তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
বহুমূল্য ইউরােপীয় আসবাবপত্রে মাণিকতলার বাড়িটি সুসজ্জিত করে রাজা রামমােহন কলকাতার জীবনযাত্রা শুরু করেছেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, সমসাময়িক কালে রাজা রামমােহন রায়ের এক যবনী রক্ষিতা ছিল। উমানন্দন ঠাকুরের এক প্রশ্নের উত্তরে রাজা রামমােহন রায় বলেছিলেন যে, ওরূপ যবনী রক্ষিতা শৈবমতে বিবাহিতা স্ত্রীর সামিল।
অনেকের ধারণা রামমােহন গােপনে এক মুসলমান রমণীকে বিবাহ করেন এবং তার ঘরে এক পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করে। পুত্রটি আর কেউ নন, তিনি রাজারাম রায় যাকে রামমােহন নিজের পালিত পুত্র হিসেবে ঘােষণা করে তাকে নিয়ে ১৮৩১ সালে বিলেতে যান এবং সেখানে তার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেন। রামমােহনের মৃত্যুর পর রাজারাম বিলেতেই থেকে যান। রামমােহনের মেয়েটিকে হুগলির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বিবাহ দেওয়া হয়। কিন্তু বিনয় ঘােষ এমন তথ্য স্বীকার করেননি। তিনি জানিয়েছেন রাজারাম রায় রামমােহনের নিজের সন্তান নন, দত্তক নন, আশৈশব পুত্রবৎ পালিত একজন এদেশীয় সন্তান। তিনি হিন্দুর, না মুসলমানের, না খ্রীস্টানের, না ইহুদীর, কার সন্তান তা আজও জানা যায়নি। ১৮২৩ সালে রামমােহনের মাণিকতলার বাগানবাড়িতে আয়ােজিত ভােজসভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার ডায়রিতে ঘটনার আরও বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, “বেশ বড় চৌহদ্দীর মধ্যে তার বাড়ী, ভােজের দিন নানা বর্ণের আলাে দিয়ে সাজানাে হয়েছিল। চমৎকার আতসবাজীর খেলাও হয়েছিল সেদিন। আলােয় আলােকিত হয়েছিল তার বাড়ী। বাড়ীতে বড় বড় ঘর ছিল এবং একাধিক ঘরে বাঈজী ও নর্তকীদের নাচগান হচ্ছিল। বাঈজীদের পরণে ছিল ঘাঘরা, সাদা ও রঙ্গীন মসলিনের ফ্রিল দেওয়া, তার উপর সােনা রূপাের জরির কাজ করা। সাটিনের ঢিলে পায়জামা দিয়ে পা পর্যন্ত ঢাকা। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, পােষাকে ও আলােয় আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল। গায়েতে অলঙ্কারও ছিল নানারকমের। তারা নাচছিল দলবেঁধে বৃত্তাকারে, পায়ের নূপুরের ঝুমঝুম শব্দের তালে তালে।…নর্তকীদের সঙ্গে একদল বাজিয়ে ছিল, সারেঙ্গী মৃদঙ্গ, তবলা ইত্যাদি নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল তারা। …বাঈজীদের মধ্যে একজনের নাম নিকী, শুনেছি সারা প্রাচ্যের বাঈজীদের মহারাণী সে, এবং তার নাচগান শুনতে পাওয়া রীতিমত ভাগ্যের কথা। বাঈজীদের নাচগান শােনার পর রাতের খাওয়া-দাওয়াও শেষ হল। তারপর এদেশের ভেলকিবাজ জাগলারদের অদ্ভুত সব ত্রীড়াকৌশল আরম্ভ হল। কেউ তলােয়ার লুতে হাঁ করে সেই ধারালাে অস্ত্রটা গিলে ফেললে, কেউ বা অনর্গল আগুন ও ধোঁয়া বার করতে লাগল নাকমুখ দিয়ে। একজন শুধু ডান পায়ের উপর দাঁড়িয়ে পিছন দিক দিয়ে বাঁ পা তুলে ধরল কাধের উপর। এই ধরণের কৌশল দেখে নকল করার চেষ্টা করাও বিপজ্জনক। বাড়ীর ভিতর সুন্দর ও মূল্যবান আসবাবপত্র সাজানাে এবং সবই ইউরােপীয় স্টাইলে, কেবল বাড়ীর মালিক হলেন বাঙ্গালীবাবু (রামমােহন রায়)।”
রাজা রামমােহনের অন্তরঙ্গ সুহৃদ প্রিন্স দ্বারকানাথও নিকৃষ্ট আমােদ-প্রমােদ করতেন। ১৮২৩ সালে তার নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে অনেক কৌতুকাবহ ভাঁড়ামির অভিনয় হয়েছিল। ‘সমাচার দর্পণ’-এর সংবাদে প্রকাশ “মােং কলিকাতা ১১ ডিসেম্বর ২৭ অগ্রহায়ণ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে শ্ৰীযুত বাবু দ্বারিকানাথ ঠাকুর স্বীয় নবীন বাটীতে অনেক ভাগ্যবান সাহেব ও বিবীরদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়া চতুর্বিধ ভােজনীয় দ্রব্য ভােজন করাইয়া পরিতৃপ্ত করিয়াছেন এবং ভােজনাবসানে ওই ভবনে উত্তম গানে ও ইংলণ্ডীয় বাদ্য শ্রবণে ও নৃত্য দর্শনে সাহেবগণে অত্যন্ত আমােদ করিয়াছিলেন। পরে ভাঁড়েরা নানা সঙ করিয়াছিল কিন্তু তাহার মধ্যে একজন গাে-বেশ ধারণপূর্বক ঘাস চর্বণাদি করিল।”
দেশীয় জমিদার-দেওয়ান-বেনিয়ান ও ইউরােপীয় বণিক-কর্মচারীদের আনন্দ দানের জন্য প্রিন্স দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির অনুষ্ঠানে আতসবাজী ও আলাের বিচিত্র খেলায়, আমােদ-প্রমােদের বিলাসে লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। গভর্ণর জেনারেল লর্ড অকল্যাণ্ডের ভগ্নী মিস ইডেনের সম্মানে যে বিরাট উৎসবানুষ্ঠানের আয়ােজন এই বাগানবাড়িতে করা হয়েছিল, তার বর্ণনা দিয়েছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, “যখন গবর্নর জেনারেল লর্ড অকলণ্ড ছিলেন, তখন আমাদের বেলগাছিয়ার বাগানে। অসামান্য সমারােহে গবর্নর জেনারেলের ভগিনী মিস ইডেন প্রভৃতি অতি প্রধান প্রধান বিবি ও সাহেবদিগের এক ভােজ হয়। রূপে, গুণে, পদে, সৌন্দর্য্যে, নৃত্যে, মদ্যে, আলােকে বাগান একেবারে ইন্দ্রপুরী হইয়া গিয়াছিল।”
দ্বারকানাথের জীবনীকার কিশােরীচাঁদ মিত্র বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “এখানেই তাঁর আতিথেয়তা রাজকীয় আড়ম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল। এবাড়ির প্রশস্ত উদ্যানের মধ্যে এঁকে বেঁকে প্রসারিত মতিঝিল ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। মতিঝিলটি ঝলমল করত হিন্দু কবির অতি প্রিয় নীলপদ্ম ও অন্যান্য হরেকরকম সুন্দর সুন্দর ফুলের ঐশ্চর্য্য। ফেব্রুয়ারী ও মার্চ চতুর্দিক প্রসারিত প্রাঙ্গনে যেন পিটুনিয়া, পিঙ্ক, ফ্লস্, সাক্ পার্স, গােলাপ, জিনিয়া প্রভৃতি ফুলের আগুন লাগত। এ বাড়ির সুপ্রশস্ত বৈঠকখানা এমন রীতিতে সজ্জিত হয়েছিল যা সে-যুগে দুর্লভ। ভিলার শিল্পশালার দেওয়ালগুলাে ছিল আধুনিক শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনে অলঙ্কৃত এর কারণ স্বরূপ বলা যায় এর মালিক ছিলেন চিত্র এবং ভাস্কর্যের উৎকর্ষ বিচারে যথার্থ অভিজ্ঞ। বৈঠকখানার পিছনে ঝকমক করত মার্বেল পাথরে বাঁধানাে ফোয়ারা, তার উপরে ছিল কিউপিডের একটি মুর্তি। মতিঝিলের মাঝখানে ছিল একটি দ্বীপ, দ্বীপের উপর একটি গ্রীষ্মবাস। একটি ঝােলানাে লােহার সেতু ও একটি হালকা কাঠের সেতুর সাহায্যে গ্রীষ্মবাসটি মূল বাগানের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এ গ্রীবাস ছিল আমােদ-প্রমােদের কেন্দ্র। পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত হলেও বেলগাছিয়া ভিলাকে বলা চলত কলকাতার ওয়েস্ট এণ্ড বা কেনসিংটন। এখানে দ্বারকানাথ অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন। বলতে কী, বেলগাছিয়া ভিলার উৎসবগুলাের মত বিলাসবহুল ও জমকালাে উৎসব সে যুগে খুব কমই হত। অভ্যাগতদের জন্য যে রান্না হত তার প্রণালী ছিল অতুলনীয়। আভিজাত্যে ও শ্রেণী মর্যাদায় অতিথিরাও হতেন অনন্য। খাদ্য তালিকায় থাকত ফরাসী ও প্রাচ্য দেশীয় খাদ্যের অফুরন্ত বৈচিত্র। তাদের মধ্যে অবশ্য সবচাইতে কদর ছিল কাবাব, পােলাও এবং হােসেনীর। মদ আমদানি করা হত সােজা ইউরােপ থেকে। আর দ্রাক্ষা মদিরার মধ্যে সেগুলাে ছিল সেরা জাতের।…
কাউন্সিলের সদস্যরা এবং সুপ্রিম কোর্টের জজরাও দ্বারকানাথের আতিথ্য গ্রহণ করতেন। আর আসতেন বিভাগীয় জেনারেলগণ আর পরগণার জমিদাররা। এধরণের ভােজসভায় পুরনাে সিভিলিয়ানরা এবং ভােগক্লান্ত সামরিক কর্মচারীরা তরুণ সহকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করতেন।… বেলগাছিয়া ভিলাই ছিল সেযুগের একমাত্র ব্যক্তিগত বাগানবাড়ি বা একমাত্র স্থান যেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর ইউরােপীয় ও দেশীয় ভদ্রলােকেরা মিলিত হতেন, মেলামেশা করতেন স্বচ্ছন্দ অন্তরঙ্গতায়। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Baiji babu culture)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours