তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় প্রথম হাতে লেখা হয়েছিল সংবিধান। আর সেই সংবিধানের প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণ তৈরি করেন নন্দলাল বসু। হাতে লেখা সংবিধানটির ক্যালিগ্রাফ করেছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার প্রেম বিহারী রাইজাদা। ইটালিক হরফে তাঁর সেই সৃষ্টি আজও আগ্রহীদের কাছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কে এই প্রেমবিহারী যে আজও খ্যাতির আড়ালে।

আমরা জানি ডক্টর আম্বেদকরই ভারতীয় সংবিধানের জনক। কিন্তু কজনের জানা আছে যে এই বিশাল সংবিধানটি সম্পূর্ণ হাতে লেখা হয়েছিল। পুরো সংবিধানটি লেখার জন্য কোনো রকম যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। এই বিশাল বইটি অর্থাৎ সম্পূর্ণ সংবিধানটাই নিজের হাতে ইটালিক স্টাইলে, ক্যালিগ্রাফি করে লিখেছিলেন প্রেম বিহারী নারায়ণ রায়জাদা নামে দিল্লীর এক বাসিন্দা।

প্রেম বিহারী ছিলেন ওই সময়ের একজন নামজাদা ক্যালিগ্রাফি রাইটার। তিনি ১৯০১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর দিল্লীর এক নামকরা হস্তাক্ষর গবেষকের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যুবক বয়েসেই তাঁর পিতা-মাতাকে হারান। তাঁর দাদু রাম প্রসাদ সাক্সেনা ও কাকা চতুর বিহারী নারায়ণ সাক্সেনার কাছে তিনি মানুষ হন। তাঁর দাদু রাম প্রসাদ একজন ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। তিনি পার্শী ও ইংরেজি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের পার্শী ভাষা শেখাতেন।

সুন্দর হস্তাক্ষর করার জন্য প্রেম বিহারীকে ছোটবেলা থেকেই ক্যালিগ্রাফি আর্ট শেখাতেন। প্রেম বিহারী দিল্লীর সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর দাদুর কাছে শেখা ক্যালিগ্রাফি আর্ট নিয়ে চর্চা করতে আরম্ভ করেন। ধীরে ধীরে সুন্দর হস্তাক্ষরের জন্য তাঁর নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

যখন সংবিধান ছাপার জন্য তৈরী হয়ে গিয়েছে, তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু প্রেম বিহারীকে ডেকে পাঠান। নেহেরুর খুব ইচ্ছে ছিল সংবিধানটি ছাপার অক্ষরে না রেখে ইটালিক অক্ষরে ক্যালিগ্রাফি করে হাতে লেখার। সেই কারণেই তিনি প্রেম বিহারীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। প্রেম বিহারী তাঁর কাছে আসার পর নেহেরুজী তাঁকে ইটালিক স্টাইলে সংবিধানটি হাতে লিখে দিতে বললেন এবং তিনি কি পারিশ্রমিক নেবেন তা জানতে চাইলেন।

প্রেম বিহারী নেহেরুজীকে বললেন ” Not a single penny. By the grace of God I have all the things and am quite happy with my life.” একথা বলার পর তিনি নেহেরুজীকে একটা অনুরোধ করেন “I have one reservation – that on every page of constitution I will write my name and on the last page I will write my name along with my grandfather’s name.” নেহেরুজী তাঁর এই অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন। এই সংবিধান লেখার জন্য তাঁকে একটা ঘর দেওয়া হয়েছিল। যেখানে বসে প্রেমজী পুরো সংবিধানটির পান্ডুলিপিটা লিখেছিলেন।

লেখা শুরু করার আগে প্রেম বিহারী নারায়ণ রায়জাদা নেহেরুজীর ইচ্ছানুযায়ী ২৯শে নভেম্বর ১৯৪৯ সালে তদকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সাথে শান্তিনিকেতনে আসেন। তাঁরা বিখ্যাত চিত্রকর নন্দলাল বসুর সাথে আলোচনা করে ঠিক করেন কিভাবে ও পাতার কতটা অংশ নিয়ে প্রেম বিহারী লিখবেন, পাতার বাকি ফাঁকা অংশে নন্দলাল বসু অলংকরণ করবেন।

নন্দলাল বসু ও শান্তিনিকেতনের তাঁর কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী এই ফাঁকা অংশগুলোতে অনবদ্য চিত্রশৈলীতে ভরিয়ে তুলেছিলেন। মহেঞ্জদরোর সিলমোহর, রামায়ণ, মহাভারত, গৌতম বুদ্ধের জীবন, সম্রাট অশোকের বৌদ্ধধর্ম প্রচার, বিক্রমাদিত্যের সভা, সম্রাট আকবর ও মুঘল সাম্রাজ্য, মহারানী লক্ষীবাঈ, টিপু সুলতান, গান্ধীজির আন্দোলন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের ও আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই, ভারতের পাহাড়, সমুদ্র ও মরুভূমির সৌন্দর্যের রূপচিত্র সবই তাঁদের অঙ্কন অলংকরণে ফুটে উঠেছে। সবমিলে এ যেন ভারতের ইতিহাস ও ভূগোলের চিত্রিত রূপ। তাঁরা সংবিধানের বিষয়বস্তু ও অনুচ্ছেদ অনুযায়ী খুবই সুচিন্তিতভাবে চিত্রগুলি চিত্রায়ণ করেছিলেন।

ভারতীয় সংবিধানটি লিখতে প্রেম বিহারীর দরকার হয়েছিল ৪৩২টা পেন হোল্ডার আর তিনি ৩০৩ নম্বরের নিব ব্যবহার করেছিলেন । নিবগুলো ইংল্যান্ড ও চেক্সস্লোভিয়া থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। নিবগুলো ওখানকার তৈরী করা নিব। ভারতের কনস্টিটিউশন হলের একটা ঘরে তিনি দীর্ঘ ছয় মাস ধরে সমগ্র সংবিধানের পাণ্ডুলিপিটি লিখেছিলেন। সংবিধানটি লিখতে ২৫১ পাতা পার্চমেন্ট কাগজ ব্যবহার করতে হয়েছিল। সংবিধানটির ওজন ৩ কিলো ৭৫০ গ্রাম। সংবিধানটি দৈর্ঘ্যে ২২ ইঞ্চি আর প্রস্থে ১৬ ইঞ্চি।

১৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬ সালে প্রেম বিহারীর মৃত্যু হয়। ভারতীয় সংবিধানটির মূল বইটি বর্তমানে দিল্লীর সংসদ ভবনের গ্রন্থাগারে স্বযত্নে সংরক্ষিত করা আছে। পরবর্তীকালে দেরাদুনের সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে অল্প কিছু পুস্তক ছাপার হরফে প্রকাশিত করা হয়েছিল।

ভারতীয় সংবিধান তৈরির ইতিহাস বলতে নাছোড় আন্দোলনের সামনে ১৯৪৪-৪৫ সালেই ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পেরে গেল, এ বার পাততাড়ি গোটাতে হবে। স্বাধীনতা নিয়ে আর টালবাহানা করা যাবে না। তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ৪৬-এ ভারতে এলো ক্যাবিনেট মিশন। তখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সারা ভারতে জয়রথ ছুটছে কংগ্রেসের। স্বাধীনতার দাবি তখন আর অনুনয় বিনয়ে আটকে নেই। একই সঙ্গে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিতে উত্তপ্ত ভারতভূমি, বার বার অশান্ত হয়ে উঠছে। উঠছে দেশভাগের দাবিও।

ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব দিল, সংবিধান রচনা করতে হবে। ভারতের মতো বৃহৎ ও বহুত্ববাদী দেশ পরিচালনা করতে গেলে সংবিধানের যে আশু প্রয়োজন তা বুঝলেন কংগ্রেসের তাবড় নেতৃত্বও। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে ভারত থেকে এক সিভিল সার্ভেন্ট প্রথম পাড়ি দিলেন সূদুর আমেরিকায়। কথা বললেন সে দেশের বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রনায়ক, বিচারপতিদের সঙ্গে। মার্কিন মুলুকের সর্বোচ্চ আদালতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও কথা হল এই ভারতীয় আইসিএস অফিসারের। তারপর অবশ্য তিনি একে একে পাড়ি দিলেন কানাডা, আয়ারল্যান্ড এমনকী লন্ডনেও। ফিরে এসে প্রথম সংবিধান রচনার কমিটির কাছে ভারতের সংবিধান কেমন হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে বিস্তারিত খসড়া প্রস্তাবও দিলেন তিনি।

ভারতের সংবিধান প্রণেতা হিসেবে অবশ্যই বি আর আম্বেদকরের নাম সর্বাগ্রে থাকবে। কিন্তু খোদ বাবাসাহেব যাঁর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বাকি কাজগুলি করেছিলেন, তিনি মূলধারার ইতিহাস থেকে এখন অনেকটাই বিস্মৃতির আড়ালে। অথচ বাবাসাহেব নিজেই ২৬ নভেম্বর ১৯৪৯-এ ভারতীয় সংবিধান প্রথম গ্রহণ করার আগে এই মানুষটাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, বিএন রাউ না থাকলে সংবিধানের মতো এত ব্যাপক কাজ সম্পন্ন করাই সম্ভব হত না। অথচ সেই বেনেগাল নরসিং রাউ-এর নাম এখন আমরা কতজনই বা জানি তবে আমরা অনেকেই হয়তো এইটুকু জানি ১৯৫০ সালে ২৬ জানুয়ারি প্রথম ভারতীয় সংবিধানকে মানুষের সামনে আনা হয়। দেশ যে সংবিধানের বিধি দ্বারা পরিচালিত হবে, সেই সিদ্ধান্ত অনেক আগে নেওয়া হলেও পাক্কা ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন ধরে বহুবিধ আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, সংশোধন, পরিমার্জনের পর এই দিনটিতেই সংবিধান কার্যকর করা হয়। ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের নেপথ্যে এটাও একটা কারণ। যদিও ১৯৩০ সালে এই ২৬ জানুয়ারিই পূর্ণ স্বরাজের ঘোষণা করে আপসহীন লড়াইয়ে সামিল হয় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের নেপথ্যে এটাও একটা কারণ।

কিন্তু জানেন কী, ভারতের সংবিধান বহরে পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বড়, অনেক ব্যাপকও। ভারতীয় সংবিধানে ২৫টি ভাগে, ১২টি সিডিউলে রয়েছে মোট ৪৪৮টি আর্টিকেল। একেবারে শুরুতে হিন্দি ও ইংরেজিতে হাতে লেখা হয়েছিল ভারতীয় সংবিধান। কেবল ইংরেজিতে লেখা সংবিধানেই মোট ১ লক্ষ ১৭ হাজার ৩৬৯ টি শব্দ রয়েছে। হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় হাতে লেখা সেই প্রথম সংবিধান আজও পার্লামেন্টের লাইব্রেরিতে একটি বিশেষ হিলিয়াম কেসে সংরক্ষিত রয়েছে। হিলিয়াম কেসে রাখার ফলে প্রথম সংবিধানটি আজও অক্ষত রয়েছে রাজধানীর অলিন্দে।

জেনে রাখা ভালো, ভারতীয় সংবিধান প্রণেতাদের উপর বিভিন্ন দেশের প্রভাবও এসে পড়েছিল। যেমন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ইউএসএসআর থেকে। বহু সামাজিক অধিকারের ধারণা নেওয়া হয়েছিল আয়ারল্যান্ড থেকে। ভারতীয় সংবিধানে দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব ও সমানাধিকারের ধারণা নেওয়া হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের থেকে। এমনকী সংবিধানের প্রস্তাবনা শুরু হয় যে বিখ্যাত উক্তি দিয়ে ‘উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া’-র ধারনাটিও হুবহু গ্রহণ করা হয়েছে আমেরিকার সংবিধান থেকে। এ ছাড়া ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের ন’টি মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের বিষয়টিও আত্মস্থ করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই।

তবে সবটাই যে অন্যদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে করা হয়েছিল তা কিন্তু নয়। ১৯৪৯-এর ২৬ নভেম্বর ভারতীয় সংবিধানের ফাইনাল ড্রাফট চূড়ান্ত করার আগে ভারতীয় উপমহাদেশের সব অংশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দু’বছরের বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন বাবাসাহেব ও তাঁর সহকর্মীরা। এই পর্বে মোট ২০০০ সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছিল। কারণ আম্বেদকর চেয়েছিলেন কোনও ভাবে যেন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ক্ষুণ্ণ না হয়। সংবিধান পড়ে কোনও রাজ্য, জাতি, ধর্মাবলম্বী, সাধারণ মানুষ, বা নারী-পুরুষ যেন বলতে না পারেন, তাঁদের উপর কোনও মত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই স্বাধীনতা ও সমগুরুত্বের কারণেই ভারতীয় সংবিধানের রূপ এত বিশাল।

কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই ভারতীয় সংবিধান এর ঐক্য ও বৈচিত্রের যে নির্যাস যা আঁকা হয়েছেঅ দীর্ঘ গণতান্ত্রিক বিতর্কের পর যা আজ প্রতিনিয়ত আক্রান্তের মুখে।

(www.theoffnews - constitution of India)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours