তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

কলকাতা তথা বঙ্গদেশের মদ্যপানের ইতিহাসে সব থেকে উজ্জ্বল সময় বোধহয় অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দী। তার আগে বাঙালিরা মদ্যপান করত না এমন নয়, করলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল একেবারে উচ্চবিত্ত এবং দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের মধ্যে। সাধারণ মানুষের মধ্যে লুকিয়ে-চুরিয়ে কেউ কেউ মদ খাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও সমাজের ভয়ে প্রকাশ্যে মদ খাওয়ার প্রচলন ছিল না।

কলকাতার প্রকৃত নগরায়ন শুরু হয় পলাশির যুদ্ধের পর থেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে বাংলার শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সমগ্র পূর্ব ভারতের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে কলকাতা। ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য করে বা তাদের ব্যবসা-সহায়ক হয়ে এক শ্রেণির মানুষের হাতে জমে উঠতে থাকে প্রভূত ধনসম্পত্তি। দুর্গাপুজো হয়ে ওঠে বিত্তবান শ্রেণির বৈভব প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম। আর সেই কাজের পথপ্রদর্শক হলেন নবকৃষ্ণ দেব। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর সিরাজের বিশাল টাকার সম্পত্তির একটি ভাগও নবকৃষ্ণ পেয়েছিলেন। উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে নিজের বাড়িতে তৈরি করলেন একটি সুবিশাল সাত-খিলানের ঠাকুর পুজোর দালান। যুদ্ধ-জয়ের স্মারক হিসাবে তিনি ওই বছরই সূচনা করেন দুর্গোৎসবের।

কলকাতার মানুষ সেই প্রথম দেখল, দুর্গাপুজোর মোচ্ছব কাকে বলে! পনেরো দিন ধরে চলেছিল সে উৎসব। এক দিকে সনাতন রীতি-পদ্ধতি মেনে পুজোর পাশাপাশি নাচ-গান-আমোদ-আহ্লাদের ফোয়ারা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা হল বিখ্যাত সব বাঈজিদের। রাজা নবকৃষ্ণই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গোৎসবে সাহেবদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। পুজোকে কেন্দ্র করে বাঈজি-নাচ আমোদ-আহ্লাদের আয়োজন করে নিজের উন্নতির পথ আরও সুগম করে তোলেন। লর্ড ক্লাইভ ছাড়াও সে যুগের বহু গণ্যমান্য সায়েব-সুবো এ বাড়ির পুজোয় নাচ দেখতে, খানাপিনা করতে এসেছেন একাধিকবার।

মদ্যপানে আসক্তি ছিল রাজা রামমোহন রায়েরও। রামমোহনের কলকাতা বাস পর্বে বাঈজি নাচ, মদ্যপান ছিল তাঁর জীবনযাপনের অঙ্গ। মদ্যপানের পক্ষে সওয়াল হিসেবে তিনি রামচন্দ্র দাস ছদ্মনামে ‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’ নামে এক বইও লেখেন। সেখানে ব্রাহ্মণদের মদ খাওয়াকেও অন্যায় বলেননি। তবে তিনি নিজে খুব হিসেব করে মদ খেতেন। প্রতি গ্লাস মদ খাওয়ার সময়ে একটা করে টাকা পকেট থেকে বের করে সামনে রাখতেন, যাতে বুঝতে পারেন, কতখানি মদ খাওয়া হল। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সামনে জমে গেলে তিনি খাওয়া বন্ধ করতেন।

কবি-সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন বেশ প্রাচীনপন্থী। প্রগতিশীল কাজকর্মে তাঁর বিশেষ সমর্থন ছিল না, কিন্তু মদ্যপানের বিরুদ্ধে তিনি তেমন কিছু লেখেননি কারণ তিনি নিজেই মদ্যপান করতেন। মদ্যপান করতেন ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও। বলা হয়, প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিরহে তিনি নাকি মদ খাওয়া আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু পরে আর সে অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। অত্যাধিক পরিশ্রম এবং মদ্যপানই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর মৃত্যুর কারণ।

দেবদাস শরৎচন্দ্রের প্রথম দিককার উপন্যাস। ... উপন্যাসটি তিনি রচনা করেছিলেন মাতাল হয়ে এবং বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে ১৯১৩-তে লেখা এক চিঠিতে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, 'ওই বইটা [দেবদাস] একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাবুদের মদ্যপানের সরস বর্ণনা পাওয়া যায় ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য়। বাঙালি ‘বাবু’শ্রেণি এবং তাদের দেখাদেখি ‘ইতরজন’ নানা পালাপাব্বনে সোমবচ্ছর কেমন মদ্যপানে বুঁদ হয়ে থাকত তা জানা যায় হুতোমের লেখা থেকে। তবে সিংহবাবু নিজেও মদ্যপান করতেন তার আভাস পাওয়া যায় সমকালীন বিভিন্ন লেখায়।

 মহাকাব্য থাক, একটু বাংলার দিকে তাকানো যাক। ‘গৌড়’ নামটির পিছনে নাকি রয়ে গিয়েছে এই ভূমিতে তৈরি মদ ‘গৌড়ী’। গুড় থেকে তৈরি গৌড়ীর কদর ছিল সারা দেশেই। গুড় তৈরি এবং গোষ্ঠীগত পানের এক অসামান্য বর্ণনা রয়েছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘গৌড়মল্লার’-এ। এই উপন্যাসেই রয়েছে কর্ণসুবর্ণ নগরীর ‘শৌণ্ডিকালয়’ বা পানশালার বর্ণনাও। মদ নিয়ে যে গৌড়জনের একটা ক্রেজ ছিল, সেই সাক্ষ্য পাওয়া যায় নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’-এ। নীহাররঞ্জন জানাচ্ছেন, চর্যাপদের একাধিক গীতিতে শৌণ্ডিকালয় বা শুঁড়িখানার উল্লেখ ছিল। তাঁর অনুমান, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে মদ্যপান খুব একটা গর্হিত বলে বিবেচিত হত না। তবে মদ খেয়ে বাড়াবাড়ি অথবা মদের জন্য হ্যাংলামির উল্লেখ সে কালের কোনও সাহিত্যে নেই। মদ্যপান ও তার অনুষঙ্গ হিসেবে ঝামেলা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবেই ধরা হত বলে মনে হয়।

সুলতানি বা মোগলাই শাসনে পাবলিকের মদ্যপানের চরিত্র খুব বেশি বদলেছিল বলে মনে হয় না। গণস্মৃতি হাতড়ালে যে ঘটনাটা সর্বাগ্রে উঠে আসে, তা প্রভু নিত্যানন্দের সঙ্গে জগাই-মাধাইয়ের সংঘাত। মদ না খেলে এই দুই ‘নরাধম’ এহেন গোলমালে যেতেন কিনা সন্দেহ আছে। আর গোলমাল না হলে তাঁদের ‘উদ্ধার’-ও হত না। সুতরাং পরোক্ষে হলেও মদের একটা ভূমিকা এ ক্ষেত্রে থেকেই যাচ্ছে। চৈতন্যের সমসময়ে বা তার পরবর্তীকালে বাংলায় শাক্ত ধর্মের প্রসার মদ্যপানের বিষয়টাকে জলভাত করে দেয় বলেই মনে হয়। এক দিকে যদি পান-বিরোধী বৈষ্ণবরা থেকে থাকেন, তবে অন্য দিকে ছিলেন পান-সমর্থক শাক্তরা। শক্তিরঙ্গ বঙ্গভূমে পানকে তেমন দোষ বলে কি ধরা হত? রামপ্রসাদ তো মদ, শুঁড়ি, ভাটিখানার রূপকে লিখেই গিয়েছেন অমর কাব্য— ‘সুরাপান করিনে মা, সুধা খাই জয় কালী বলে’।

আসলে মদ যে বরাবরই সার্বজনীন। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - wine Kolkata)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours