তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
নর্তকীদের আনার জন্য পাল্কী পাঠিয়ে দেওয়া হত। সঙ্গে যেত পাইক ও বরকন্দাজ। পাল্কীটাকে বেহারারা নাটমন্দিরের সামনে এনে নামাত। “রাজা সাহেব এগিয়ে আসতেন খুশী উজ্জ্বল দুটো কামাতুর চোখ নিয়ে। মােসাহেবের দল অপরিসীম কৌতুহল নিয়ে পাল্কীর রুদ্ধ দুয়ারের দিকে তাকাতেন। তারপর দরজা দুটো খুলে যেত। নর্তকী নামত, পরনে মসলিনের পেটিকোট ও ওড়না ও সমস্ত দেহ অলঙ্কারে মােড়া, ঠোঁটে উজ্জ্বল হাসি ঠিকরে পড়ত। রাজা সাহেব এগিয়ে আসতেন, বলতেন, এস বিবিজান।” নিকী বাঈজীকে সেই সময়ে (১৮১৯) কলকাতার এক ধনী ব্যক্তি মাসিক এক হাজার টাকা দক্ষিণা দিয়ে রক্ষিতা রূপে গ্রহণ করে সমাজে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। মহারাজ সুখময় রায়ের বাড়ির ১৭৯২ সালের দুর্গাপূজা আর বাঈজী নাচের বিবরণ ‘ক্যালকাটা ক্রনিকল’-এ প্রকাশিত হয়।
“The only novelty that rendered the entertainment different from those of lost year, was the introduction or rather the attempt to introduce some English tunes among the Hindusthani Music.
রাজেন্দ্র মল্লিকের কান-ফোঁড়া উপলক্ষে যে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবানুষ্ঠান হয়েছিল, তার বিবরণ ১৮২৩-র ১৫ মার্চ ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, “বাটির বাহিরে যেরূপ আলাে দেওয়া হইয়াছিল ভিতরের আড়ম্বর উহা অপেক্ষা কোন অংশে নূন ছল না। লাল ভেলভেট পাতা পথের উপর দিয়া ভিতরে যাইবার ব্যবস্থা, চারিদিকে সুবর্ণ খচিত ফুলের মালা ও ফুলে সুসজ্জিত, সঙ্গীত ও সৌন্দর্য্যে যেন স্বর্গের নন্দনকানন বলিয়া ভ্রম হয়। নর্তকী গায়িকার সংখ্যা অধিক না হইলেও যে দুইজন নাচিতেছিল তাহারা অলৌকিক সৌন্দৰ্য্যশালিনী। নিকীর গান ও রূপের বর্ণনা তাহার সঙ্গিনীর সঙ্গে মানাইয়াছিল। গােলাপের সহিত পদ্মের বর্ণ যেন মিশ্রিত হইয়া অনুপম কপােলে উজ্জ্বলাভা বিকীর্ণ করিতেছে, চক্ষু হইতে আনন্দ উৎস বিচ্ছুরিত হইতেছে, অন্যটিকে ইউরােপের রবিন পক্ষীর মত সুন্দর মনে হয়, তাহারা যেন কন্দর্পের শর লইয়া ত্রীড়া কন্দুক করিতেছিল। যাহা যেরূপ হওয়া উচিৎ উহা সেইরূপই হইয়াছিল। সুনির্বাচিত সম্মিলনীতে সুমিষ্ট সুরা লেহ্য পেয় শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের সহিত নৃত্যাদিতে যথারীতি আদর আপ্যায়নে আমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ পরিতুষ্ট, কিছুরই ত্রুটি ছিল না।”
আসুন এবার যাই ১৮০৬ সালের শােভাবাজারের রাজা রাজকৃষ্ণের রাজবাড়িতে দুর্গাপূজা ও বাঈজী নাচ দেখতে। সত্যি সত্যি তাে যাওয়া যাবে না, তাইভিসা দেখা যাক আমন্ত্রিত অতিথি ধর্মযাজক ওয়ার্ড কি দেখেছিলেন। তিনি শােভাবাজর রাজবাড়িতে এ বছরের দুর্গাপুজোয় উপস্থিত ছিলেন। তিনি লিখেছেন,
“আমি শােভাবাজার রাজবাড়ীর দুর্গোৎসবে উপস্থিত ছিলাম। চারমহল প্রাসাদের মাঝে উৎসব প্রাঙ্গণ, সামনে ঠাকুর দালান। পুবদিকে একখানা ঘরে মদ ও সাহেবি খানার আয়ােজন হয়েছে সাহেব অতিথিদের জন্যে। ঘরের সামনে দুজন পর্তুগিজ খানসামা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দু’পাশের ঘরে নিমন্ত্রিত এদেশীয় অতিথিরা উপস্থিত। মাঝখানে বিশাল অঙ্গণে হিন্দু নর্তকীদের নাচগান চলছে। সাহেব অতিথিরা চারদিকে কৌচে বসে তন্ময় হয়ে দেখছেন। মাঝে মধ্যে মুসলমান বাঙ্গরা হিন্দুস্থানী গান গেয়ে ও রঙ্গ তামাশা করে আসরের সকলকে আপ্যায়ন করছে। রাত তখন দুটো। বাঈজী ও নাচের মেয়েরা চলে গেল। ক্রমে সাহেব অতিথিরাও বিদায় নিলেন। কেবলমাত্র আমরা কয়েকজন তখনও বসে।”
অভিজাত সমাজের মানুষদের বাড়িতে দরজা বন্ধ করে কড়া পাহারা’র আড়ালে অনুষ্ঠিত হত বাঈজী নাচ, সাহেবদের আপ্যায়ণের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ আগে নিশ্চিত মনে রেভারেন্ড ওয়ার্ড দেখছিলেন বাঈজীদের, “সুবেশে সজ্জিত, গাইছে, নাচছে যেন নিদ্রাতুর পদক্ষেপে, তাদের ঘিরে আছে সােফায় কাউচে বসা ইউরােপীয় অতিথিবৃন্দ…।”
এমনই একটা বিনােদনের আয়ােজন হয়েছিল রাজা রামমােহনের বাসভবনে। সেখানে নিকী বাঈর মত আধুনিক ‘বসন্ত সেনা’ বহুবার নৃত্যগীতাদি প্রদর্শন করেছিল। এদের উৎসবানন্দের জলসায় দেশীয় ধনিক ও কোম্পানির তােঙ্গ সাহেব কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করতেন। এদের বল্গাহীন আমােদ-প্রমােদের একটি সংযত ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন ফ্যানি পার্ক। তিনি সে সময়ে কলকাতায় এসেছিলেন এবং একজন ধনিক বাঙ্গালী বাবুর বাড়ী’র উৎসবে উপস্থিত হয়েছিলেন। তার বিবরণে জানা যায়,
“...পাশের একটি বড় ঘরে নানারকমের উপাদানে উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে সাজানাে ছিল। সবই বাবুর ইউরােপীয় অতিথিদের জন্য বিদেশী পরিবেশক ‘মেসার্স গাণ্টার অ্যাণ্ড হুপার’ সরবরাহ করেছিলেন। খাদ্যের সঙ্গে বরফ ও মদ্যও ছিল প্রচুর। মণ্ডপের অন্যদিকে বড় একটি হল ঘরে সুন্দরী সব পশ্চিমা বাঈজীদের নাচগান হচ্ছিল এবং ইউরােপীয় ও এদেশী ভদ্রলােকরা সােফায় হেলান দিয়ে চেয়ারে বসে সুরা সহযােগে সেই দৃশ্য উপভােগ করছিলেন।”
১৮১৪ সালে রাজা সুখময় রায়ের ছেলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বাড়ির দুর্গাপুজোর খবর বেরিয়েছিল ক্যালকাটা গেজেটে। সেদিন শহরের বিখ্যাত বাঈজী নিকী নেচেছিলেন। ২০ অক্টোবর প্রকাশিত এ খবরে জানা যায় দুর্গোৎসবের সময় কলকাতার ধনিক হিন্দুরা পরস্পর অমিতব্যয়ের প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হন এবং তাদের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় টাকার জেল্লা দেখিয়ে যেন তারা সমাজে মান-মর্যাদা অর্জন করতে চান এবং গণ্যমান্য হতে চান সাধারণ মানুষের মধ্যে। রাজা সুখময় রায়ের পুত্র রাজা কিষাণচাঁদ রায় ও তার ভায়েদের গৃহে পুজোর কয়েকদিন নিকী নামে বিখ্যাত বাঈজীর নৃত্যগীত পরিবেশিত হবে। পূর্বাঞ্চলের একজন শ্রেষ্ঠ বাঈজী বলে নিকীর নামডাক আছে। অতএব শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় উৎসব হবে রাজা সুখময় রায়ের গৃহে। নীলমণি মল্লিকের গৃহে নৃত্যগীত হবে বাঈজী ঊষারাণীর। সারা হিন্দুস্থানে ঊষারাণীর মতন সুকণ্ঠ গায়িকা আর দ্বিতীয় নেই।”
এর দু’বছর পরে এক বাঈনাচের খবর বেরিয়েছিল ‘এশিয়াটিক জার্নাল’-এ। এই সংবাদ থেকে বাবুদের বাঈজী নাচের ও অন্যান্য আড়ম্বরের প্রতিযােগিতার কথা জানা যায়। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Baiji babu culture)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours