তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
সে যুগে সমাজের নেতৃস্থানীয়া মহা মাননীয়া মিস্ ইডেনের উদ্দেশ্যে দ্বারকানাথ এখানে একটি নৈশ ভােজ এবং নৃত্যোৎসবের আয়ােজন করেন। এ উৎসবটি ছিল উৎসবকর্তা এবং অভ্যাগত উভয়ের পথেই পরিতৃপ্তিদায়ক। এ উৎসব উপলক্ষে কক্ষ গুলাে করা হয়েছিল আলােকোদ্ভাসিত, দর্পণের প্রতিবিম্বে উজ্জ্বল। মির্জাপুর কার্পেট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কক্ষে কক্ষে, বুটিদার রক্তিমাভ কাপড় এবং সবুজ সিল্কের সমারােহে কক্ষ গুলাের উৎসব-সজ্জিত রূপ ছিল অনিন্দ্য। টেবিলগুলাের ওপরের আচ্ছাদন ছিল তে পাথরের। তাতে শােভা পাচ্ছিল বর্ণবৈচিত্রময় পুষ্পস্তবক। দুষ্প্রাপ্য বহু অর্কিড, বিচিত্রভাবে শােভিত ছােট ছােট ঝােপ ও লতাপাতা দিয়ে সাজনাে হয়েছিল সিঁড়ি, বারান্দা, বৈঠকখানা এবং কেন্দ্রস্থিত প্রশস্ত হলঘর। গ্রীষ্মবাস এবং ঝুলন্ত সেতুটিকে সজ্জিত করা হয়েছিল লতাপাতা, পুষ্প, দেওদার পাতা ও বহু বর্ণ-বিচিত্র পতাকা দিয়ে। প্রাঙ্গন এবং জলসরবরাহের কেন্দ্রটি আলােকোজ্জ্বল করা হয়েছিল হাজার হাজার অলঙ্কৃত বাতি দিয়ে। সেকালের জনৈক লেখক উৎসব-স্থানটির বর্ণনা করেছেন। ইন্দ্রপুরীর দৃশ্য বলে। হলঘরটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল মধুর সঙ্গীতে, বহু রাত্রি পর্যন্ত উৎসবের নৃত্য চলেছিল সমানভাবে। সেদিনের রাত্রির মত এত চমৎকার বাজি পােড়ানাে ভিলায় আর দেখা যায়নি। কলকাতার সমস্ত অভিজাত সম্প্রদায় উপস্থিত ছিলেন সে রাত্রির উৎসবে। অভূতপূর্ব আড়ম্বরের মধ্যে সে রজনীর উৎসব সমাপ্ত হয়েছিল।”
তৎকালে প্রচলিত একটি ব্যঙ্গাত্মক ছড়ার মধ্যেও বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে আয়ােজিত আমােদ-অনুষ্ঠানের খ্যাতির পরিচয় পাওয়া যায়, “বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুঁরি কাটারি ঝঝনি, খানা খাওয়ার কত মজা, আমরা তার কি জানি? জানেন ঠাকুর কোম্পানী।”
আমােদ উৎসবে টাকা ওড়ানাের প্রতিযােগিতায় ইংরেজ নবাবরা দেশীয় বাবু নবাবদের তুলনায় পিছিয়ে ছিলেন না। তারাও উৎসব উপলক্ষে নাচগানের আসর বসাতেন এবং লক্ষ টাকার আতসবাজীর খেলা দেখানাে হত। ১৮০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আতসবাজীর খেলার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায়—
জীবিকা নির্বাহের জন্য রাজা রামমােহনের অর্থোপার্জনও সর্বাংশে সুস্থ ও নিষ্কলঙ্ক ছিল না বলে কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিশােরীচাঁদ মিত্রের মতাে সেকালের বিধাসযােগ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রচলিত জনরবের প্রতি অঙ্গুলি সঙ্কেতে বলেছেন যে, সেকালের অন্যান্য বাঙালি দেওয়ানের মতাে রাজা রামমােহনও সরকারি কর্মে লিপ্ত থাকাকালীন উৎকোচ গ্রহণ করে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। ক্যালকাটা রিভিউ’তে কিশােরীচাঁদ মিত্র লিখেছেন,
“দেওয়ান হিসাবে কাজ করে তিনি এত টাকা উপার্জন করেছিলেন, যাতে ‘বছরে দশ হাজার টাকা আয়ের জমিদার হতে পেরেছিলেন। একথা সত্য হলে এই অসাধারণ মানুষটির নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহ জাগে।” এ সম্পর্কে কে.এস. ম্যাকডােনাল্ড বলেছেন, “দেওয়ান হিসাবে দশবছরের চাকরিজীবনে তিনি এত টাকা সঞ্চয় করেছিলেন, যা দিয়ে তিনি বার্ষিক ১০০০ পাউণ্ড অথবা মাসিক ১০০০ টাকা আয়ের সম্পত্তি কিনেছিলেন। এই ঘটনা তার খ্যাতি বৃদ্ধির সহায়ক হয়নি। তাছাড়া সলােমনের মতাে না হয়ে ধন-উপার্জন ও সম্পদ রক্ষা করাকে জীবনের লক্ষ বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন, এমনকি সেটাকে জ্ঞানের কাছে দ্বিতীয় স্থান পর্যন্ত দেননি।”
উপরের বিষয়গুলি মনে রেখে রাজা রামমােহনের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তার কর্মপ্রয়াস সম্পর্কে আলােচনা করলে তাঁর মূল্যায়ন যথার্থ ও ইতিহাস-সম্মত হবে। কারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা ও চরিত্র তার মতামত ও কর্মপ্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করে। পােষাক-পরিচ্ছদ, জীবনযাত্রা জীবিকা নির্বাহ বিষয়ে শহরের অন্যান্য ধনিক বাবুদের সঙ্গে রাজা রামমােহনের কোনাে প্রভেদ ছিল না। তিনি এদের মতাে পােষাক-পরিচ্ছদ, এদের মতাে জীবনযাত্রা এবং এদের মতাে কোম্পানির কাগজ, ভূসম্পত্তি ও নানারকম আয়ের (জ্ঞাত ও অজ্ঞাত) উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তবে রামমােহন শিক্ষাদীক্ষায় এদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিলেন। দেওয়ানি লাভের পূর্বে তিনি আরবি-ফারসি ও সংস্কৃত শাস্ত্র গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। জন ডিগবির দেওয়ান রূপে রংপুরে থাকা কালে রামমােহন ইউরােপীয় ইতিহাস-বিজ্ঞান-দর্শনের বহু গ্রন্থ পাঠ করেন এবং বিধের বিভিন্ন দেশসমূহের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কিত বহু গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। বেন্থাম, হিউম, রিকার্ডো, জেমল মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমূখ সেকালের শ্রেষ্ঠ ইউরােপীয় চিন্তাশীলদের রচনাবলী পাঠে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন।
কলকাতায় ও ইংল্যাণ্ডে বসবাস কালে রাজা রামমােহনের বিভিন্ন কর্মপ্রয়াসের মধ্যে তাদের প্রভাব অনুভূত হলেও তা সামন্ত-স্বার্থের জন্য খণ্ডিত ও পরস্পর-বিরােধী ছিল। উল্লেখ্য, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাই সে যুগের কলকাতার নব্য ধনী পরিবারে বাঈ নাচের প্রচলন। আশুতােষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, “অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেসকল নৃত্য উত্তর ভারত অঞ্চল হইতে বাংলাদেশে প্রসার লাভ করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে…বাঈজী নাচ অন্যতম। যতদূর জানা যায়, বাঈ নর্তকীরা কলকাতায় এসেছিলেন উত্তর ভারত থেকে। যেহেতু মহারাষ্ট্রে মহিলাদের উপাধি বাঈ, তার থেকেই অনুমিত হয় যে এই নর্তকীরা মহারাষ্ট্র থেকে আগত। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ লিখেছিল বাইদিগের নৃত্য মহারাষ্ট্রীয়।…
বাঈজীদের মধ্যে যাঁরা তদানীন্তন ইউরােপীয় পর্যটকদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছিলেন তারা অধিকাংশই গায়িকা রূপে পরিচিতা। রামমােহন রায় প্রভৃতি বাঙালি ধনী পৃষ্ঠপােষকদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত ইউরােপীয় শ্রোতারা ‘নিকী’-র কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তখনকার ইতালীয় অপেরা গায়িকা অ্যাঞ্জেলিকা ক্যাটলানি (১৭৮০-১৮৪৯) ও জার্মান গায়িকা এলিজাবেথ বিলিংটন (১৭৬৮-১৮১৮)-এর তুলনা করতেন। এই দুই ইউরােপীয় গায়িকার মতাে ‘নিকী’র গলা খেলত উচ্চ সপ্তকে।
শােভাবাজারের রাজকৃষ্ণ দেব, জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার, সিমলের দে-রা দুর্গাপূজার সময় এইসব বাঈজী নর্তকীদের দৈনিক ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রণামী দিয়ে নিযুক্ত করতেন। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে, এইসব রাজা-রাজড়ারা আর ছিলেন না, ওইসব বাঈজী নর্তকী ও তাদের বংশধরেরা তখনও কলকাতায় আসর জমিয়ে বসে ছিলেন। দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্তে আগমনে’ (১৮৮৯) খবর পাচ্ছি তখনকার দিনের ‘বাঈওয়ালির মধ্যে ইলাহিজান…বিখ্যাত’। সঙ্গে সঙ্গে যােগ করা হচ্ছে— “খেমটাওয়ালিদের মধ্যে হরিদাসী ও কামিনী বিখ্যাত।” পৃথকীকরণের চেষ্টাটা লক্ষণীয়। পুজোয় এবং বিবাহ উপলক্ষে, গ্রামাঞ্চলে জমিদার ও ধনীগৃহে এ শতাব্দীর শুরুতেও এঁদের বায়না দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতাে। যদিও ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা খেমটার সঙ্গে সঙ্গে বাঈ নাচেরও বিরােধিতা করতেন।
পলাশি যুদ্ধের পর দুর্গাপুজো উপলক্ষে শােভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ তৈরি করিয়েছিলেন আদি রাজবাড়ির সঙ্গে আদি-ঠাকুরদালান। আর সেই সঙ্গে তৈরি করিয়েছিলেন একটা নাচঘর, যেখানে বসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ক্লাইভরা বাঈ-নাচ দেখে কৃতার্থ হয়েছিলেন। রেভারেন্ড ওয়ার্ডের বিবরণীতে একটা জিনিস লক্ষণীয়—শােভাবাজারের রাজকৃষ্ণদেব, যিনি বাবা নবকৃষ্ণের মত, একদিকে অভিজাতবর্গের বিনােদন—বাঈ নাচের পৃষ্ঠপােষক। আবার একই সঙ্গে নিম্নবর্গের জনপ্রিয় কবিগান অনুষ্ঠানেরও উদ্যোক্তা। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Baiji babu culture)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours