তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

কিন্তু ফিনিশীয় সভ্যতার হেলিওপোলিস এর মন্দিরে সমবেত হত শুধুমাত্র অক্ষতযোনি কুমারীর দল। তারা তাদের কৌমার্যদান করে বিবাহিত জীবন যাপনের অনুমতি লাভ করত। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে সিরিয়ার মন্দিরেও এই প্রথা দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগের প্রারম্ভে সম্রাট কনস্ট্যানটাইন সেই মন্দিরটি ধূলিসাৎ করে সেখানে একটি গীর্জা নির্মাণ করে এ প্রথা রদ করিয়েছিলেন।

গ্রীসের ইতিহাসে দেবদাসীর উল্লেখ পাই নানাভাবে। চিরতরুণ সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরে সর্বত্রই দেবদাসী নিযুক্ত ছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর পূর্বে ও পরেও সর্বত্র সূর্যদেবের দেবদাসী নিযুক্ত করা হয়েছে। গ্রীসের মন্দিরবালাদের বলা হত Hierodule। এদের দেখা যেত গ্রীসের প্রতিটি দেবমন্দিরেই। গ্রীস সভ্যতার পর রোমান সভ্যতাতে দেবদাসীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্দিরদাসীরা যে কার্যত পুরোহিতদের মনোরঞ্জন করতেন সে সম্বন্ধে ইতিহাস বহুবিধ তথ্য প্রমাণ দিয়েছে। এই দেবদাসীদের সাথেই রাজনটী ও নগরনটীদের আবির্ভাবের কথা জানতে পারা যায়। তবে দেবদাসী ও নগরনটীরা সকলেই যে ক্রীতদাসী ছিলেন না এর পিছনে কতগুলো ধারণা দেখানো যায়, তা হল ক্রীতদাসীদের কোন রকম সামাজিক বা নৈতিক অধিকার ছিল না। এদের কোন রকম সম্মান বা স্বাধীনতা ছিল না। অপরদিকে, নগরনটীদের সম্মান আর প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট। এই নগরনটীদের গ্রীসে Hataera বলা হত। এদের গৃহে দেশের জ্ঞানী গুণীরা আসতেন। নানা বিষয়ে, আলাপ আলোচনা করতেন এবং এদের মতামত শোনা হত অর্থাৎ সমাজে এদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের পত্নী থিওডোরা নিজে একজন Hataera ছিলেন। দেবদাসীদের সম্মানিত অস্তিত্বের প্রমাণ থাকলেও তারা Hataera-দের সমতুল্য ছিল না কারণ তাদের আশেপাশে সর্বদা ধর্মের বাতাবরণ থাকত। খ্রীস্টপূর্ব ৪৬৪ বছর আগে গ্রীসে জেনোফন নামের একজন অলিম্পিক বিজয়ী অ্যাফ্রোডাইটি দেবীর মন্দিরে ১০০ জনের মতো তরুণীকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপহার হিসেবে দান করেন। কোরিন্থ শহরেও দেবী অ্যাফ্রোডাইটির মন্দির ছিল। রোমান যুগে ওই মন্দিরে প্রায় হাজারের উপর দেবদাসী ছিল।

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বালি, জাভা, সুমাত্রা, থাইল্যান্ড ও মায়ানমারেও দেবদাসীদের বিপুল সমাবেশ ছিল। দক্ষিণ আমেরিকার ইন্‌কা সভ্যতার ইতিহাসে দেবদাসীদের উল্লেখ আমরা পাই। ইনকা সম্রাটরা সকলেই ‘সূর্যের সন্তান’ বলে পরিচিত ছিল। এদের ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। ইন্‌কা রাজ্যে সূর্যের মন্দির তত্ত্বাবধানের কাজ করতেন পুরোহিতগণ। সুন্দরী মেয়েদের অল্প বয়সেই বেছে নিয়ে Cuzco বা শিক্ষালয়ে নিয়ে যাওয়া হত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে হয় স্বয়ং রাজার উপপত্নী হতো অথবা "সূর্যকুমারী" রূপে মন্দিরবাসিনী হতো। এদের কাজ ছিল পুরোহিত, রাজা ,রাজবংশীয় পুরুষদের মনোরঞ্জন এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম।

আর্মেনিয়া অথবা পারস্যে হতভাগিনীদের প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত দেবদাসীর ভূমিকায় বন্দিনী হয়ে থাকতে হত। একাধিক পুরুষ কর্তৃক দীর্ঘকাল ধর্ষিত না হলে মুক্তি ছিল না। সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি এবং রাজারাজড়ার দলও নিজ নিজ কন্যাকে ওই রতি মন্দিরে প্রেরণ করতে বাধ্য ছিলেন। সেখানে একাধিক অপরিচিত পুরুষকে দেহদানে ধন্য করে স্ত্রীলোকেরা পুরোহিতের অনুমতিপত্র হাতে নিজ নিজ পরিবারে ফিরে আসতেন। বলা বাহুল্য, তাঁদের বিবাহ হত এবং ওই দৈহিক দেবপূজার জন্যে কেউ তাঁদের ঘৃণার চোখে দেখতেন না।

দেবদাসী প্রথার ব্যাপক প্রচলন হয় অষ্টম শতাব্দীতে, পুন্ড্রবর্ধন নগরে। পুন্ড্রবর্ধন নগরের দেবদাসীরা বিলাসী এবং কামাচারপূর্ণ জীবনযাপন করত। তাদেরকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বাৎস্যায়ন তাঁর "কামসূত্র" গ্রন্থে সমসাময়িক ভারতে দেবদাসীদের সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। দেওপাড়ায় প্রাপ্ত তাম্রফলক অনুযায়ী বিজয় সেন এবং ভট্ট ভবদেব তাদের মন্দিরে শত শত দেবদাসী নিয়োগ করেছিলেন। রামচরিত এবং পবনদূত গ্রন্থে দেবদাসীদের জীবনযাত্রার সপ্রশংস বর্ণনা দেওয়া আছে। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে এইরকম দেবদাসী অথবা নাচের মেয়ের উল্লেখ পাই, যারা তৎকালীন উজ্জয়িনী নগরের ‘মহাকাল মন্দিরে’ নাচ (ভারতনাট্যম) পরিবেশন করত। সেইসঙ্গে কোণারকের সূর্য মন্দির‚ দক্ষিণ ভারতের অন্য মন্দির-সহ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে শিকড় বিস্তার করে এই প্রথা। একাদশ শতকের দক্ষিণ ভারতে অন্যতম বিখ্যাত নরপতি চোল বংশের রাজারাজ। তার এক তাম্রশাসনের বক্তব্য, রাজারাজ তাঞ্জোরের মন্দিরে সুশিক্ষিতা চারশ’ "তেলিচ্চেরি পেণ্ডুগাল" বা মন্দির-কন্যা দান করেছেন। তাদের জন্য মন্দিরের চারপাশে উত্তম বাসগৃহ নির্দিষ্ট হয়েছে। এজন্য তাদের কোন কর দিতে হয় না।

দক্ষিণ ভারতে ‘দেবদাসী’ বলা হলেও উত্তর ভারতে এই রীতির নাম ছিল ‘মুখি’। এই প্রথা যখন প্রচলিত হয়, তখন প্রথা এবং প্রথার সঙ্গে জড়িত দেবদাসীদের অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে দেখা হত। তাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ, জমি বরাদ্দ থাকত। তারা হয়ে ওঠে মন্দিরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের নাচ-গান ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিল দেবতাদের আরাধনা। সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ নিজেদের কন্যাকে উৎসর্গ করতেন দেবদাসী হওয়ার জন্য। বয়ঃসন্ধির আগেই করা হত উৎসর্গ। তারা যেন ভালো দেবদাসী হয়ে উঠতে পারে তাই ছোটবেলা থেকেই নিতে হত নাচ গানের কঠোর প্রশিক্ষণ। কন্যা উৎসর্গ করার রীতি দক্ষিণ ভারতে ‘মুট্টুকাট্টুভাডু’ এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ নামে পরিচিত। ‘মুট্টুকাট্টুভাডু’ মানে দেবতার সঙ্গে বিয়ে এবং ‘দেভারিগে বিদুভাদু’ এর অর্থ নিজেকে দেবতার কাছে উৎসর্গ করা। ইতিহাস খ্যাত নরপতি কৃষ্ণদেব রায়ের বিজয়নগর পরিভ্রমণের বিবরণেও (১৫২০-২২ সাল) উঠে এসেছে দেবদাসীদের বৃত্তান্ত। কৃষ্ণদেব রায় যখন রাইচুর অভিযানে যাত্রা করেন তখন তার বাহিনীতে নাকি সাত লাখ তিন হাজার পদাতিক, বত্ৰিশ হাজার ছয় শ’ অশ্বারোহী ছিল। এই বিরাট বাহিনীর সঙ্গে প্রমোদ-কন্যা দেবদাসীও ছিল প্রায় কুড়ি হাজার। কিন্তু এক ব্যাপারে কৃষ্ণদেব রায় রীতিমত সদাচারী ছিলেন বলা চলে। তার অন্দরে রানীদের বারো হাজার দাসী এবং সহচরী থাকলেও বিজয়নগর অধিপতির পত্নী ছিল মাত্র বারোজন। বলা অনাবশ্যক, তার পূর্বসূরীরা সবাই কিন্তু এমন সদাচারী নরপতি ছিলেন না।

তবে, এটি ছিল প্রথম দিকের অবস্থা। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই সম্মানের উৎসর্গ আর এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলো না। বোঝা গেল‚ পাথরের বিগ্রহকে উপেক্ষা করে মানুষই ভোগ করতে পারে ‘দেবদাসীকে’। পুরোহিতদের অবক্ষয় আর যৌন-লালসার কারণে মেয়েদের কেনা বেচা শুরু হল। এমনকি লুঠ করে পর্যন্ত নিয়ে আসা হত। আর এর পেছনে দারিদ্র্যতা মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতো। হতদরিদ্র ও নীচু জাতের মা বাবা’রা তাদের কুমারী মেয়েকে ঋতুবতী হওয়ার আগেই নিয়ে আসত মন্দিরে। সেখানে প্রথমে কুমারী মেয়েদের নামমাত্র মূল্যে নিলাম করা হত। তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ভগবানকে উৎসর্গের নামে কল্পিত দেবতার সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন। উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার থাকত মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের। দেবতার সঙ্গে বিয়ের পর গরিব ঘরের সেই মেয়ে হয়ে যায় দেবদাসী বা যোগিনী। আক্ষরিক অর্থে সেবাদাসী বা যৌনদাসী। এরপর সারা জীবন আর অন্য কোনো পুরুষ মেয়েটিকে আর বিবাহ করতে পারত না। নামমাত্র খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরেই কাটাতে হয় তাদের জীবন। যৌন লালসার শিকার হতে হয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে অন্যান্য পুরুষদের। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেবদাসীদের আগমন ঘটায় তাদের মধ্যে তৈরি হয় শ্রেণি। যাকে দেবতার জন্য উৎসর্গ করা হত‚ তিনি "দত্তা", লুঠ করে আনা হলে তিনি "হ্রুতা", কেনাবেচা করা হলে সেই মেয়ে "বিক্রিতা"‚ কেউ নিজেই নিজেকে দেবতার পায়ে উৎসর্গ করলে তিনি "ভক্ত দেবদাসী"‚ অলঙ্কারসহ কাউকে উৎসর্গ করা হলে তিনি "সালঙ্কারা", আর যদি কেউ দেবদাসী হয়ে নিয়মিত পারিশ্রমিক পেতেন‚ তিনি "গোপীকা" বা "রুদ্রাঙ্গিকা"। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - prostitution)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours