দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:

চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে গেল উল্টো রথের আরও একটা পুণ্য দিন। অনাড়ম্বর, জৌলুসহীন, নিঃশব্দ। জগন্নাথদেবকে রথযাত্রা দর্শন করতে পারলে আর পুনর্জন্ম হয় না, এমনটা শাস্ত্রে বলে। তবে সেটা উল্টোরথ না সোজা রথ এমন নিদান মনে হয় দেওয়া নেই। তাই উল্টোরথে মনে মনে ডানা মেলে দিলাম, আমার দেখা ক'খানি রথের খবর পৌঁছে দেব বলে। তার সঙ্গে পুরোনো গল্পগাছা একটু করে নেওয়া যাবে।

চন্দননগরের রথ বেশ বড়সড়। জন সমাগম ভালোই হয়, লক্ষ্মীগঞ্জের রথতলা থেকে তালডাঙা অবধি রথ চলে যায় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে। সেখানে ভোগারতি সেরে তিন ভাইবোন সেইদিনই সেবায়েতদের কাঁধে চড়ে চলে আসেন জগন্নাথ বাড়িতে। জগন্নাথ বাড়িতে মেলা থাকে সাতদিন, অন্য সময় না হোক, এই সময় দর্শনার্থীরা তাঁর বাড়ি যান। উল্টো রথে চড়ার জন্য আবারও তিন ভাইবোনকে নিয়ে যাওয়া হয় আর ফেরানো হয় রথে করে।       

পুরীর 'আসল' জগন্নাথদেবের তিন ভাইবোনকেও দৈতাপতিগণ রথে ওঠানো এবং নামানো করান। সারাদিন ধরে যে কী আয়োজন, কী বিপুল আয়োজন সে এখন দূরদর্শনের সৌজন্যে সকলেই দূর থেকে দর্শন করতে পারে।

নেহাতই বালিকা বেলায় একবার পুরীর রথযাত্রা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। 'পুনর্জন্ম' ব্যাপারটি  সেই বয়সে বোধগম্য না হলেও দাদুর মুখে সেই মহৎ বিষয়টির কথা বারবার শুনে মনে হয়েছিল বিরাট কিছু দেখার সুযোগ এসেছে বুঝি। কিন্তু দাদু পুরীর রথ কেন, ৮৪ বছরের জীবনে একবার জগন্নাথদেব দর্শনেও কেন গেলেন না, বাড়ির শালগ্রাম শিলা 'শ্রীধর'এর সেবা নিয়েই থেকে গেলেন ভেবে পাইনি। প্রায় একশ'বছর আগে ময়মনসিংহের জমিদারপুত্র ধরণীকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর অভিজ্ঞতা পাঠে কেবল আন্দাজ করতে পেরেছি। 

আর আমার অভিজ্ঞতা? 

আমার রথ দেখার অভিজ্ঞতা বলতে গেলে শুধু পাপ হবে। বিচ্ছিরি চাপাচাপি ভিড়ের মধ্যে, যেখানে একটু হাঁটতে গেলে পা নিজের রক্তে রেঙে ওঠে, আলতা লাগে না; সারা শরীরে অতিরিক্ত চাপের ফলে প্রাণটা কোথা দিয়ে বেরিয়ে যাবে ভেবে ঠিক করতে পারে না; দু'টো পা এগোতে মাঝেমাঝে লোকের পিঠে বুকে কিল মারা ছাড়া উপায় থাকে না, সেখানে জগন্নাথদেবের মুখের দিকে তাকাতে পারলে 'পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে' শব্দবন্ধনী আশীর্বাদ হয়ে কানে বাজে। এখন পরিণত বয়সে একবার যেতে পারলে মন্দ হয় না, অতটা খারাপ নাও লাগতে পারে।   

তবে কিনা একশ কি দু' শ বছর আগে যাতায়াত, থাকা খাওয়া, সর্বোপরি রোগবালাইয়ের চিন্তা, রোগে প্রাণখানা বেরোলে দেহখানা শেয়াল কুকুরের হেফাজতে ছেড়ে সহযাত্রীরা বাড়ি ফিরে আসবে জেনেও একই রকম ভিড় পুরীধামে রথযাত্রায় হোত। আর লাহিড়ী চৌধুরী মশায়ের বর্ণনা "অগণিত মনুষ্যমুণ্ড ও যাত্রীগণের কলকোলাহলে শ্রবণ বধির হইয়া‌ যায়" — যে কতখানি সত্য, সেকথা যে দেখেছে সে বলতে পারবে। তবে রথ নিয়ে না হোক, আমরা অম্বিকা কালনাবাসী মাত্রেই গর্ব করি একটা কথা জেনে, যে, শ্রীক্ষেত্রের পাকশালাটি আমাদের বর্ধমান মহারাজা তেজচন্দ্র বা তেজচাঁদের অভাবনীয় কীর্তি। 

এই তেজচাঁদের জন্মের বহু আগে বর্ধমানরাজ চিত্রসেন রায়ের দুই মহিষীর একজন ছন্দকুমারী দেবী পুরী ভ্রমণ করে এসে কালনার গঙ্গাতীরে ছয় বিঘা জমির উপর জগন্নাথ মন্দির এবং মন্দিরে জগন্নাথদেবের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করান। নির্মাণ করা হয় পুরীর স্নান মণ্ডপের অনুকরণে দ্বিতল স্নানবেদী।রানি ছন্দকুমারীই জগন্নাথবাড়িতে রামেশ্বর শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করান।

জগন্নাথ বাড়িতে ভগ্নপ্রায় জোড়া শিবমন্দির এখনও বিরাজমান। অনুমান, বর্ধমানে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পাশে যেমন চন্দ্রেশ্বর এবং ইন্দ্রেশ্বর শিব প্রতিষ্ঠিত হয় চিত্রসেনের দুই পত্নীর সন্তুষ্টির জন্য, একই কারণে কালনায় অসাধারণ টেরাকোটা কাজের জোড়া শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় জগন্নাথ বাড়িতে। 

জগন্নাথদেবের তিনভাইবোনকে রাখলে রথযাত্রার আয়োজন তো করতেই হয়। নির্মিত হয় জগন্নাথদেবের রথ। কালনাবাসী কষ্টসাধ্য তীর্থ ভ্রমণ থেকে মুক্তি পান। কিন্তু কালের করাল ছায়া—মন্দির, স্নানবেদী, রথ সবকিছুর উপরেই পড়ে।

১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে কালনাবাসীর উদ্যোগে রথটি সংস্কার করা হয়। লোহার ফ্রেমে বাঁশের তৈরি ১২ ফুট উচ্চতার রথ নতুন রূপে সেজে ওঠে। যদিও টেরাকোটার কাজের মন্দিরের সংস্কার করা আর সম্ভব হয়নি। জানি না বর্তমানে সে রথ কেমন আছে।

কালনার রাজবাড়িতেও একখানি রথ আছে, এবং বেশ ভালো ভাবেই বেঁচেবর্তে আছে। যেখানে যে রথই থাক সেরা ছিল আমাদের লক্ষ্মণপাড়ার শ্যামচাঁদের রথ। আমাদের ছোটোবেলায় তাকে সারা বছর খড়ের মোড়কে মুড়ে রাখা হোত। এখন টিনের মোড়ক রয়েছে। কেমন হয় এখনকার রথটান জানি না। আমার চোখে বহুবছর আগের মায়ার কাজল। অতিরিক্ত বাদ্যি-বাজনায় কান বন্ধ হোত না। বাদ্যি কাঁসর বাজত বটে। কাঁসরখানা হাত পেতে চাইলে পাওয়াও যেত। ছোট একফালি  লালচে মাটির রাস্তায় সে রথ পাড়ার ক'জন  মানুষের হাতে দিব্যি ঘড়ঘড়িয়ে চলত। রথের রশি একটু ছিঁড়ে রেখে দিতে কে বলেছিল, কেন বলেছিল মনে নেই, তবে প্রতিবছর রেখে দিতাম। বন্ধু নানু আর আমার ঠাকুমা এই দু'জন সারা বিশ্বকে এনে দিত হাতের মুঠিতে। কাঁসরের আওয়াজ  আর আমাদের ডাক শুনলেই তাড়াতাড়ি করে শেষ করতে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ ফেলে ঠাকুমা একখানি লালপেড়ে শাড়ি ঘুরিয়ে পরে ছুটে যেতেন। আমি আর নানু তো কেবল খবর আনা নেওয়া করতাম। রথে পুতুল সাজানো, ঠাকুর তোলা, ভোগ আরতি থেকে রথটান শেষে আবার আরতি, ঠাকুর নামানো, পুতুল নামানো পর্যন্ত রথতলায় থাকা। আর দাদুর দেওয়া রথের 'পাব্বুনি 'দিয়ে গৌর নাগ দাদুর কাছ থেকে  পাঁপড় ভাজা খেয়ে অথবা নিয়ে বাড়ি ফেরা। রথে পাঁপড় ভাজা কিন্তু খেতেই হয়।

এমনিভাবে চলতে চলতে কখন এসে গেল এক বছরের  উল্টোরথ,আমার কাছে স্মরণীয় সেই দিন। সেবার সোজা রথ টানলেও উল্টোরথের দিনের কাঁসরের আওয়াজ দাদুর বাড়ির সানাইএর আওয়াজ ঢেকে দিয়েছিল। জানি না, ঠাকুমা বা নানু সেবারের উল্টোরথ টেনে ছিল কিনা। আমি টানিনি।

আমি আর কখনও সেভাবে রথ টানিনি। পরে মেয়েদের নিয়ে রথের মেলায় গেছি। মাটির পুতুলের শখ আমার বরাবরের। মেয়েদের সঙ্গে শখ মিটিয়েছি।

দু'বছর ধরে তো রথের মেলা চলে গেছে অতীতের বর্ণনায়। রথে ভগবান বসছেন কিন্তু ভক্তরা টানছেন না। এমন দিন এর আগে কখনও আসেনি যে, তা নয়। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে জুলাইয়ের (১২২৮ এর ১৪ই শ্রাবণ) 'সমাচার দর্পণ' বলে— "জগন্নাথ ক্ষেত্র।.... দুর্ভিক্ষ ও ওলাওঠা রোগের দ্বারা সেখানকার লোক  জগন্নাথ দেবের রথ টানে নাই ও সেখানকার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা অন্য উপায় দ্বারা রথযাত্রা সমাপ্ত করিয়াছেন।" তবে এ ইতিহাস। সে ইতিহাসে ধামা চাপা, ছাই চাপা দিয়ে দিব্যি 'রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম' চলেছে এতকাল। তাই, আমরা শুধু সুদিনের অপেক্ষায়।

(www.theoffnews.com - Rath)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours