দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

সামাজিকতা বলতে আগে ছিল সমাজে সকলের সাথে মেশা। যেটা শুধুমাত্র এক পাড়ার মধ‍্যে সীমাবদ্ধ থাকত না। যাত্রা, নাটক, থিয়েটার, বিয়ে, পুজো পার্বণ, মচ্ছব এমনকি কেচ্ছা সব কিছুতেই আমার অবাধ সম‍্যক উপস্থিতি ও মতামত দেওয়ার অধিকার। এখন তো ফোনে কাউকে না পাওয়া গেলে, ফেসবুকে একটা ছোট্ট  স্টেটাস-- অমুক, তোকে ফোনে পাচ্ছি না... কাজ শেষ। ফাউ পেয়ে যাবেন চোখের জল, হাত তালি, রাগ, স্মাইলি, লাভ সব ধরণের ইমোজি!

এতে কোনো অসুবিধা নেই। ফেসবুকে অনেক সুবিধা। অসুবিধাও অনেক। যেহেতু পাড়া ছাড়িয়ে বন্ধুত্ব। আপনার পরিচিত বন্ধুদের তালিকা দেখে আপনার ব‍্যক্তিগত তথ‍্য হাতিয়ার করে বিব্রত করার যথেষ্ট সুযোগ। তাই ব‍্যক্তিগত তথ‍্য যত কম দেওয়া যায় তত মঙ্গল। শুধু কি তাই প্রাইভেসি বটন যতই থাক, নেট দুনিয়ায় আপনার করেসপণ্ডেস ডাটা চুরিতেও চোরের অসুবিধা নেই। তাই তো সহজেই আপনার কনটেন্ট যেমন পছন্দ না হলে বাদ দিতে পারেন জুকারবার্গ সাহেব। কারণ হিপোক্রিশি কোনযুগে ক্লিশেই হয় না!

একবার কনটেন্ট কর্তৃত্ব নিয়ে আটত্রিশ হাজার ফেসবুক ব‍্যবহারী একজোট হয়ে অভিযোগ করেন। দুহাজার নয় সালের সতেরো ফেব্রুয়ারি জুকারবার্গ সাহেব বাধ‍্য হন লিখতে যে ওই জায়গাটা পরিবর্তন করা হচ্ছে না। যদিও তারপরও পরিবর্তনের কাজ থেমে নেই। 

এসব লেখার উদ্দেশ্য যে পৃথিবীতে বাস করবো, আর সেই পৃথিবী নিয়ে কিছু ভাবনা থাকবে না, তা হতে পারে না। আর সেটা লেখার শুরুতে আমার নিজেকে মনে হচ্ছে আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ‍্যায়ের "তিন নম্বর বেঞ্চ" গল্প থেকে বেরোতে না পারা কারো অপেক্ষায় বসে থাকা সেই আহাম্মক ব‍্যক্তিটি, যিনি রাগতভাবে আমায় বলছেন,

"একজন অজ্ঞাত কুলশীলের রহস্যময় বার্তা পেয়ে লেকের ধারে শীতের রাতে সাড়ে নটায় দেখা করতে আসাটা কি অবিমৃশ‍্যকারিতা নয়? একজন গুণ্ডা, অপহরণকারী, ব্ল‍্যাকমেলার বা খুনিও তো হতে পারি।" স্ত্রী খুনের দায়ে এক বছর জেল খাটা ব‍্যক্তি (যদিও পরে বেকসুর খালাস প্রাপ্ত) বলছেন। আর আমি বোকা বোকা থ্রিল নিয়ে শুনছি। এটা বুঝতে গেলে চট করে গল্পটা পড়ে ফেলুন। আর পড়া থাকলে কোন অসুবিধা নেই। ফেসবুকে অনেক প্রপাজ্ঞাণ্ডিস্ট আছেন যাদের কাজ সুক্ষ ও সুচারুভাবে নিজের কাজ চালিয়ে যাওয়া। সেটি ধর্ম হতে পারে, রাজনীতি, ভোট রাজনীতি, ধর্ম রাজনীতি বা দেশ বিরোধীতা আবার কখনও স্ববিরোধীতা। যারা আপনার কমেন্ট স্টাডি করে আপনাকে মার্ক করে। আর আপনাকে টার্গেট করে সমমতাদর্শ মিলে দলগতভাবে রিপোর্ট মারে। আর ফেসবুক আকা কমিউনিটি স্টাণ্ডার্ড বলে একটি একপেশে অফিস খুলে রেখেছে। সেটা দেখলে শীর্ষেন্দুবাবুর সেই গল্পের আসামীর কথা মনে পড়ে-- সরকার মানে হচ্ছে একটি সিস্টেম। আর এই সিস্টেমটা যারা চালায় তাদের অধিকাংশ হলো যন্ত্রাংশের মতো। সিস্টেমটা যা বলায় এবং করায়, তারাও তাই বলে এবং করে। 

হেট স্পিচ কলামে নির্দিষ্ট করে বলা আছে সমকামিতা, জাতি বিদ্বেষ বা ইসলামফোবিয়া নিয়ে কিছু বলা যাবে না। কিন্তু হিন্দু ফোবিয়া নিয়ে বলা যাবে না, এমন কথা বলা নেই। অথচ অসহিষ্ণুতা নিয়ে বলা যাবে। তাই বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের অসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে হিন্দু সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে "সুনাম নেই, সুনাম গঞ্জে" শিরোনামে একটি কবিতা লিখি। পোস্ট করি সাহিত্য প্রবাহ নামে একটি সাহিত্য গ্রুপে। ব‍্যস! অভিযোগ হয়। ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট‍্যাণ্ডার্ড আমার একাউন্ট রেসট্রিক্ট করে আমাকে মেসেজ করে। এটা নাকি হেট স্পিচ। কবিতাটি ফেসবুক থেকে সরিয়ে নেয়। অথচ যখন ভারতে তাবরেজ আনসারি খুন নিয়ে সোচ্চার হয়ে কবিতা লিখি কোন অসুবিধা হয়নি। একটি ঘটনার উল্লেখ করি, বাংলাদেশে এক হুজুরকে পুলিশ গ্রেফতার করার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একজন কবি শ্রীকৃষ্ণের উপস্থাপন করতে গিয়ে কাঁচা খিস্তি দিয়ে যা বললেন, তা এখানে উল্লেখ করা উচিৎ হবে না। আমি ফেসবুক কমিউনিটি স্ট‍্যাণ্ডার্ড নিয়ম অনুযায়ী যথা স্থানে অভিযোগ করলাম। উত্তর পেলাম -- অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে। উক্তিটি ফেসবুক কমিউনিটি স্ট‍্যাণ্ডার্ড বিরোধী নয়। অর্থাৎ হিন্দু ফোবিয়ায় কোন বাধা নেই! আমি সেই কবিকে অবশ্যই উত্তর দিয়েছিলাম। কারণ আমি একজন সাধারণ বুদ্ধিহীন (বুদ্ধিজীবী নই) সেক‍্যুলার তকমার প্রত‍্যাশী নই। তবে যেকোন গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে।

তবে বাঙালি অবিমৃশ‍্যকারী হিসেবে আমি আরেকটি অপরাধ  করে বসলাম একইভাবে। অন্তত ফেবু কর্তারা তাই মনে করলেন। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ‍্যাপক হিন্দু দেবদেবী নিয়ে কু-মন্তব‍্য করেন। বাংলাদেশের হিন্দু ঐক‍্যজোট মামলা করলে আইনী বেকায়দায় ক্ষমা চান ওই অধ‍্যাপক। ক্ষমাও পেয়ে যাবেন। কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মের উপর আক্রমণের উপর প্রতিবাদ করায় নির্মমতার শিকার অনেকেই। তাদের কোন উপায় নেই! জেলে পঁচে মরা ছাড়া। সেটা  বলতে গেলেই একাউন্ট রেসট্রিক্টেড হবে। তাই সিস্টেমে চলা ফেসবুক, অমানবিক সামাজিক মাধ্যম ছাড়া কিছুই নয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ‍্যায়ের  "তিন নং বেঞ্চ"  ছোট গল্পের সেই অভাজনের একটি ফ্রী জ্ঞান আপনাদের সাথে শেয়ার করে লেখার ইতি টানতে চাই-- এখানে "সময় মতো পরিস্থিতি বুঝে ভয় পাওয়াটাও বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণের  লক্ষণ।"

(www.theoffnews.com - facebook)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours