তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

১৮২৯ সালের ১৩ আগস্ট তার এমডি উপাধিপ্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে প্রদত্ত ভোজসভায় গঠিত হয় জার্মান সেন্ট্রাল হোমিওপ্যাথিক ইউনিয়ন। ১৮৩১ সালে তিনি হোমিও মতে কলেরা রোগের চিকিৎসা নামক গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৩৩ সালে তিনি লিপজিগে একটি হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল স্থাপন করেন। একই বছরে অর্গাননের পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশ করেন। ১৮৩৪ সালে আমেরিকার সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক হেরিং হোমিওপ্যাথির অসারত্ব প্রমাণ করতে এসে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি স্বদেশ গিয়ে হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

ভাষাবিদ, অনুবাদক ও লেখক হিসেবে হ্যানিম্যানের যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। তার জানা ১১টি ভাষায় লেখা হিপোক্রেটিস থেকে শুরু করে পরবর্তী আড়াই হাজার বছরের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস পড়েন ও এর বিশ্লেষণ করেন। তিনি বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষিবিদ্যা, দর্শন ও সাধারণ সাহিত্যকর্ম বিষয়ে বিভিন্ন ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় অসংখ্য বইপত্র অনুবাদ করেন। প্রতিটি অনুবাদেই তিনি প্রয়োজনীয় মন্তব্য ও ব্যাখ্যা দিতেন। তা অনেক সময় মূল লেখা থেকেও বেশি আকর্ষণীয় হতো।

তিনি প্রায় ১১৬টি বৃহৎ গ্রন্থ ও অসংখ্য ছোট প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে শুধু ২৩টি রসায়ন শাস্ত্রের। রসায়ন বিদ্যা ও ওষুধ প্রস্তুতকারক হিসেবেও তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তিনি এ বিষয়ে অনেক মৌলিক প্রবন্ধ ও বই রচনা করেন। হ্যানিম্যানের এসব অবদানের জন্য প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রফেসর বার্জেনিয়ার্স তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। হ্যানিম্যান পরীক্ষার লক্ষ্যে নিজের দেহে ৯৯টি (গার্থবোরিক ও ডা. রিচার্ড হেলের মতে ১০০টি, ডা. জেমস ক্রস ও ডা. আর ই ডাজেনের মতে ৯০টি) ওষুধ প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু এ নতুন ওষুধ প্রস্তুত ও প্রচলন এবং একজন চিকিৎসক হয়ে নিজের ওষুধ নিজে প্রস্তুত করায় লিপজিগ অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতারা হ্যানিম্যানের চরম বিরোধিতা করেন। এমনকি তাকে লিপজিগ থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করেন।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন হ্যানিম্যান। অ্যালোপ্যাথিক গ্রন্থকার ডা. হিউজেস বেনোউ, লন্ডনের রয়াল মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. ইভান্স, ফিলাডেলফিয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. বেঞ্জামিনরাশ সহ অনেক বিশ্ববিখ্যাত অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকের উক্তিতে দেখা যায়, অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরোগ্যের কোনো মৌলিক নীতি নেই। অন্যদিকে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সার্জন এবং বায়োলজির গবেষক ডা. আগস্ট বায়ার হোমিওপ্যাথি অধ্যয়ন ও চর্চা করার পর লিখেছেন, হ্যানিম্যান আমাদের চেয়ে এক শতাব্দী এগিয়ে আছেন। 

ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক স্যার জন ওয়্যার বলেন, হোমিওপ্যাথিকে যাচাই করতে এসে হোমিওপ্যাথ হয়ে গেছি। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মরগ্যান বলেন, আরোগ্যের বিশ্বজনীন নিয়ম আবিষ্কার এবং ভেষজ বস্তুকে শক্তিকৃত করে ব্যবহার করার নিয়ম প্রবর্তনের অক্ষয় সম্মান ও খ্যাতি হ্যানিম্যানের প্রাপ্য। 

হ্যানিম্যান মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। কথিত আছে, তার চেম্বারে এত রোগী হতো যে, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম পড়ে যেত। প্যারিসে আট বছর অবস্থানকালে তিনি চিকিৎসা সূত্রে চার লাখ ফ্রাঙ্ক আয় করেন। ১৮৪৩ সালের ২ জুলাই ভোর ৫ টায় প্যারিসে নিজ ঘরে আর্তজনের হ্যানিম্যান জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১১ জুলাই প্যারিসের মন্ট হ্যাচারি গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

হ্যানিম্যান পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন হোমিওপ্যাথির পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নের সাধনায়। চিকিৎসা জগতে দুর্যোগের ঘনঘটা তাকে আশঙ্কামুক্ত করতে পারেনি। তাই তিনি গবেষণার পাশাপাশি চিকিৎসক সমাজের দায়িত্বহীনতা, চিকিৎসার নামে অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।

হ্যানিম্যান ছিলেন নীতিতে অটল এক মানুষ। শত বাধাও তাকে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি সব চিকিৎসককে আদর্শ-নিয়মে বৈজ্ঞানিক ও নির্ভরযোগ্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির অনুসারী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তিনি টনিক, মলম, ইনজেকশন এবং ওষুধের মূল আরক ও স্থূল মাত্রার ওষুধ প্রয়োগের চরম বিরোধিতা করেন। যারা এ ধরনের নীতিহীন চিকিৎসা করেন, তিনি তাদের উভয় লিঙ্গ, জারজ ইত্যাদি বলে মন্তব্য করেন। হ্যানিম্যানের আত্মোৎসর্গের সুফল তার জীবনকালেই পৃথিবীতে বৈপ্লবিক সাড়া জাগায়। তাই তো বিদায় বেলায় তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘ইহজগতে আমি বৃথা জীবন ধারণ করি নাই। ’

ডা. হ্যানিম্যান দুবার বিয়ে করেন। জার্মানির গোয়েরনে থাকার সময় তিনি প্রায় ২৮ বছর বয়সে ১৯ বছরের জোহনা হেনরিয়েটি লিও পোলডিনি কুসলারকে ১৭৮২ সালের ১৭ নভেম্বর বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন হ্যানিম্যানের দুঃখ, দারিদ্র্য, নিপীড়িত ও যাযাবর জীবনের সুযোগ্য সহধর্মিণী। তার গর্ভে হ্যানিম্যানের দুই ছেলে ও নয় মেয়ের জন্ম হয়। তারা হলেন হেনরিয়েটি, ফ্রেডিক, ভিলহেলমিনি, এমিলি, ক্যারোলিনি, আনস্ট, ফ্রেডিকি, ইলিওনোরি, চার্লোটি ও লুইসি। ১৮৩০ সালের ১৩ মার্চ জোহনার মৃত্যু হয়।

১৮৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি জার্মানির কোথেনে অবস্থানের সময় হ্যানিম্যান প্রায় ৮০ বছর বয়সে মাদার মেরি মেলানি ডি হারভিলি নামে ৩২ বছর বয়সী এক ফরাসি মহিলার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি অত্যন্ত সুন্দরী, বিশিষ্ট চিত্রকর ও নামকরা কবি ছিলেন। হ্যানিম্যানের চরম সাফল্যের দিনগুলোতে তিনি সুযোগ্য সহধর্মিণী হিসেবে যথেষ্ট অবদান রাখেন। শেষ জীবনে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। হ্যানিম্যানের চিকিৎসার কাজেও তিনি সহযোগিতা করতেন। মাদার মেলানি নিঃসন্তান ছিলেন; কিন্তু হ্যানিম্যানের মৃত্যুর কিছুদিন আগে হ্যানিম্যানের বিশেষ অনুরোধে সোফি বোরার নামে পাঁচ বছরের এক মেয়েকে মেলানি তার পালিতা মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেন। অপরদিকে, দ্বিতীয় বিয়ের প্রায় চার মাস পর হ্যানিম্যান তার সব সম্পত্তি কন্যা ও অন্যান্য উত্তরাধিকারীর নামে উইল করে দিয়ে যান।

হ্যানিম্যান মাত্র ২৪ বছর বয়সে এমডি ডিগ্রিধারী চিকিৎসক হিসেবে জার্মানির ম্যানস্ফিল্ড প্রদেশের হেটস্টেড শহরে প্রথম চিকিৎসা শুরু করেন। এখান থেকে তিনি দেশাই শহরে যান এবং রসায়ন শাস্ত্রে বিশেষ মনোনিবেশ করেন। পরে তিনি শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ রূপে খ্যাতি লাভ করেন। চিকিৎসা পেশায় আত্মনিয়োগের পর প্রচলিত পদ্ধতির ওপর তার সন্দেহ গাঢ় হতে থাকে। তিনি প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি পরিত্যাগ করে সাহিত্য ও রসায়ন শাস্ত্র আলোচনা করার মনস্থ করেন।

১৭৮৫ সালে হ্যানিম্যান ড্রেসডেনে আসেন। এখানে তিনি প্রায় এক বছর শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেন ও চিকিৎসাবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করেন। ড্রেসডেনে থাকার সময় অ্যালোপ্যাথির প্রতি তার আরও বিরাগ জন্মে। এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ও মতামত বিভিন্ন প্রবন্ধে প্রকাশ করেন। যদিও হোমিওপ্যাথি নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে। কারণ বিজ্ঞানীরা বলছেন এটা বিজ্ঞান সম্মত নয়। কিন্তু  বিজ্ঞান ও মানব শরীরের সমস্ত সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

তাই বিতর্ক চলুক এটা স্বাস্থ্য সম্মত, সত্য সামনে আসবে, প্রকট হবে। কিন্তু আমার লেখার উদ্দেশ্য বিজ্ঞান চর্চা নয়। এই সাধক মানুষটির জীবন কথা ও বোধকে সামনে নিয়ে আসা। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Hahnemann homoeopathy)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours