তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, হয়তো এই কারণেই শরৎচন্দ্র রাজলক্ষ্মীকে খেমটাওয়ালি না বানিয়ে মোগলাই জগতের বাইজি বানিয়ে তুলেছেন। এই বিচারে রামমোহন, অবনীন্দ্রনাথের বাইজি গানের প্রতি মুগ্ধতা অবিশ্বাস্য ঠেকে না। কিন্তু এই গল্পে যদি বিবেকানন্দও প্রবেশ করেন, তাহলে? অবাক করা গল্প আমাদের শুনিয়েছেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। খেতরীর রাজসভায় উপস্থিত বিবেকানন্দ। এক বাইজি গান শোনাতে এসেছেন। বিবেকানন্দ তো এমন গান শুনবেন না। রাজা বহু অনুরোধে তাঁকে একখানা গান শোনার জন্য রাজি করালেন। বাইজি গান ধরলেন- “প্রভু মোর অবগুণ চিত না ধর।/ সমদরশি হ্যায় হাম তোমার।" গান শুনে চোখ জলে ভরে উঠল বিবেকানন্দর। নিজের সন্ন্যাসকেও মনে মনে দুষলেন তিনি। এরপর থেকে সেই বাইজিকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন বিবেকানন্দ। খেতরীতে গেলেই রাজাকে বলতেন, “আমার মাকে ডাক, আমার গান শুনিতে ইচ্ছা হইয়াছে।”
কলকাতায় কলের গানের রেকর্ডকে ভরিয়ে তুললেন সালকাজান, গওহরজান, কৃষ্ণভামিনী, হরি বাইজিরা। গওহরজান গাইলেন রবীন্দ্রনাথের “কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলাম না”, রবীন্দ্রনাথের গানে কণ্ঠ দিলেন কৃষ্ণভামিনীও। ১৯২৯-এ শরচ্চন্দ্র শীল-এর সংগ্রহে প্রকাশ পেল ‘বাইজি সংগীত’। মোট ১৩৮টি গানের সংকলন। যার শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের গান—‘ভালবেসে যদি সুখ নাহি’, এছাড়াও রয়েছে অমৃতলাল বসু, গিরিশচন্দ্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের গান। সেইসব গান বাইজি কণ্ঠে গিয়ে নিশ্চয়ই চরিত্র হারায়নি, বরং নতুন ঐশ্বর্য পেয়েছিল।
উনিশ শতকের কলকাতায় বাবু বিলাসের মধ্যে দিয়ে বাগানবাড়িতে মনোরঞ্জনের জন্য শুরু হয়েছিল বাইজি প্রথা। সেই সময়ে সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষিত মানুষরা খুব ভালো চোখে নিত না। বাই এবং বারঙ্গনা প্রায় সমার্থক ছিল। ওই একই ভুল বহু ঐতিহাসিক করেছেন। বারঙ্গনা হলো শারীরিক আনন্দ দেওয়া আর বাইজি হলো যদি ভালো লাগে তবে মনও দেব। সব নয় কিছু বাবুদের সাথে তো দেহের বাইরেও সম্পর্ক ছিল। বাইজি গান মানে কি? ঠুমরি দাদরা গজল, চৈতি আজ যেটা শাস্ত্রীয় সংগীতের সাথে যুক্ত। অর্থাৎ বাইজি গান ভারতীয় সংস্কৃতিকে শুধু পুনর্জীবন দেয়নি বৈচিত্রও এনে দিয়েছে। ওই সময়ে নব্য বাবুরা শুধু যে মেয়ে আর মদ্য পানে ডুবে থাকতো এটা যেমন সত্যি ,আবার উল্টো দিকে এই বাবুরাই নাট্য চর্চায় পয়সা ঢালতেন। তার ফলে নাটক ও যাত্রার গণ ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। তাঁর ফলে গিরিশ ঘোষের উথ্যান। বাগান বাড়ি গুলো ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এই বাগান বাড়িতে আসতো বিত্তশালী সৌখিন বাবুরা। এই বাগানবাড়ি ছিল যেখানে সেটা প্রায় জনবসতি শূন্য। যাতে সাধারণ মানুষ আসতে না পারে।
বেলগাছিয়া ভিলা, গৌরী সেনের বাগানবাড়ি, গোবিন্দ রাম মিত্রের বাগানবাড়ি, দমদমে শেঠ দুনি চাঁদের বাগানবাড়ি, সেনদের বাগান বাড়ী, মোহন কানন, ছিল শীলদের বাগানবাড়ি, ঘোষেদের বাগান (বাবু খেলাত ঘোষ), এছাড়া দাসদের বাগান ও গোয়েনকাদের বাগান ইত্যাদি। এই বাগানবাড়ির ইতিহাস প্রায় দুশো বছরের। এর প্রসার ঘটে মোঘল আমলে। বাইজিরা মূলতঃ এসেছেন তিনটি জায়গা থেকে। সেটা হলো লখনৌ, বারাণসী ও আগ্রা থেকে। কেউ কেউ গান শিখে মানে তালিম নিয়ে এসেছেন। কেউ আবার সারেঙ্গি বাদকের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বাইজিরা প্রধানতঃ বাবুদের ব্যবহার করেছেন। একমাত্র প্রেম হলো সংগীত আর যেখানে পয়সা পাওয়া যায় সেখানে তো প্রেম দেখাতেই হবে। সুতরাং বাইজি গান লজ্জার ইতিহাস নয় আমাদেরই সংস্কৃতির অঙ্গ।
পরবর্তীকালে অনেক বাই বাইজি নাটকে কাজ করেছেন এবং বড় বড় সংগীত সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন আর সংগীত রসিক মানুষ ভীড় রাতের পর রাত জেগে গান শুনেছেন। বহু বাইজি শিল্পীদের কলকাতায় সংগীত জগতে প্রতিষ্ঠা করতে হাত বাড়িয়ে ছিলেন অত্যন্ত গুণী সাধক গিরিজা শংকর চক্রবর্তী আর ছিলেন টালার মন্মথ নাথ গাঙ্গুলী, হিরু গাঙ্গুলির পিতা আর অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন রাজা মনিন্দ্র ও বাবু খেলাত ঘোষ। এটাই ইতিহাস যার উৎস এই বৃহত্তর পাইকপাড়ায়।
আর এক বাইজি বা বাই এর কথা না বললে লেখা শেষ হবে না। তিনি হলেন আখতারি বাই। মানে বেগম আখতার। যিনি জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের সুরে বাংলা গান গেয়েছেন। 'জোছনা করেছে আড়ি।' মানুষ আজও মনে রেখেছে। এই বাইজিদের কি যন্ত্রনা ছিল কোনো দিন কোনো বাবুকে বুঝতে দেয় নি। সবই প্রকাশ করেছে সুর আর গাইওকির মাধ্যমে। এই বাগান বাড়িতেই আবার সাহিত্যের আড্ডা বসতো। যেমন কিশোরী চাঁদের মিত্রর বাগান বাড়ী। আড্ডা দিতেন ভাই প্যারি চাঁদ মিত্র ও প্রমুখ। এই বেলগাছিয়ার বাগান বাড়িতে বসতো হিন্দু মেলার বৈঠক। প্রচুর কংগ্রেসের অধিবেশন ও হয়েছে। এই কাশীপুরের বাগানবাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ। আর এখানেই বসেই ভক্তি মার্গের কথা বলেছেন।
ওই সুন্দরী বাঈজীদের বাবু ও জমিদারেরা ভাড়া করে আনতেন। নাচ, গান, বাজনা আর খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে বাজী পােড়ানাে এবং আরও কুৎসিত আমােদ-প্রমােদের উৎসব চলতাে ঢালাও ভাবে। বাড়ির এই উৎসবে ইংরেজ মনিবদের নেমন্তন্ন করা হােত। এই ছিল নগর কলকাতার নাগরিক জীবনের একমাত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়। ‘আত্মীয়সভা’ ও ‘ধর্মসভা’র গােষ্ঠীভুক্ত রাজা রামমােহনের বাড়িতে, প্রিন্স দ্বারকানাথের বাগান বাড়িতে, রাজা রাধাকান্ত দেবের গৃহে, মহারাজ সুখময় রায়ের বাড়িতে( পোস্তা রাজবাড়ীর বংশধর) রাজা গােপীমােহন দেবের বাড়িতে, (যিনি ছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেবের ভ্রাতুষ্পুত্র) বেনিয়ান বারাণসী ঘােষের বাড়িতে এসব জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান নিয়ে পারস্পরিক প্রতিযােগিতা চলত। ১৮২৯ সালে গােপীমােহন দেবের বাড়িতে পূজা উপলক্ষে লর্ড ক্যাম্বারমিয়ার-সহ লর্ড ও লেডি বেন্টিঙ্ক বাঈজী -নাচ দেখার জন্য উপস্থিত ছিলেন। নিকী ছিলেন সেকালের এক নামকরা বাঈজী। নিকী ছাড়াও আশরুন, ফৈয়াজ বক্স, বেগমজান, হিঙ্গুল, নান্নিজান, সুপনজান, জিন্নাত প্রভৃতি সেকালের বিখ্যাত বাঈজীদের নিয়ে এসে নাচগানের ব্যবস্থা করা হত। এই সমস্ত বাঈজীরা তখন শােভাবাজার, চোরাবাগান, বটতলা, শুরাে, মাণিকতলা এককথায় সারা কলকাতা মাতিয়ে রেখেছিল। এইসব বাঈজী নাচের আসরে একদিকে চণ্ডীমণ্ডপে চলেছে দেবী দুর্গার পূজা অন্যদিকে উঠোনের সামিয়ানার তলায় লম্বা খাবার টেবিল তাতে টার্কি, শুয়ােরের মাংস, দেশি বিদেশি কতসব খাবার আর দামি মদ সাজানাে। পর্তুগিজ আর মুসলমান বাবুর্চিরা সেদিন দারুণ ব্যস্ত। বাবুরা দামি পােশাক এমনকী গয়না পরে (অবশ্য হার, বাজু ইত্যাদি) সেজেগুজে কোচানাে কেঁচা হাতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘরের ভিতর বাঈজী নাচ চলছে আর অন্য এক বিরাট বলরুমে ইউরােপীয় নাচ। এ ছিল সেদিনের দুর্গাপুজোর আসর। (ক্রমশঃ)
তথ্যসূত্রঃ উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় খণ্ড।
বিনোদনে পাইকপাড়া বেলগাছিয়া, সান্তুনু ঘোষ।
কলকাতা রাজপথ, সমাজও সংস্কৃতিতে, অজিত বসু।
(www.theoffnews.com - Baiji babu culture)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours