তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

সোনাগাজীর নামকরণ হয়ে গেল সোনাগাছি। কিন্তু কলকাতার ইতিহাসবিদরা কেন নীরব এই ইতিহাসের খোঁজে। দুই একজন ছাড়া। তারা কি অশ্লীলতার ভয়ে আতঙ্কিত ছিলেন। ইতিহাসের লক্ষ্য তো সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা।

অথচ, সোনাগাজী দিব্বি একজন রক্তমাংসের ঐতিহাসিক চরিত্র। তাঁর মাজার বা মসজিদটি এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। ‘আলালের ঘরে দুলাল’-এ যে মাজার ও মসজিদের কথা বেশ বিস্তারেই বলেছেন টেকচাঁদ ঠাকুর তথা প্যারীচাঁদ মিত্র। এবং এহেন বিখ্যাত ব্যক্তির নামই কেন পরিণত হল একটি স্থান নামে। এমনই এক অঞ্চলের নাম, যাকে নিয়ে কলকাতাবাসীর আজও কৌতূহল, ফিসফিসানি, ঢাকঢাক গুড়গুড়, নাক কোঁচকানোর শেষ নেই। যেন এই নাম বললেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। ভারতবর্ষের সবচাইতে বড়ো ‘নিষিদ্ধ পল্লি’ বলে কথা! সবাই চেনে, তবু এই নাম যেন যত্রতত্র নিতে নেই। আসলে গণিকাদেরকেই বা ভালো চোখে দেখে!‘

‘কলকাতার অনেক তাবড় তাবড় মানুষের গোপন কম্মের হদিশ জানা এই গণিকাপল্লি নিয়ে তাই নিশ্চুপ ছিলেন অনেকেই। রাধারমণ মিত্রর ‘কলিকাতা-দর্পণ’-এ তাই সোনাগাছির নামটাই নেই। ১৯১৫ সালে লেখা হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইতেও সোনাগাছির হদিশ মিলবে না। প্রাণকৃষ্ণ দত্তর মতো কলকাতাবিদও ছিলেন অবশ্য। সোনাগাজী তথা সোনাগাছির নামকরণের ইতিহাসটির ওপরেও স্পষ্ট আলো ফেলেছেন তিনি। পরে এই অঞ্চল নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। যৌনতা, যৌন পেশা নিয়ে অনেক খোলামেলা কথা বলতে শিখেছে শহর। কিন্তু, ওই ফিসফিসানিটা যে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে, তা বলা যাবে না। 

এহেন সোনাগাছির নামকরণের ইতিহাস নিয়ে কিন্তু কোনও দ্বন্দ্বের ফিসফিসানিও নেই। প্রায় সবাই একমত, সোনাগাজীর মাজার সন্নিহিত অঞ্চল বলেই এমন নাম। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত লিখছেন, “ঐ স্থানে সোণাউল্লা নামক এক দুর্দান্ত মুসলমান বাস করিতেন। লাঠালাঠি, মারামারি, রাহাজানি-লুঠতরাজই তাঁহার উপজীবিকা ছিল। সোণাউল্লার বাটীর সম্মুখস্থ পুষ্করিণী পাড়ে তাঁহার কবর হইয়াছিল। অবশ্য মৃত্যুর আগেই তিনি পীর বা গাজী হইয়াছিলেন।” (মূল বানান অপরিবর্তিত)।

যদিও, সোনাগাজীর চরিত্র নিয়ে প্রাণকৃষ্ণ দত্তর মন্তব্যে অতি আরোপ চোখ এড়ায় না। সে যাহোক, সোনাগাজী থেকেই সোনাগাছি নামোদ্ভবের তত্ত্ব খারিজ করেননি প্রায় কেউই। অসিত দাস অবশ্য বলছেন, ‘সোনা’ শব্দটি ‘শণ’ থেকেও আসতে পারে। শণগাছি ক্রমে শোনাগাছি হয়ে লোকমুখে সোনাগাছি হয়েছে। সোনাগাজীর নাম শণগাছি একাকার হয়ে গেছে এই নামে—হতে পারে এমনটাও। তবে, নামকরণের মূলে সোনাগাজীর মাজারের অস্তিত্বটাই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

সোনাগাজীর মাজার ছাড়িয়ে সোনাগাছি পল্লির পরিধি ক্রমে বেড়েছে। এখন তার অবস্থান চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, শোভাবাজার ও বিডন স্ট্রিট ক্রসিং-এর কাছে। এমনিতে, সম্ভ্রান্ত বাইজিদের পাড়া হিসেবে বৌবাজারের খ্যাতিও বেশ পুরোনো। বৌবাজারে বাইজি-কোঠির পাশাপাশি ছিল বে^...শ্যাপল্লিও। কিন্তু, তারপরেও সোনাগাছি গড়ে উঠল কলকাতার সবচাইতে বড়ো গণিকাপল্লি হিসেবে। অনেকে বলেন, এই অঞ্চল সম্ভ্রান্ত গণিকাদের ঠিকানা ছিল না কোনদিনই। গরিব, শ্রমজীবী মানুষদের কামনাকেই সে নির্বিচারে গ্রহণ করেছে বরাবর। আর সেটাই নির্মাণ করেছে সোনাগাছির ‘শ্রেণিচরিত্র’। 

যদিও, এই ইতিহাসেও খানিক সরলীকরণ রয়েছে। আঠারো ও উনিশ শতকের বাঙালি বাবুরা নিজেদের উপপত্নী তথা রক্ষিতাদের থাকার ব্যবস্থা করতেন সোনাগাছিতেই। উচ্চবিত্ত, সম্ভ্রান্ত মানুষদের জন্য পৃথক ঠিকানাও ছিল এই পল্লিতে। সাহেবদের আনাগোনাও ছিল ভালোই। এই অঞ্চলের বেশকিছু বাড়ির বাহারি স্থাপত্য চোখ এড়ায় না। সেইসব পুরোনো প্রাচুর্যের দলিল। এবং এরই পাশে ছড়িয়ে রয়েছে অবশিষ্ট বিশাল পল্লি। বাংলার প্রতিটি দুর্ভিক্ষ, মড়ক, প্রাণঘাতী বন্যায় জনসংখ্যা বাড়ে সেখানে। অন্য প্রদেশ থেকেও উজিয়ে আসে অনেকে। শিকড়হীন, অভাবে ধুঁকতে থাকা, পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েগুলি এরপর এই পল্লির ইতিহাসের পাতা বাড়িয়ে তুলতে থাকে। আর ইতিহাসবিদরা সেই পাতা উলটে দেখান, একসময়ে ফ্রান্সের সম্ভ্রান্ত গণিকামহলেও কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সোনাগাছির খ্যাতি।       

কলকাতা বাড়তে বাড়তে প্রায় মেগালোপলিস। শহর বাড়লে ক্ষুধাও বাড়ে। ক্ষুধার উল্টোপিঠেই অভাব। ক্ষুধারও রকমফের। এই বেড়ে চলার নামতা বেশ ভালো বোঝে সোনাগাছি। এই শহরের অনেক গোপন ইতিহাস লিখতে পারে সেও।

সোনাগাছি উত্তর কলকাতার মার্বেল প্যালেসের উত্তরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, শোভাবাজার ও বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলের নিকটে অবস্থিত। ... তবে সোনাগাছির পথ চলা প্রথম শুরু হয়েছিল বোধহয় উনিশ শতকেই। তখন সময় ছিল ইংরেজদের শাসনের। ইতিহাস বলছে গোটা ভারতকেই তখন আস্তে আস্তে দখল করার পথে এগোচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

সোনাগাজীর নাম থেকেই নামকরণ সোনাগাছির, চিৎপুরের গাজী ও এক বিলুপ্ত মসজিদের গল্প সোনাগাজীর জীবনকাল কেটেছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে। লাঠালাঠি আর মারামারি করে। মৃত্যুর পর গাজী হয়েছিলেন। আর সেই গাজীর স্মৃতিতেই তাঁর বৃদ্ধা মা তৈরি করেছিলেন একটি মসজিদ। সোনাগাজীর মসজিদ। সোনাগাজীর কাছ থেকে ওষুধ পেতে ভিড় করতেন অন্ধ, খোঁড়া, কুষ্ঠরোগী ধনী, দরিদ্র সকলেই। পুরনো কলকাতার চিৎপুর অঞ্চলে রীতিমতো বিখ্যাত ছিল এই মসজিদ। তাঁর থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে উঠেছিল সোনাগাজী। পরে বিকৃত হয়ে দাঁড়ায় সোনাগাছি। কলকাতার সবচেয়ে বড়ো নিষিদ্ধপল্লি। সরস্বতী পুজোর ধুমধাম শুরু নিষিদ্ধপল্লীতেই, বঙ্কিম-হুতোমের ব্যঙ্গের শিকার কলকাতার বাবুরা এই গল্পের সময়কাল সঠিক বলতে পারেন না কেউই। কবে মসজিদ তৈরি হয়েছিল, সোনাগাজী কবে কলকাতায় এসেছিলেন তার কোনও সময়ের হিসাব নেই। কলকাতা এবং সুতানটি দুই পরগনাতেই তখন বহু মুসলমানের বাস। তার মধ্যেই ছিল সোনাগাজীর বাড়ি। আসল নাম সোনাউল্লা শাহ চুস্তি রহমতুল্লাহ আলে। সেই দস্যু সোনা একদিন মারা গেলেন। শোকে বিহ্বল তাঁর বৃদ্ধা মা। সোনা কিন্তু মাকে ছেড়ে গেলেন না। একদিন মাকে এসে বললেন, মৃত্যুর পর গাজী হয়েছেন তিনি। এখন থেকে ওষুধ দিয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচাবেন। আর যে তার দরগায় সিন্নি চড়াবে, তার উপকার হবে।

দ্রুত এই কথা ছড়িয়ে গেল। ভিড় জমতে শুরু করল সোনাগাজীর বাড়িতে। আর বন্ধ দরজার ভিতর থেকে অদৃশ্য সোনাগাজী প্রত্যেকের জন্য ওষুধ বলে দিতে লাগলেন। কারোর ওষুধ পাওয়া গেল পুকুরের জলে, কারোর ওষুধ বাড়ির পিছনে।কারোর কারোর উপর আবার ভারি চটে যেতেন তিনি। মাকে বলতেন তার সিন্নি ছুঁড়ে ফেলে দিতে। এভাবেই দিন কাটতে লাগল। সোনাগাজীর নামে বিরাট এক মসজিদ তৈরি করলেন তাঁর বৃদ্ধা মা। চিৎপুর এলাকার ল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠল সেই মসজিদ। এখন অবশ্য সেই পুরনো মসজিদ আর নেই। তবে মসজিদের নামেই রাস্তার নাম মসজিদবাড়ি স্ট্রিট। সোনাগাজীর মা মারা যাওয়ার পর সব অলৌকিক কাণ্ড থেমে গেল। তবে সোনাগাজীর নাম থেকে গেছে। কিছুটা বিকৃত হয়ে এখন সোনাগাছি।

এমনই সব মিথ জড়িয়ে আছে সোনাগাজীর নামের সঙ্গে। কিন্তু সোনাগাজীর এসব কিংবদন্তি অনেকেই বিশ্বাস করেন না। এমনকি মসজিদের অনেক ইমামও বিশ্বাস করতেন না। তার দাঙ্গা-হাঙ্গামার যে সব গল্প শোনা যায়, তাতেও অবশ্য অতি-আরোপ চোখে পড়ে। অনেকের মতে, সোনাউল্লা শাহ এসেছিলেন ইরান থেকে। তিনি ছিলেন একজন দরবেশ। সুদর্শন মানুষ। অসাধারণ ঘোড়সওয়ার ছিলেন। আর ইরান থেকে নিয়ে এসেছিলেন প্রচুর সোনা আর টাকা পয়সা। এদেশে এসেছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য। নানা জায়গায় ঘুরে বেছে নিয়েছিলেন এই পুরনো কলকাতাকেই। চিৎপুর অঞ্চলে তখন কয়েক ঘর মুসলমানের বাস। সেইসঙ্গে ছিল একটি পুকুর ও তার পাশে কবরস্থান। সেই পুকুরের পাড়েই মসজিদ তৈরি করেন তিনি। একটা বিরাট গম্বুজকে ঘিরে চারটে সুদৃশ্য মিনার। ভিতরে প্রচুর সূক্ষ্ম কারুকার্য। সারা গায়ে ইরানি স্থাপত্যের প্রভাব। সেই মসজিদেই ছিল তাঁর কবর।

পুরনো সেই মসজিদ ভেঙে পড়ে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায়। পাশের পুকুরটিও আর নেই। সেই পুকুর বুজিয়ে তৈরি হয়েছিল আস্তাবল। এখন সেখানে বাজার। চিৎপুরের পরিচিত অ্যালেন মার্কেট। তবে এসবের মধ্যেও সোনাগাজীর কিংবদন্তি কিন্তু থেকে গেছে। কতদিন থাকবে, তা অবশ্য বলা যাচ্ছে না। কলকাতার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা এমনই সব ইতিহাস ও জনশ্রুতিকে আজকাল আমরা আর কতটুকুই বা মর্যাদা দিই? তবে এসবের মধ্যেই তো খুঁজে পাওয়া যায় কলকাতাকে, তার পুরনো হৃদস্পন্দনকে…

বাই বারঙ্গনা গাঁথা বইটিতে দেবজিত বন্দোপাধ্যায় বলছেন, "গান শেখাতে এসে ‘শিক্ষিতা পতিতা’ মানদা দেবীকে ওস্তাদ বলেছিলেন, “তোমার ব্রহ্ম সঙ্গীত অথবা স্বদেশী গান তো এখানে চলবে না। লপেটা, হিন্দি গজল অথবা উচ্চ অঙ্গের খেয়াল ঠুংরি এ সব হল বেশ্যা মহলের রেওয়াজ। কীর্তনও শিখতে পার।”

আঠারো শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ার দুই-তিনটি দশক, প্রায় দেড়শো বছর কলকাতায় বে^...শ্যা-বাইজিরা ছিলেন সঙ্গীত-সংস্কৃতির ধারক বাহক। তাঁদের গানের ভাণ্ডার ছিল ধ্রুপদ থেকে খ্যামটা, বাউলাঙ্গ থেকে কৌতুকগীতি। মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের বহু গীতিকার ব্যবহার করেছেন সোনাগাজী তথা সোনাগাছি থেকে পাওয়া গানের পংক্তি। এই বইটিতে সংকলিত ছ’শোরও বেশি গান এই বিস্তারের নিদর্শন। সমাজ সম্মান করেনি, কিন্তু তাঁদের পারদর্শিতাকে কাজে লাগিয়েছে বিনোদনে, শিল্পের নির্মাণে। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, কে না মুগ্ধ হয়েছেন এঁদের প্রতিভায়।

(www.theoffnews.com - Sonagachi Sonagazi)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours