তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
বাংলা ভাষায় সহজেই হাজার হাজার পারসী আরবী শব্দ চলে গেছে। তার মধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু যে-সব পারসী আরবী শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত অথবা হয়তো কোনো-এক শ্রেণীর মধ্যেই বদ্ধ, তাকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে। হত্যা অর্থে খুন ব্যবহার করলে সেটা বেখাপ হয় না, বাংলায় সর্বজনের ভাষায় সেটা বেমালুম চলে গেছে। কিন্তু রক্ত অর্থে খুন চলেনি, তা নিয়ে তর্ক করা নিষ্ফল।
দিল্লীর উত্তর ও পূর্বে প্রচলিত খাড়ি বোলি উপভাষা লেখ্য হিন্দির ভিত্তি। এছাড়া হিন্দির একটি উপভাষা ব্রজ ভাষায় ১৫শ শতক থেকে ১৭শ শতক পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য রচিত হয়। হিন্দির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপভাষার মধ্যে আওয়াধি, বাঘেলি, ছত্তিশগড়ি, বুন্দেলি ও কনৌজি অন্যতম। তবে ছত্তিসগড়ি, ভোজপুরি সহ অন্যান্য স্বতন্ত্র ভাষাকে এটি রাজনৈতিকভাবে আগ্রাসনের শিকার করেছে।
উর্দু সহ অন্যান্য স্বতন্ত্র ভাষা সমুহকে বাদ দিলে এর মাতৃভাষী দাড়ায় মাত্র ২৭ কোটি। যেখানে বাংলা মাতৃভাষি ৩০ কোটি। এখানে উল্লেখ্য যে ভোজপুরি, মৈথিলি ও ঝাড়খন্ডি ভাষাগুলোর হিন্দির চেয়ে বাংলার মিল বেশি।
একটা সাম্প্রদায়িক পোস্ট বাজারে কিছুদিন আগেও বাজারে চলেছিল। পোস্টটা এইরকম:
“ইংল্যাণ্ডের ইংরেজি আর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার ইংরেজি এক নয়। স্পেনের স্প্যানিশ আর মেক্সিকো, গুয়াতেমালার স্প্যানিশ এক নয়। হিন্দি আর উর্দু যেমন এক নয়, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আর বাংলাদেশের বাংলাও এক নয়। দুটিকে আলাদা আলাদা ভাষার মর্যাদা দেওয়া হোক ইতিমধ্যে মাইক্রোসফট এই স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে।কারণ,
আমি নাস্তা খাই না। আমি জলখাবার খাই।
আমি গোসল করিনা। আমি স্নান করি।
আমি পানি খাই না। আমি জল পান করি।
আমি গোস্ত খাই না। আমি মাংস খাই।
আমি ফোন দিই না। আমি ফোন করি।
আমি দাওয়াত দিই না। আমি নিমন্ত্রণ করি।
আমি দোয়া করি না। আমি প্রার্থনা করি।
বাংলা ভাষায় পানি, আম্মা, কসম, ভাইজান এসব শব্দ বাংলা ভাষার নয়। আর তাই আমি বাংলা ভাষায় কথা বলি। বাংলাদেশী ভাষায় নয়।”
উপরের এই সাম্প্রদায়িক পোস্টটার উত্তরে আমার একটাই বক্তব্য। সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডা থেকে নিজের মাথাকে সর্বপ্রথম আধঘন্টা ফ্রি রাখো।এরপর ভাষা-উপভাষা ও শব্দের উৎসগত শ্রেণীবিভাগ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো। এগুলো পড়ার পর অন্তর থেকে বিদ্বেষ প্রোপাগান্ডা সরিয়ে নিজেকে মুক্ত করো।
প্রতিটা বৃহৎ ভাষার একাধিক উপভাষা রয়েছে।একই ভাষা বিভিন্ন জায়গায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন উপভাষা রূপে উচ্চারিত হয়। উপভাষা হল একই ভাষার ভিন্ন ভিন্ন কথ্য রূপ। অন্যান্য ভাষার মত বাংলারও রয়েছে পাঁচটি উপভাষা।রাঢ়ী, বঙ্গালী, বরেন্দ্রী, ঝাড়খন্ডি ও রাজবংশী বা কামরূপী। এদের মধ্যে রাঢ়ী উপভাষাটি কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে প্রচলিত। আর কলকাতা যেহেতু ঐতিহাসিক ভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই রাঢ়ী উপভাষাটিকে ধীরে ধীরে মান্য বাংলা ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। তার মানে এই নয়, কেউ যদি তার নিজের উপভাষায় কথা বলছে মানে সে ভুল বলছে। প্রতিটা উপভাষা সমান মর্যাদার ও সম্মানের। এখন যদি ইতিহাসের পাতায় কলকাতার বদলে মালদা, পুরুলিয়া, ঢাকা কিংবা কোচবিহার বেশি গুরুত্বপূর্ণ হত তাহলে হয়তো রাঢ়ীর বদলে প্রাধান্য পেত বরেন্দ্রী, ঝাড়খন্ডী, বঙ্গালী কিংবা রাজবংশী। তাই বাংলাদেশের উচ্চারণ শুনে এপার বাংলায় যারা সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে বলছে ওটা বাংলা নয়, কিংবা পুরুলিয়ার কথা শুনে যেসব কলকাত্তাইয়া বাবুরা হাসে তারা অত্যন্ত মূর্খ এবং ভাষা সম্পর্কে নূন্যতম বোধটুকুও নেই।
বাংলাভাষার শব্দগত উৎস মূলত পাঁচটি।তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি। মূলত সংস্কৃত শব্দগুলো তৎসম (সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র, মনুষ্য)। এই সংস্কৃত শব্দ গুলো উচ্চারণ ভেদে পরিবর্তিত হয়েছে অর্ধতৎসম রূপে (জোছনা, গিন্নি, মন্তর)। আর সংস্কৃতজাত শব্দগুলো যখন প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় স্থান লাভ করে তখন তাকে বলা হয় তদ্ভব (চাঁদ, হাত, দই)। এবং এ ভূখণ্ডে যারা আদিকাল থেকে বাস করতো তাদের শব্দগুলো উৎসগতভাবে দেশি শব্দ (কুড়ি, পেট, চুলো, ঢেঁকি, ঝাঁটা)। এর সাথেই রয়েছে বাংলা শব্দের একটা বিশাল ভান্ডার, সেটা হল বিদেশি উৎস যা বাংলায় গৃহীত হয়েছে।
আরবি থেকে: (আদালত, আলেম, ইনসান, ঈদ, উকিল, ওজর, এজলাস, এলেম, কানুন, কলম, কিতাব, কেচ্ছা, খারিজ, গায়েব, দোয়াত, নগদ, বাকি, মহকুমা, মুন্সেফ, মোক্তার, রায়)
ফার্সি থেকে: (খোদা, গুনাহ, দোযখ, নামায, পয়গম্বর, ফেরেশতা, বেহেশত, রোজা, কারখানা, চশমা, জবানবন্দি, তারিখ, তোশক, দফতর, দরবার, দোকান, দস্তখত, দৌলত, নালিশ, বাদশাহ, বান্দা, বেগম, মেথর, রসদ, আদমি, আমদানি, জানোয়ার, জিন্দা, নমুনা, বদমাস, রফতানি, হাঙ্গামা)
ইংরাজি থেকে: (ইস্কুল, কেটলি, বোতল, হাসপাতাল)
পর্তুগিজ থেকে: (আনারস, আলপিন, আলমারি, গির্জা, গুদাম, চাবি, পাউরুটি, পাদ্রি, বালতি)
ফরাসি থেকে: (কার্তুজ, কুপন, ডিপো, রেস্তোঁরা)
তুর্কি থেকে: (চাকর, চাকু, তোপ, দারোগা)
চিনা থেকে : (চা, চিনি, লুচি) (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Bengali language Rabindranath Tagore terrorism)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours