাম্পাসে চলত। দীর্ঘ তিন বছর পড়াশোনা করার পরও হঠাৎই স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে পরীক্ষায় বসা হয়নি তাঁর। তাই সেইসময় থেকেই গতানুগতিক চাকুরি-জীবনের স্বপ্ন না দেখে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী হওয়ার। এরপরই একদিন লেসসি সাহেবের সঙ্গে আলাপ এবং তারপরই পলতার জল প্রকল্পের হাত ধরে তাঁর ব্যবসায়ী জীবনে অভিষেক। এরপর একে একে তিনি লখনউ, এলাহাবাদ, আগ্রা, কানপুর জলপ্রকল্প তৈরি করেন এবং এই বঙ্গসন্তানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশময়। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও শুধুমাত্র ‘নেটিভ’ হওয়ার দরুন তাঁকে বারবার হতে হয়েছে অবিচারের শিকার৷ ফলে এরপর যখনই স্যার টমাস অ্যাকুইনাস মার্টিনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ব্যবসা করার প্রস্তাব তাঁর কাছে আসে তখনই তিনি তা লুফে নেন৷ এরপর ১৮৯২ সালে মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি গড়ে উঠলে তাঁর ব্যবসার পরিধিও বেড়ে যায়। এদিকে ১৯০৬ সালে মার্টিন সাহেব মারা গেলে রাজেন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন ওই সংস্থার সিনিয়র পার্টনার। এই মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি একে একে কলকাতা সহ ভারতের নানা শহরে গড়ে তোলে নানা স্থাপত্য৷ এমনকি  কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ, বেলুড়মঠ ও মন্দির, টিপু সুলতান মসজিদ, বিধানসভা ভবন ইত্যাদির নির্মাণেও রয়ে গিয়েছে স্যার রাজেন্দ্রনাথের সংস্থার অবদান। এদিক থেকে দেখলে কার্যত কলকাতার রূপকার বলা যায় তাঁকে।

সেই সময় ব্রিটিশ সরকার ভারতে রেলপথ চালু করে দেশের বড় বড় শহরকে যুক্ত করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু সে যুগে বসেও রাজেন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন যে শুধু বড়ো বড়ো শহর নয়, দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে শহরের সঙ্গে আশেপাশের গাঁ-গঞ্জকেও রেলপথে যুক্ত করতে হবে৷ তাই মূলত বেসরকারি উদ্যোগ হিসেবেই তিনি ‘মার্টিন লাইট রেলওয়ে’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন৷ যা পরিচিত ছিল ‘ন্যারোগেজ রেল’ বা ‘ছোটো রেল’ নামেই৷ গোটা দেশ জুড়েই এরকম বেশ কয়েকটি ছোট বেসরকারি রেল ব্যবস্থা চালু করে তিনি সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দিতে শুরু করেন৷ সেগুলির মধ্যে হাওড়া-আমতা, বারাসত-বসিরহাট, বক্তিয়ারপুর-বিহার, আরা-সাসারাম, দিল্লি-সাহারানপুর ইত্যাদিও রয়েছে। অন্যদিকে পূর্ত বিভাগের বিভিন্ন বরাত পাওয়া কাজ করতে গিয়ে তিনি অনুভব করেন লৌহ ইস্পাত কারখানার প্রয়োজন সেইসময় ভারতে ঠিক কতটা! তাই তিনি ও তাঁর মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি ১৯১৮ সালে গড়ে তোলেন ইস্কো। যার বার্ণপুরের কারখানাটিই দেশের দ্বিতীয় ইস্পাত কারখানার মর্যাদা পায়। এর আগে ১৯০৭ সালে জামশেদপুরে দেশের প্রথম ইস্পাত কারখানাটি গড়ে ছিলেন টাটা গোষ্ঠী। আজও এই দু’টি কারখানাই ভারতের অন্যতম ইস্পাত উৎপাদনের উৎস। ১৯৩৬ সালে রাজেন্দ্রনাথের মৃত্যু হলেও তাঁর ছেলেরা, বিশেষত স্যার বীরেন মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে সম্প্রসারণ হওয়ায় ইস্কোর রমরমা অবস্থা দেখা গিয়েছিল। ফলে ছয়ের দশকের শেষ দিকেও বাঙালি নিয়ন্ত্রিত এই শিল্পগোষ্ঠী সম্পত্তির পরিমাণে সারা দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করেছিল। কিন্তু তারপর দ্রুত এই গোষ্ঠী তার পূর্ব গৌরব হারায়৷ হাত বদল হয়ে যায় এই গোষ্ঠীর হাতে থাকা একের পর এক সংস্থাগুলি এবং এই মুখোপাধ্যায় গোষ্ঠীর পতন ঘটতে থাকে।

শিল্প-বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজেন্দ্রনাথের খেলাধূলার প্রতিও ছিল এক অমোঘ আকর্ষণ৷ এমনকি তিনি বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, বেঙ্গল ফ্লাইং ক্লাব, মোহনবাগান ক্লাবের মতো সংগঠনের সভাপতির আসনও অলংকৃত করেছেন৷ ব্রিটিশ আমলেও তিনি বহু বিদেশী কমিটির সদস্য ছিলেন৷ কিন্তু এত কিছুর মাঝেও তাঁর কাছে ব্যবসাই সর্বক্ষণ অগ্রাধিকার পেয়েছে৷ তাই বারবার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তিনি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় ইংরেজ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন৷ ১৯১০ সালে এডওয়ার্ড বেকার তাঁকে কৃষি ও শিল্প দফতর দিতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি৷ একইরকম ভাবে আরও বছর দশেক বাদে চেমর্সফোর্ডের মন্ত্রীসভার শিল্প দফতরের দায়িত্ব নিতে বলায় তিনি সেই প্রস্তাবও এড়িয়ে গিয়েছিলেন৷ এই বিখ্যাত বাঙালি তাঁর জীবৎকালে নানান পুরস্কার, উপাধি দ্বারাও সম্মানিত হয়েছেন। এমনকি তাঁর ঝুলিতে রয়েছে নাইট উপাধিও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডি.এসসি উপাধিও প্রদান করা হয়েছে। কলকাতার কারিগর এই মানুষটিকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে তাঁর একটি মুর্তিও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল প্রাঙ্গনে স্থাপিত রয়েছে। কিন্তু খুব দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে, বাঙালি সমাজ এই বিশ্বখ্যাত বঙ্গসন্তানকে মনে রাখেনি।

আসলে ব্যবসা বিষয়টিকে একেবারে প্রথম থেকেই বাঙালিরা 'নট আওয়ার কাপ অফ টি' বলে দাগিয়ে দিয়েছে। তাই তো স্বাধীনতার এত বছর পরেও অর্থনৈতিক দিক থেকে বাঙালি আজও মোটের ওপর কোণঠাসা৷ স্যার রাজেন্দ্রনাথের মতো মানুষকে বাঙালি তার আইডল তালিকায় রাখে না, সে দুর্ভাগ্য বাঙালিরই।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় রেলপথ প্রতিষ্ঠা এবং রেল-চলাচলের সূচনা সাধারণ মানুষের মনে বিশেষ আলোড়ন তুলেছিল। ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট, প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ২৪ মাইলের রেললাইন ব্যবহৃত হয়। এর পর প্রথমে হাওড়া থেকে পাণ্ডুয়া, পরে ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত নিয়মিত ট্রেন চালু হয়। প্রথমে পণ্য পরিবহণের জন্য চালু হলেও অচিরেই আরও বহু রেললাইন বসে এবং মানুষের যাতায়াতের অঙ্গ হয়ে ওঠে রেলগাড়ি। ‘সম্বাদ প্রভাকর’ কাগজে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘শারদ্বর্ণন’ কবিতায় লিখলেন— ‘টাকা ছেড়ে থাবড়ায়/ পার হয়ে হাবড়ায়/ চালিয়েছে রেলওয়ে পথে। হুগলির যাত্রী যত/ যাত্রা করি জ্ঞান হত/ কলে চলে স্থলে জলে সুখ। বাড়ী নহে বড়ো দূর/ অবিলম্বে পায় পুর/ হয় দূর সমুদয় দুখ’। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Martin rail Rajendranath Mukherjee)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours