তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

একদম প্রথম দিকে বাইজিরা থাকতেন চিৎপুরে। ওয়াজেদ আলী শাহ প্রথম চিৎপুরে বাইজিদের থাকার ব্যবস্থা করেন। ভারত থেকে ঢাকায় ‘মুজরা’ করতে আসা বাইজিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন—গওহর জান, নূরজাহান, মালকা জান, সিদ্ধেশ্বরী, জানকি বাই (ছাপ্পান ছুরি), জদ্দন বাই (ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী নার্গিসের মা), কোহিনূর ও ইন্দুবালা। 

উনবিংশ প্রথম ৩৫ বছরের মধ্যে যে বিখ্যাত বাইজিদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন, নিকি বাই, অসরুন জিন্নাত, বেগম যান, মির্জা যান, হিরা বুলবুল, গহরজান, মালকাজান, এরকম অনেকেই।

১৮২৩ সালে মিস ফানি পার্কস রাজা রাম রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতে নিকি বাইজির নাচ দেখেছিলেন। তবে উনবিংশ শতাব্দীর  এক সুপ্রসিদ্ধ গায়িকা ছিলেন হিরা বুলবুল। অসামান্য কন্ঠ মাধুর্যের জন্য বুলবুল শব্দটা তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। তিনি অন্যান্য বাইজিদের মতো ধ্রুপদ গাইতেন। এরা সব রীতি মত ট্রেনিং প্রাপ্ত শিল্পী।

হিরা বুলবুল থাকেন বউবাজার অঞ্চলে। তবে একদম প্রথম দিকে এই বাইজিরা ছিলেন চিৎপুরে। সেকালের কলকাতায় হিরা বুলবুল সামাজিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ গ্রন্থে এই বিষয়ে আলোকপাত করেন।

হিরা আপন পুত্ৰকে (পালিত কী আপন সন্তান জানা নেই) হিন্দু কলেজে ভর্তি করার চেষ্টা করেন। এই নিয়ে তুমুল বাদানুবাদ, ঝগড়া হয়। এটাকে আন্দোলন বললে ভুল হবে না। কলেজটার নাম হলো হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ। ঠিকানা ৭৭ নম্বর চিৎপুর রোড। তবে হিন্দু শিক্ষকদের অনৈক্যের জন্য এই কলেজটি ১৮৫৮ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

বুঝুন অবস্থাটা বাইজির মেয়ে বলে কলেজে ভর্তি হতে পারবেন না। তবে হিরা বুলবুল সমর্থন পেয়েছিলেন অনেক তবে তাঁর বিরোধীরা অনেক বেশী এবং শক্তিশালী ছিলেন।

একটা অদ্ভুত ঘটনার উল্লেখ করি। সেকালের স্বনাম ধন্য মৃদঙ্গ বাদক গোলাম আব্বাস ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের খুব প্রিয় মানুষ। তিনি গোলাম আব্বাসকে অনুরোধ করেন হিরা বুলবুলের সাথে বাজাবার জন্য। গোলাম আব্বাস রাজি হননি।কারণ বাইজির সাথে বাজালে তাঁর মর্যাদা কমে যাবে তাছাড়াও এটা তাঁর ঘরানার অপমান। পরে অনেক অনুরোধ করার পর তিনি রাজি হলেন।

হিরা বুলবুল সেটা বুঝেছিলেন এবং কূট লয়ে ধ্রুপদ গান ধরলেন। গোলাম আব্বাস কোথায় সোম বুঝতে পারলেন না। শুধু ব্যর্থ হলেন তাই নয় তিনি এত অপমানিত হলেন যে ওই আসরেই উনার মৃত্যু হলো। এই ঘটনাটা হয়েছিল শোভাবাজার রাজবাড়িতে। এরকম অনেক গাইয়েরা বিপদে পড়তেন যারা হিরা বুলবুলকে চ্যালেঞ্জ করতেন।

এই বাইজিরা থাকতেন মূলত বউবাজার, বাগবাজার, পাইকপাড়ায় আর বেলঘড়িয়াতে। সারা কলকাতাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। একটা প্রবাদ লোকের মুখে মুখে চল পানসি বেলঘড়িয়া। নব্য বাবুরা নৌকা করে যেতেন বেলঘড়িয়াতে।

নগেন্দ্রনাথ ঘোষ বলছেন, কলকাতায় বাইজি নাচের প্রবর্তক রাজা নবকৃষ্ণ দেব। তাঁর ইংরেজ আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। সে ভালো। এই নবকৃষ্ণই ছিলেন কবিয়াল হরু ঠাকুর ও নিতাই দাসেরও পৃষ্ঠপোষক। তাঁর সভায় বাইজি নাচের আয়োজন হত ‘এলিট’ সাহেব-সুবো আর বাবুদের জন্য। কবিগানের দরজা সেখানে সাধারণের জন্যেও খোলা।

জোড়াসাঁকোর ধারে’-তে সরস্বতী বাইজির গান শোনার স্মৃতি উপুড় করছেন অবনীন্দ্রনাথ। শুনে অবাক লাগতে পারে, বাইজির গান শুনবেন অবন ঠাকুর! তাও, এক রাতে তিনশো টাকা দিয়ে! মাত্র দুটি গান গাইবেন সরস্বতী। নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথও এহেন সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ চেপে রাখেননি— “অবনদা, করেছ কী! তিনশো টাকা জলে দিলে?” এদিকে শ্যামসুন্দর এসে জানালেন, টাকার সঙ্গে দু’বোতল ব্র্যান্ডিও চাই সরস্বতীর। ব্র্যান্ডি না খেলে তিনি নাকি গাইতেই পারেন না। অবনীন্দ্রনাথ তাতেও রাজি। গান তিনি শুনবেনই। সরস্বতী গাইতে শুরু করলেন রাত দশটায়। একটা গানেই এগারোটা বাজল। অবনীন্দ্রনাথ লিখছেন— “এক গানেই আসর মাত। গানের রেশে তখনও সবাই মগ্ন। সরস্বতীবাই বললেন, ‘আওর কুছ ফরমাইয়ে।” তাঁকে এরপর একটা ভজন গাইতে বললেন অবন ঠাকুর। সরস্বতী গাইলেন ‘আও তো ব্রজচন্দলাল।’ মুগ্ধতার মীড়ে আরো একবার টান পড়ল। অবনীন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি করে ছবি এঁকে রাখলেন তাঁর। গান শেষ, বাই উঠে পড়লেন। অবনীন্দ্রনাথের মনে হল, দু’খানা গানের জন্য তিনশো টাকা দেওয়া সার্থক।

এই ঘটনা আগের শতাব্দীর। তার ঢের আগে থেকেই ইংরেজদের আদরে বাঁদর হয়ে তিলে তিলে কলেবরে বেড়ে উঠেছিল কলকাতা। তখন তার এক পা বাংলার গ্রাম্য শিকড়ে, অন্য পা আধুনিকতার গেড়োয়। সাদা চামড়ার বেনিয়াদের পাশাপাশি কালো চামড়ার বাবুতেও এ শহর ভরে উঠল ক্রমশ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষজন এল ভাগ্য ফেরাবার আশায়। হাজারো রুচি তাদের। গেঁয়ো সংস্কৃতি আর নব্য আধুনিকতার। বাইজিরা ছিলেন  অসামান্য গায়িকা এবং নর্তকী। লোকজন মনে করেন, তাঁরা নষ্ট মেয়েমানুষ। অথচ, তাঁদের গান ফেলতেও পারে না সভ্য সমাজ। চটুল নাচ-গান নয়, উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় ঘরানার সংগীত। বাবুরা তো বটেই, সাহেব-সুবোরাও সেই গানে বুঁদ। অবনীন্দ্রনাথের ওই মুগ্ধতার ইতিহাস এভাবেই রচিত হয়েছে এক শতকেরও বেশি সময় ধরে।

বাইজিরা আসলে সাবেক কলকাতার একটি দ্বন্দ্বের জায়গা। তাঁদের কোন দলে ফেলা হবে? একদিকে তাঁদের উচ্চাঙ্গের গান-নাচের কদর। অন্যদিকে চরিত্র নিয়ে ফিসফাস, বে^...শ্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাজে প্রান্তিক করে রাখা। এই দুইয়ের মাঝে বিস্ময়ের সেতুও গড়া হয়েছে অনেকবার। সেইসবই মোহর বুনেছে নানা গল্পে। 

পাজি ‘সঙের দল’ আর সেকেলে কলকাতা মোদ্দায় বলা চলে, আঠেরো শতকের মাঝামাঝি থেকেই বাইজিদের গান ভেসে বেড়াচ্ছিল কলকাতার নানা কোঠাতে। এহেন ‘নষ্ট মেয়েমানুষ’ বাইজিদের নাচ-গানের পরে সেই কবিগানকে ঘোর অশ্লীল মনে হয়েছিল রেভারেন্ড ওয়ার্ডের। ১৮০৬ সালে শোভাবাজারের রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের বাসায় তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাই নাচ দেখতে। এই আয়োজন বাছাই করা মানুষদের জন্য। ভোররাতে বাই নাচের পরে শুরু হল হরু ঠাকুর আর নিতাই বৈরাগীর কবিগান। বন্ধ দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হল সাধারণের জন্য। পিলপিল করে ঢুকল লোক। আর, শুরু হল অশ্লীল কবিগান। রেভারেন্ড ওয়ার্ডের মনে হল, বাইজি নাচের একদম বিপরীত মেজাজের অনুষ্ঠান এসব। 

বিলিতি সাহেব, দিশি বাইজি, ১৮০০ সাল, অথচ, কবিয়ালরা সমাজের মূলস্রোতে গৃহীত আর বাইজিরা ‘নষ্ট মেয়েমানুষ’। কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ রায়ের ‘মোকাম কলিকাতা সরকার’ হিসেবের খাতা (১৮২০-২১ সাল) থেকে জানা যায় বাইজিদের আবাস মোটামুটিভাবে বউবাজার-কেন্দ্রিক। এবং এই বউবাজারেই ছিল নিষিদ্ধপল্লিও। সেখানে দ্বারকানাথ ঠাকুরের আত্মীয়র নিজস্ব কোঠাও ছিল দু’খানা। ২৩৫ এবং ২৩৬ বউবাজার স্ট্রিট। 

অতএব, পতিতা আর বাইজি সমার্থক হয়ে যেতে সময় লাগেনি। অথচ, বাইজিদের গান তখন মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সমাজের উচ্চস্তরে। শোনা যায়, সেই সুরের জাদুতে বুঁদ হয়েই নাকি মীরজাফর বিয়ে করেছিলেন মণি বাইজি আর বব্বু বাইজিকে। রামমোহনের মানিকতলার বাগানবাড়িতে রাতের আসর মাতিয়ে তুলতেন নিকিবাই। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন ফ্যানি পার্কস। ইতালির কিংবদন্তী অপেরা গায়িকার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন “Catelani of the east”। নিকির পাশাপাশি আলোচিত হচ্ছে বেগম জান, হিঙ্গুল বাই, নান্নিজান, সুপন্‌জানদের নামও। এঁদের কণ্ঠে বুঁদ হচ্ছে ঠাকুরবাড়ি, মল্লিকবাড়ির বাবুদের জলসা। নিকি বাই এর দর ছিল একরাতে হাজার টাকা।

এই মুগ্ধতার উল্টোপিঠে ছি-ছিক্কার। রূপচাঁদ পক্ষীর ‘কলিকাতা বর্ণন’-এ বাইজি আর খেম্‌টাআলি, যাত্রাআলি, টপ্পাআলি ইত্যাদি সমার্থক। ভবানীচরনের ‘নববাবুবিলাস’-এর বর্ণনা রীতিমতো রগরগে ও তীব্র। যবনী বারাঙ্গনাদের ‘বাই’ বলে ডেকে বাবুরা তাঁদের বাসায় বারবার যায়। কারণ, “তাহারদিগের সহিত সম্ভোগে যত মজা পাইবা এমত কোন রাঁড়েই পাইবা না”। 

কিন্তু, এই নিন্দে মন্দর বিপরীত স্রোতও ছিল। সেখানে খেমটা নাচ আর বাইজি নাচের মধ্যে রুচি আর সংস্কৃতির পার্থক্যও খোঁজা হচ্ছিল। তুলনায় দেখা গেল, বাইজি নাচ অনেক সভ্য, শালীন। বাইজি নাচকে ভুলবশত মহারাষ্ট্রের নৃত্য হিসেবে উল্লেখ করে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’-এর একটি লেখা ঘোষণা করছে—“খেমটা তান্ত্রিক, মহারাষ্ট্র নৃত্য পৌরাণিক। পুরাণের ন্যায় এই নৃত্যের গাম্ভীর্য আছে।” খেমটা এই লেখার লেখকের চোখে ‘ছোটলোকের আমোদ’, কুৎসিত নাচ। বাই নাচ মোটে তেমন নয়। ‘সাধারণী’ পত্রিকাও খেমটাকে ‘নীচ ভাবোদ্দীপক জঘন্য’ নাচ বলে প্রশংসা করছে বাই নাচের। অর্থাৎ, বাই নাচের শ্রেণিচরিত্রগত একটি পার্থক্যও স্বীকৃত হচ্ছে সমাজে। ভাবটা এমন, বাইরা ‘নষ্ট’ মেয়েমানুষ হতে পারে, কিন্তু তাঁদের শিল্পটি উচ্চাঙ্গের। তা উচ্চকোটির আস্বাদনের সামগ্রী। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Baiji babu culture)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours