তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

আসলে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে কলকাতা মহানগরীতে ইংরেজদের সহযােগিতায় নবকৃষ্ণের মতাে জমিদার বা রূপলাল মল্লিকের মতাে বেনিয়ানরা, যাঁরা প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে বাঙালি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তাদের তখনও পর্যন্ত কোনাে স্পষ্ট সাংস্কৃতিক রুচি গড়ে ওঠেনি। মুঘল রাজদরবারের ধ্বংসাবশেষের প্রতিনিধিরূপে বাঈ নৃত্যের পাশাপাশি গ্রাম বাংলা থেকে শহরে আগত লােকসংস্কৃতির নতুন অভিব্যক্তি কবিগান, আখড়াই-এর নব্যরূপ ইত্যাদির সহাবস্থান সে যুগের কলকাতার সাংস্কৃতিক জগতের এক কৌতুহলােদ্দীপক বৈশিষ্ট্য। এক যুগ পরিবর্তনকালীন অবস্থায় এক শ্রেণির সাংস্কৃতিক চিন্তায় ও চর্চায় যে অসামঞ্জস্য ভাবধারার অরাজকতা ঘটেছিল, তার সব চেয়ে প্রকৃষ্ট নিদর্শন—শােভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেবের রাজবাড়ির অনুষ্ঠানগুলি। মুঘল বাদশাহ শাহ আলম দ্বারা মহারাজ উপাধিতে বিভূষিত নবকৃষ্ণ একই সঙ্গে নতুন ইংরেজ শাসকদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, যখন ১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের পর পলাতক ইংরেজদের তিনি খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপােষকতায় যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তার জীবনীকার লিখছেন,

“খ্যাতনামা গীতিকার হয়ে ঠাকুর এবং নিতাই দাস (সে যুগের বিখ্যাত কবিওয়ালা হয় ঠাকুর ও নিতাই বৈরাগী) তারই আশ্রিত ছিলেন। কলকাতার সমাজে ‘নচ’ (বাঈজী নাচ) ঢােকালেন তিনি এবং তাকে জনপ্রিয় করে তুললেন। ইংরেজদের ধারণা সাধারণ্যের প্রমােদ ব্যবস্থায় এটা আমাদের প্রধান উপকরণ। এ হলাে বাঈ না।”

নবকৃষ্ণের ইতিহাস-প্রসিদ্ধ নাচঘরে বাঈনাচের বিবরণ আমরা ইতিহাসে পাই, “ঝাড়বাতি জ্বলছে। টানাপাখা দুলছে। নাচঘরের পুবমাথায় তাকিয়ার ওপর মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন নবকৃষ্ণ দেব। তার পরণে জোড়। মাথায় খিড়কিদার পাগড়ি। পায়ে লপেটা-পাদুকা। তাঁর দু-পাশে বসে আছেন দামী পােশাক পরা এদেশীয় ইয়ার-বন্ধুরা। নবকৃষ্ণ তখন চব্বিশ বছরের তরুণ। নাচঘরের পশ্চিম দিকে সােফার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছেন ক্লাইভ সাহেব। তাঁর দু-পাশে বসে আছেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পনির হােমরা চোমরারা। সবারই পরণে আঠারাে শতকের ইউরােপীয় পােশাক। সবারই হাতে পানপাত্র। পর্তুগিজ খানসামা পানীয় পরিবেশন করছে। ঘরের দক্ষিণ দিকে বসে আছে বাজনাদাররা। মাঝখানে বাঈজী নাচছে। গান গাইছে।"

কে এই বাঈজী? কী তার নাম? কেউ বলেন বুলবুল, কেউ বলেন ময়না, আবার কেউ বলেন মুনিয়া। ক্লাইভ তার নাম দিয়েছেন জেম। সাহেব আর বাবুদের দেওয়া নামের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে তার আসল নামটি। মুনিয়ার বয়স কত হবে? খুব বেশি হলে আঠারাে। যৌবন উপছে পড়ছে তার শরীরে। অঢেল তার রূপ। যেন কোনাে বিখ্যাত শিল্পী মাটি দিয়ে নিজের হাতে তৈরি করেছেন তার শরীরটা। তারপর মনের মতন করে তাতে বুলিয়ে দিয়েছেন রঙের তুলি। এরকম কাম-উদ্দীপক শরীর কলকাতার নারীদের মধ্যে নেই বললেই চলে। তার নাচ? যেন কল্পনার স্বর্গ থেকে বাস্তবের পৃথিবীতে নেমে এসেছে অপ্সরা রম্ভা। কলকাতার প্রথম মুজরােয় এরকম আশ্চর্য তয়ফার আবির্ভাবের কথা ভাবাই যায় না। আর তার গান? গলা? সুর? এরকম মিষ্টি গলা কলকাতার বাবুরা আগে কখনাে শােনেননি। খাঁটি বিলিতি সাহেব ক্লাইভও শােনেননি এরকম মনভােলানাে সুর।

মুনিয়া একটা গান শেষ করতে না করতেই বাবুদের কাছ থেকে আর একটা গানের ফরমাস আসছে। তার নাচ দেখে গান শুনে খুশি হয়ে বকশিশ হিসেবে বাড়িয়ে ধরছেন মুঠো ভর্তি মােহর। কেউ বা তার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন দামী মুক্তোর মালা। নাচতে নাচতেই দু-হাতে মালাটা লুফে নিয়ে গলায় পরে নিচ্ছে সে। কোনাে বাবু টাকা দিচ্ছেন খেলিয়ে। এক হাতে বাড়িয়ে ধরছেন টাকা। মুনিয়া নিতে আসছে। বাবুটি অমনি অন্য হাতে টাকাগুলাে সরিয়ে ফেলছেন পাকা খেলুড়ে। কিন্তু মুনিয়াও কমতি যাচ্ছে না।

নবকৃষ্ণ বাঈজীকে বলছেন, ‘নাচো, নাচো। আচ্ছারকম নাচ দেখাও। ক্লাইভ সাহেব এসেছেন। ওঁর বন্ধুরা এসেছেন। নাচ দেখিয়ে ওঁদের আনন্দ দাও।’ বলেই তিনি ফুড়ুক ফুড়ুক করে আলবলার নল টানতে লাগলেন।…

মুনিয়া নাচতে নাচতে সাহেবদের দিকে এগিয়ে এলাে। ক্লাইভ হাততালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করলেন। মুনিয়া সাহেবের আরাে কাছে এলাে। ক্লাইভের গা ঘেঁসে নাচতে লাগলাে।..মুনিয়া নাচতে নাচতে সাহেবদের কাছ থেকে বাবুদের দিকে এগিয়ে এলাে। নবকৃষ্ণ আর তার বন্ধুরা মুগ্ধ হয়ে তার নাচ দেখছেন, গান শুনছেন।”

মুনিয়ার জন্ম লক্ষ্ণৌ শহরে। ভারতের খানদানী বাঈজীদের জন্ম এই শহরেই। বাঈজী -মহল্লায় তাদের কোঠা। মহল্লার নাম চক অথবা চৌক। শহরের নামী বাঈজীদের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন অযােধ্যার নবাব। এরকম একজন বাঈজী হচ্ছে রােশনী। মুনিয়া তারই একমাত্র মেয়ে। মেয়েকে নিজের হাতে নিজের মতন করে তালিম দিয়ে তৈরি করেছে রােশনী। অনেক সময় মা আর মেয়ে দুজনেই একই আসরে নেচে থাকে। মায়ের বয়স ছত্রিশ, মেয়ের বয়েস তার অর্ধেক। নবকৃষ্ণ চেয়েছিলেন মা আর মেয়ে দুজনকেই তাঁর বাড়ির প্রথম নাচের আসরে নাচাতে। কিন্তু রােশনীর অন্য জায়গায় বায়না থাকায় আসতে পারেনি। কাজেই কেবল মুনিয়াকে পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে নবকৃষ্ণকে।

সেকালের বাবুদের সবচেয়ে সেরা নারী ছিল নিকীবাঈ। সংসদ বাঙালী চরিতাভিধানে নিকী সম্বন্ধে বলা হয়েছে, “১৯শ শতাব্দীর এক নামকরা বাঈজী। ঐ শতাব্দীর প্রথম থেকেই পশ্চিমের বাঈজীরা কলিকাতায় আসতে থাকেন এবং পােষকতা পেয়ে অনেকেই পেশাদার জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ক্রমে কলিকাতায় পশ্চিমা বাঈজীদের রীতিমত একটা সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। তৎকালীন সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ১৮২৩ খ্রীঃ নর্তকী নিকী রাজা রামমােহন রায়ের মানিকতলার বাগানবাড়িতে নাচেন। ঐ সময়ে বেগমজান, হিঙ্গুল, নান্নিজান, সুপনজান প্রভৃতি আরও কয়েকজন নর্তকী-গায়িকার নাম পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হত। উক্ত ১৯শ শতাব্দীর প্রথমভাগে নিকী, মধ্যভাগের হীরাবুলবুল এবং শেষভাগে শ্রীজান বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিলেন।”

নিকীকে নিয়ে সেকালের কলকাতার বাবুরা নিজেদের মধ্যে নির্লজ্জভাবে দরকষাকষি করতেন। ফলে নিকীর বাজার দর বেড়ে যেতাে হু হু করে। অনেক সময় তা হয়ে পড়তাে আকাশছোঁয়া। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, শহর কলিকাতায় নিকী নামে এক প্রধান নর্তকী ছিল। কোনও ভাগ্যবান লােক তাহার গান শুনিয়া ও নৃত্য দেখিয়া সন্তুষ্ট হইয়া এক হাজার টাকা মাসে বেতন দিয়া তাহাকে চাকর রাখিয়াছেন। ১৮০৮ সালের ৬ অক্টোবর দুর্গাপুজোর সময় মহারাজা নবকৃষ্ণেরর পুত্র রাজকৃষ্ণ শােভাবাজার রাজবাড়ির নতুন মহলে বাঈ-নাচের আসর বসিয়েছিলেন। নিকীর নর্তকী হিসেবে সেখানেই আবির্ভাব ঘটে। এই আসরে উপস্থিত ছিলেন লর্ড মিন্টো। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Baiji babu culture)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours