তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

হোমিওপ্যাথির চিকিৎসার রীতির জনক ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ওরফে ডা. হ্যানিম্যান বিশ্বব্যাপী হ্যানিম্যান নামে পরিচিত। এই মহাজ্ঞানী পণ্ডিতের জন্ম ১০ এপ্রিল ১৭৫৫। মৃত্যু ২ জুলাই ১৮৪৩। হ্যানিম্যান নিজেকে কখনও হোমিওপ্যাথি পদ্ধতির আবিষ্কারক দাবি করেননি। তবে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, হ্যানিম্যানই প্রথম ব্যক্তি, যিনি সদৃশবিধানের ওপর ভিত্তি করে পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক এ চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন। প্রচলিত সব চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে এর নীতি ও প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাই তিনি নিঃসন্দেহে প্রচলিত হোমিওপ্যাথির জনক।

প্রায় চার শতাব্দী পূর্বের প্রটেস্টান্ট ধর্মের প্রবর্তক ও জার্মান দেশীয় ধর্মযাজক মার্টিন লুথারের মতন হ্যানিম্যানকে তৎকালীন গোঁড়া চিকিৎসকদের চিকিৎসা পদ্ধতির নানা প্রকার ভ্রম, কুসংস্কার ও মতবাদের বিরুদ্ধে একাকি দাঁড়াতে হয়েছিল। এজন্য তাকে অনেক লাঞ্ছনা, অনেক নিগ্রহ আর দুঃখ ভোগ করতে হয়েছিল। তথাপি তিনি অচল, অটলভাবে উচ্চকণ্ঠে ‘সদৃশ বিধান মন্ত্রের জয়’ ঘোষণা করে গিয়েছেন।

১৭৫৫ সালের ১০ এপ্রিল বর্তমান জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশের এল্ব নদী তীরবর্তী মিসেন নগরে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হ্যানিম্যান। তার বাবা ক্রিশ্চিয়ান গটফ্রয়েড হ্যানিম্যান জার্মানির মিসেনে মাটির তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় চিনামাটির পাত্রে রঙ-তুলির কাজের দক্ষ শিল্পী ছিলেন।

শিশুকাল থেকেই হ্যানিম্যান অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। বিষয়টি টের পেয়ে পিতা ক্রিশ্চিয়ান পাঁচ বছর বয়স থেকেই প্রতিদিন হ্যানিম্যানকে নির্দিষ্ট সময়ে চিন্তা করার দীক্ষা দেন। সব নিজের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করার বিষয়ে হ্যানিম্যানকে শিশুকাল থেকেই গড়ে তোলেন তিনি।  কোনও কিছু যুক্তিগ্রাহ্য না হলে শুধু বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করো না। অভিজ্ঞতার আলোকে যা সত্য বলে প্রমাণিত হবে, কোনো অবস্থাতেই তা থেকে সরে এসো না। পিতার এ উপদেশকে অনুসরণ করেই হ্যানিম্যান যে কোনো বিষয়কে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গ্রহণ করার নীতি ও রীতি আয়ত্ব করেন।

তবে চরম দারিদ্র্য তার বিদ্যাচর্চার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। স্কুলজীবনে লেখাপড়ার জন্য রাতের বেলা প্রয়োজনীয় বাতির তেলের পয়সা জোগাড় করাও কষ্টকর ছিল তাদের পরিবারের পক্ষে। এ অবস্থায় হ্যানিম্যানের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন তার বাবা। পরে স্কুলশিক্ষক রেক্টর এম মুলার অসাধারণ প্রতিভাবান হ্যানিম্যানকে বিনামূল্যে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন। তার প্রখর মেধার কারণে শিক্ষক মুলার তাকে স্কুলের অন্যান্য ছাত্রকে গ্রিক ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ভার দেন।

হ্যানিম্যান ১৭৬৭ সালের ২০ জুলাই মিসেনের টাউন স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে পাঠ চুকিয়ে বিদেশি ভাষা রপ্ত করতে ১৭৭৪ সালের ২০ নভেম্বর ভর্তি হন কাস্টেন এনডল্যান্ডের স্কুল সেন্ট আফ্রাতে। তিনি খুব অল্প সময়ে ১১টি ভাষায় (জার্মান, গ্রিক, লাতিন, ইংরেজি, হিব্রু, ইতালিয়ান, সিরিয়াক, আরবি, স্প্যানিশ, ফরাসি ও চ্যালডেইক) সুপণ্ডিত হন।  

তবে চিকিৎসাবিদ্যা ছিল হ্যানিম্যানের প্রিয় বিষয়। ১৭৭৫ সালে তিনি লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যা পড়ার জন্য ভর্তি হন। এরপর সেখান থেকে ১৭৭৭ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার লিওপোল্ডস্ট্যাট জেলার ব্রাদার্স অব মার্সি হাসপাতালে চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে যান। সেখানে তিনি হিপোক্র্যাটিস, গ্যালন ও স্টোয়ার্কের লেখাগুলো সম্পর্কে বিশদ ধারণা পান। তিনি তার প্রখর ধীশক্তি, অসাধারণ অধ্যাবসায় ও চারিত্রিক সরলতার দ্বারা তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপক ও চিকিৎসক ডা. কোয়ারিনের প্রিয়তম শিষ্য হয়ে ওঠেন। হ্যানিম্যান তার কাছে হাতে-কলমে রোগী দেখার শিক্ষা পান।

এ হাসপাতালে ৯ মাস থাকার পর হঠাৎ ছাত্রাবাস থেকে হ্যানিম্যানের সব টাকা-পয়সা চুরি হয়ে যায়। এতে তার লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে। তখন ডা. জে ফন কোয়ারিনের সহযোগিতায় তিনি ট্রানসিলভেনিয়ার গভর্নর ব্যারন এস ফন ব্রুকেনহলের সঙ্গে হার্মানেস্ট্যাটে চলে যান। এখানে তিনি গভর্নরের মুদ্রা ও চিত্রকর্মের সংগ্রহশালার তত্ত্বাবধায়ক হয়ে লাইব্রেরিতে ব্যাপক পড়াশোনার সুযোগ পান। ১৭৭৯ সালে তিনি এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে তিনি হোফ্রাথ স্কোবারের কাছে এসে উদ্ভিদবিদ্যার পাঠ নেন। ১৭৭৯ সালের ১০ আগস্ট চিকিৎসাবিদ্যায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি এমডি উপাধি লাভ করেন। এই ডিগ্রি লাভের জন্য হ্যানিম্যান আপেক্ষিক রোগের কারণ ও ইহার চিকিৎসা বিষয়ে ২০ পৃষ্ঠার একটি ছাপানো গবেষণাপত্র পেশ করেছিলেন।

১০ বছর ধরে তিনি অত্যন্ত প্রতিপত্তির সঙ্গে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে তিনি লক্ষ্য করলেন, তৎকালীন চিকিৎসা পদ্ধতি আন্দাজ, অনুমান, ব্যক্তিগত মতামত ও কিছু ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, চিকিৎসার পরও রোগের পুনরাক্রমণ বারবার উপলব্ধি করেন তিনি। এভাবে তিনি ধীরে ধীরে অ্যালোপ্যাথির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। 

তিনি রসায়ন শাস্ত্র অনুশীলন এবং এসব বই অনুবাদ করে জীবিকা অর্জন করতেন। সে সময় চিকিৎসা পদ্ধতি দেখে হতাশ হয়ে বললেন, সব চিকিৎসা প্রথাই কাল্পনিক রোগ প্রতিকারের, প্রকৃত ওষুধ কোথায়? এমন দিনে হঠাৎ তার নিজের ঘরেই রোগের ভয়াল আক্রমণ শুরু হলে নিজের প্রাণাধিক প্রিয় শিশুদের রোগযন্ত্রণা তাকে নতুন এক চিকিৎসার পদ্ধতি আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে একদিন (১৭৯০ সালে) এডিনবার্গের বিখ্যাত অধ্যাপক, শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ ডা. উইলিয়াম কালেনের লেখা চিকিৎসা বিষয়ক বই জার্মান ভাষায় অনুবাদকালে হোমিওপ্যাথির মূল সূত্র আবিষ্কার করেন।

হ্যানিম্যান গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন, যে পদার্থ সুস্থ শরীর যন্ত্রকে বিকৃত করে যেসব যন্ত্রণাদায়ক কৃত্রিম লক্ষণ সৃষ্টি করে, সে পদার্থের সূক্ষ্মমাত্রা বা শক্তিকে ওষুধ হিসেবে প্রয়োগ করলে ওই লক্ষণাদি বিদূরিত করে শরীরযন্ত্রকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে পারে। এ পদ্ধতি অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির মতো জল্পনা-কল্পনা কিংবা অনুমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। টানা ছয় বছর এ পদ্ধতিতে তিনি নানা ওষুধ ও বহুবিধ তরল সেবন করে নিজ দেহের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। এ কাজে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন তার অনেক হিতৈষী।

এরপর তিনি প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির নীতিমালার বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, মানুষের ওষুধ একমাত্র মানবদেহেই পরীক্ষিত হতে পারে; ইঁদুর, বিড়াল, গিনিপিগ, ঘোড়া, বানর কিংবা কোনো প্রাণীর ওপর নয়।  তিনি তার এই বৈপ্লবিক চিকিৎসা পদ্ধতির নাম রাখলেন হোমিওপ্যাথি।

১৮১০ সালে প্রকাশ করেন অমর গ্রন্থ অর্গানন অব মেডিসিন। এ গ্রন্থের মাধ্যমে হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথি নামটি প্রকাশ করেন। অর্গাননের অর্থ হলো আরোগ্য সাধন। এ গ্রন্থে তিনি হোমিওপ্যাথির নীতিগুলোকে সূত্রবদ্ধ করেন। এতে রয়েছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সম্পর্কিত ২৯১টি সূত্র। এটি এমন গ্রন্থ বিশেষ যার মাধ্যমে দার্শনিক তত্ত্ব, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারের নীতিমালার নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে।

১৮১১ সালে হ্যানিম্যান বিখ্যাত গ্রন্থ মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তিনি সুস্থ মানবশরীরে পরীক্ষিত প্রতিটি ওষুধের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ১৮১৭ সালে তিনি রেপাটারিয়াম নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতে তিনি চিকিৎসা ক্ষেত্রে ওষুধের বাছাই ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে আলোচনা করেন। ১৮১১-১৮২০ সাল পর্যন্ত তিনি লিপজিগে প্রকাশ্যভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা চালিয়ে যান। বিভিন্ন ভাষায় বুৎপত্তির জন্য লিপজিগে তার সম্মান বর্ধিত হয়। কিন্তু পুনরায় অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের ষড়যন্ত্র রাজরোষে পতিত হন। ১৮১৯ সালে সর্বসাধারণ্যে প্রচারের জন্য মেডিকেল ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এরপর তিনি আনহ্যান্টিকিথেনে চলে যান। ১৮২১ সালে তিনি কিথেনের ইফারথ, অর্থাৎ কোটের কাউন্সিলর উপাধি পান। মূলত এ সময় থেকেই হোমিওপ্যাথিক জয়যাত্রা শুরু হয়।

বহু অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকের হোমিওপ্যাথির ওপর ভক্তি বাড়তে থাকে। তখন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত চিকিৎসক কোয়েন হোমিওপ্যাথির অসারত্ব প্রমাণ করতে এসে হ্যানিম্যানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং স্বদেশ ফিরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন। ১৮২৮ সালে হ্যানিম্যান ক্রনিক ডিজিজেস নামক গ্রন্থটি চার খণ্ডে প্রকাশ করেন। এতে তিনি চিররোগের কারণ, তাদের স্বরূপ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ১৮২৯ সালে কেবল সংবাদপত্রে কলেরা রোগের লক্ষণগুলো পাঠ করে হোমিওপ্যাথিক মতে এর চিকিৎসা প্রচার করে সেই মতে বহুরোগী আরোগ্য লাভ করে। এতে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা আরও একবার প্রমাণ করেন হ্যানিম্যান। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Hahnemann homoeopathy)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours