তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
উত্তর ও পূর্ব কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে এই দীননাথ মুচির জমি জমা ছিল বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। এছাড়া পাইকপাড়ার ২২ নম্বর রোডে ছিল দীনু দাসের বাগান বাড়ি। যখনই কর্মে ক্লান্ত হয়ে যেতেন পাইকপাড়ার এই বাগান বাড়িতে আসতেন।কলকাতার তাবর তাবর লোকের বাগান বাড়ি ছিল এই পাইকপাড়ায়। কলকাতার উল্টোডাঙ্গার মুচিবাজার এই দীননাথ দাসের তৈরি। কিন্তু দীনু দাস এর নাম কেউ বলে না। এই দীনু দাসের জীবন কাহিনী তেমন ভাবে আলোচিত হয়নি। প্রচুর সম্পত্তির মালিক হলেও তিনি কলকাতায় ব্রাত্য ছিলেন, কিন্তু নিষ্ঠাবান হিন্দু ও পরোপকারী এবং পরিশ্রমী মানুষ হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। একমাত্র হরিপদ ভৌমিকের কলকাতার মুচি প্রবন্ধর লেখা থেকে জানা যায় ১৮৪২ সালে জন্ম এই দীননাথ দাসের জন্মস্থান ছিল বীরভূম জেলার খুজটি পাড়ার ছাতিম গ্রামে যদিও পৈতৃক বাড়ি ছিল বর্ধমান জেলার রতনপুর গ্রামে। পিতার নাম ছিল মাধব চন্দ্র দাস। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ, জাতিতে মুচি হলেও জীবন যাত্রা ছিল সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণদের মত। পিতামহ কৃষ্ণমহন দাস পায়ে হেটে কলকাতায় এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে।
কলকাতার সিমলা কাঁসারি পাড়ায় কাঁসা পিতলের বাসন তৈরি হতো। কাঁসা পিতলের ক্ষেত্রে জাতা বা হাপরের প্রয়োজন হয়। এই চামড়ার হাপর তৈরি করার কাজ করতেন কৃষ্ণমোহন। কিন্তু হটাৎ তাঁর মৃত্যু হয়।
১৮৫৬ সালে চার পুত্র ও বিধবা স্ত্রী পায়ে হেটে কলকাতায় চলে আসেন। এই চার পুত্রের মধ্যে ছিলেন মাধব চন্দ্র যার পুত্র ছিলেন দীননাথ দাস। কলকাতায় গোয়াবাগানে ছিল রুইদাস সম্প্রদায়ের বাস, এরা মুলত চর্মকার সম্প্রদায় ভুক্ত। এই সম্প্রদায়ের আদি পুরুষছিলেন রুইদাস বা রবিদাস। আনুমানিক পঞ্চদশ - ষোড়শ শতকে প্রসিদ্ধ সাধক ছিলেন রুইদাস। এই চর্মকার পরিবারের জন্ম কাশির উপকণ্ঠে।
এই রুই দাস ছিলেন মীরাবাই এর সমসাময়িক।মীরার ভোজনে ও কবীরের দোঁহায় রবিদাস নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। শিখ ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থ সাহেবে তিরিশটি ভজন সংকলিত আছে। ১৮৬৫ সালে বিধ্বংসী ঝড়ে কলকাতার গঙ্গার চামড়া বোঝাই এক জাহাজ ডুবে যায়। দীননাথ তাঁর পিতার পরামর্শে ওই জলে ডোবা চামড়া খুব কম দামে কিনে নেন। এই চামড়া বিক্রি করে প্রচুর টাকা লাভ করেন এবং ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। দিননাথ প্রথম কলকাতায় চামড়া ট্যানিংয়ের কারখানা খোলেন।মানিকতলার লাল বাগানে পরে উল্টোডাঙ্গার দুর্গাপুরে দুইটি চামড়া ট্যানিংয়ের কারখানা তৈরি করেন। এই সময় কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদারি ক্রয় করেন।
সেকালের কলকাতায় গরু মহিষ মারা গেলে গঙ্গার জলে ফেলে দেওয়ার রীতি ছিল। ওই মৃত দেহগুলি গঙ্গা থেকে তুলে গঙ্গা পরিষ্কার রাখার জন্য সরকারের কাছে ইজারা নেন এই দীননাথ। ওই মরা পশুর চামড়া ছাড়িয়ে ব্যবহারের উপযোগী করার কাজে হিন্দুস্থানী কর্মী নিয়োগ করেন এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। ১৮৬৭ সালে কলকাতার বিডন স্ট্রিটে জমি কিনে পাকা বাড়ি তৈরি করেন। এরপরে মাধব চন্দ্রের মৃত্যু হয়, এরপর আর একটা বাড়ি করেন ১৩৬ নম্বর মানিকতলা রোডে। দীননাথ শুধু বাজার নয় উল্টোডাঙ্গায় রাধা গোবিন্দের মন্দির নির্মাণ করেন। তাঁর দানের হাত কম ছিল না। কিন্তু মুচি হওয়ার অপরাধে তাঁর বাজারের নাম হয় মুচি বাজার। মুচির তৈরী বাজার বলে এই বাজারে কেউ আসতেন না। শুধু মন্দির নয় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পড়েন বিপাকে। সমাজপতিরা বলেন তাঁর হাত থেকে কেউ প্রসাদ নেবেন না কারণ তিনি নিন্ম বর্ণের মানুষ, পেশায় মুচি। শুরু হল বিতর্ক। কলকাতার সমস্ত গোস্বামী প্রভুরা দীননাথের সেবা গ্রহণ করবেন যদি দীননাথ ভেক ধরেন অর্থাৎ বৈষ্ণব সন্ন্যাসীতে রূপান্তরিত হন। এই নিয়ে গোস্বামীদের দুটি ভাগ হয়ে যায়। কারণ সেকালে কলকাতায় বৈষ্ণব সেবা না হলে মন্দিরের সর্বজন স্বীকৃতি মিলত না। অবশেষে বৈষ্ণব সেবা হয় মন্দির উদ্ভোদনের তিন মাস পরে।
বহু জন হিতকর কাজে সারা জীবন নিয়োগ করেছিলেন দীননাথ দাস। কর্ম বিমুখ বাঙালিকে কর্মমুখী করার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন দীননাথ।সেকালের কলকাতায় আধিপত্য ছিল হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মণদের, তারই শিকার হয়েছিলেন দীননাথ দাস।অবশেষে ১৯৩০ সালে দিনুমুচি ওরফে দীননাথ দাসের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে গভীর ভাবে শোক প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন বিদগ্ধ সমাজ। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র বলেছিলেন "দিননাথ শতছিন্ন মলিন বসনে সুদূর পল্লীগ্রাম হতে কলকাতায় এসে এবং স্বাধীন ব্যবসার পত্তন করে তিনি এমন প্রচুর অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন যে, দেশের মঙ্গলের জন্য নানা সদনুষ্ঠানে তিনি বহু অর্থ ব্যয় করে গেছেন। দিননাথ ধনী ছিলেন বটে, কিন্তু তাই বলে তিনি সাহেব পাড়ায় গিয়ে বসতবাটী তৈরি করেননি, অথবা পূর্বপুরুষেরা যেভাবে হাঁটুর ওপর কাপড় পড়ার অভ্যেস ত্যাগ করেননি অর্থের আড়ম্বর বা জাঁক জমকের লেস মাত্র তাতে ছিল না। টাকা হলেই মানুষ ভোগবিলাসি হয়, দিননাথ একেবারে সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন। তিনি নীরব কর্মী ছিলেন, অন্য বাবুদের মত ঢাক পিটিয়ে দান খয়রাত করতেন না, নাম বাজানো তাঁর প্রকৃতি বিরুদ্ধ ছিল।তিনি ব্যবসা সূত্রে কলকাতায় থাকতেন বটে কিন্তু তিনি তাঁর জন্মভূমি সেই পল্লীগ্রামটিকে ভোলেননি। তিনি পরোপকার বা লোকহিত করতেন গোপনে কিন্তু তা কেউ জানতে পারলে তিনি লজ্জিত হতেন"
আর একটা কথা বলা প্রয়োজন বিদ্যাসাগর মহাশয় যে চটি পড়তেন তা তালতলা চামড়ার দোকান থেকে কেনা। আর তালতলায় দিননাথের বড় দোকান ছিল। সুতুরাং বিদ্যাসাগরের সাথে আলাপ হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
কিন্তু ইতিহাসে এর উল্লেখ নেই, তবে মুচি বলে ঐতিহাসিকরা অবজ্ঞা করেছেন, এই প্রশ্ন তো উঠবেই। উল্টোডাঙ্গার মুচি বাজার আজকের দিনে একটা ব্যস্ততম বাজার। এইটি দীননাথ দাস প্রতিষ্ঠিত করেন ১৯১৫ সালে, অথচ তাঁর নাম উচ্চারণ করা হয় না অর্থাৎ বাজারের সাথে এই নামটি জনপ্রিয়ই হয়নি। এই বাজারকে কেন্দ্র করেই মানুষের বসতি অথচ স্থানীয় ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা এই মানুষটি আজ বিস্মৃতির অতল জলে তলিয়ে গেছে। নিজের কর্মগুনে হিন্দু বাবুদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কোনও বাবুগিরি দেখাননি। প্রশ্ন উঠছে একটাই হিন্দুব্রাহ্মণ কৌলিন্য ঐতিহাসিকদের কি আচ্ছন্ন করে রেখে ছিল?
(www.theoffnews.com - Muchipara Kolkata)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours