তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে বসতো মদের আসর!

মধুসূদন দত্ত থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মদের আসক্তি এড়াতে পারেননি বাঙালির মহাপুরুষরাও। পুরোনো কলকাতার এই মদ খাওয়ার ইতিহাস সত্যিই আকর্ষণীয়।

ঊনিশ শতকের কলকাতা। সমাজপতিদের চোখরাঙানো উপেক্ষা করেই, নব্যবাবুদের বাবুগিরি আর ‘ইয়ং বেঙ্গল’ ছাত্রদের নেতৃত্বে কলকাতায় তখন মদ্যপানের জোয়ার এসেছে। রাজনারায়ণ বসু, ভুদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মধুসূদন দত্ত, কৃষ্ণদাস বসাক, প্রমুখ ডিরোজিয়ান এবং সমকালীন ‘ইয়ং বেঙ্গল’ অনুগামীদের দেখাদেখি ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে সমাজের একটা বড়ো অংশ মদ খাওয়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহী।

চারিদিকে মদ খাওয়ার ওই রমরমা দেখে এগিয়ে আসেন কিছু সমাজ সচেতন মানুষ। পত্র-পত্রিকাতেও লেখালিখি আরম্ভ হলো। মদ্যপান বিরোধী ওই আন্দোলনে দুই ‘প্যারী’র নাম অগ্রগণ্য। এক জন ডিরোজিয়ান প্যারীচাঁদ মিত্র এবং অন্য জন ডেভিড হেয়ারের এবং হিন্দু কলেজের উত্তর-ডিরোজিও পর্বের ছাত্র প্যারীচরণ সরকার। প্রথম জন মদ খাওয়ার বিরোধিতা করে ‘মাসিক পত্রিকায়’ কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন এবং তার পর টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’ নামে একটি বইও লিখে ফেলেন।

দ্বিতীয় জন অর্থাৎ, প্যারীচরণ সরকার কিন্তু শুধু লেখালিখি করেই থেমে থাকেননি, তিনি ১৮৬৩'তে স্থাপন করলেন ‘বঙ্গীয় সুরাপান নিবারণী সভা’। কিছু কাল বেশ উৎসাহের সঙ্গেই চলল সুরাপান নিবারণী সভা কিন্তু মদের আকর্ষণ এতই প্রবল, সে সভাও ভেঙে গেল ধীরে ধীরে। অল্পকাল পরে প্যারীচরণ মারা গেলে সভাও বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। বিদ্যাসাগরের মতো সুধীজনেরা অবশ্য সভা বাঁচানোর একটা উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন, কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। অত্যাধিক মদ্যপানে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মৃত্যুর পর ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকায় লেখা হল, ‘হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রমাপ্রাসাদ রায়, রামগোপাল ঘোষ, কালীপ্রসন্ন সিংহ, রাধানাথ শিকদার, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণনগরের মহারাজা সতীশচন্দ্র রায়, কালীকুমার দাস, ঢাকা মুড়াপাড়ার জমিদার কালীচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র বঙ্গমাতার মুখোজ্জ্বলকারী এতগুলি উপযুক্ত সন্তানকে সুরারাক্ষসী গ্রাস করে।’

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পেশায় ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ চাকুরে। পেশার প্রয়োজনে সায়েবদের সঙ্গে মেলামেশা তাঁকে করতেই হতো। সেই সূত্রে ও অন্যান্য কারণেও তিনি মদ্যপান করতেন। তাঁর বাড়িতে নাকি নিয়মিত মদ্যপানের আসর বসতো! কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের মতো আরও অনেকেই ছিলেন সেই আসরের সদস্য। বয়সে বড়ো হলেও প্রথম ভারতীয় ‘সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ’ জগদীশনাথ রায় ছিলেন বঙ্কিমের বন্ধু। শোনা যায়, জগদীশনাথ নাকি এত বেশি মদ খেতে পারতেন যে লোকে আড়ালে তাঁকে ‘জগ’ বলে ডাকত। তাঁরা উভয়ে মাঝে মাঝে একসঙ্গে বসে মদ খেতেন, এমন কথাও বলেন কেউ কেউ। নিজে বাড়িতে মদ খেলেও বঙ্কিম ‘লোকরহস্য’ গ্রন্থের ‘দাম্পত্য দণ্ডবিধির আইন’ নিবন্ধে গৃহবধূদের জবানিতে বাড়িতে মদ্যপান করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

মদ খাওয়া নিয়ে কোনও রাখঢাক ছিল না দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও। নিজের বাড়িতে মাঝে মাঝে বন্ধুদের নিয়ে এক সঙ্গে বসে পানভোজন করতেন বলে জানা যায়। কেউ কেউ বলেন, ‘কালাপানি পেরনো সন্ন্যাসী’ স্বামী বিবেকানন্দ এবং স্বামী অভেদানন্দও নাকি তাঁদের প্রবাস জীবনে, ‘প্রবাসে নিয়ম নাস্তি’ প্রবচন স্মরণ করে ‘নিষিদ্ধ’ জল-খাবার গ্রহণে বিশেষ আপত্তি দেখাননি। আর কালীপুজোই যেখানে কারণবারি সিদ্ধ পুজো প্রকরণ, সেখানে কালীভক্ত সন্ন্যাসীর কারণবারি থেকে দূরে থাকার কোনও কারণ থাকতে পারে না!

মদ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল ঠাকুরবাড়িতেও। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের প্রাণপুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ওঠাবসা ছিল সাহেবদের সঙ্গে। ফলে তাঁর বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি হয়ে উঠেছিল বাঈজি নাচ আর মদ্যপানের পীঠস্থান! তাঁর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণে পরিবারে তিনি প্রায় অচ্ছুৎ ছিলেন। শোনা যায়, স্ত্রী দিগম্বরীদেবী তাঁকে স্পর্শ পর্যন্ত করতেন না। দ্বারকানাথ নিজে যেমন মদ খেতেন, তেমন বাঙালিকে মদ খাইয়েওছেন। তাঁর ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মদ আমদানি করত।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জীবনে বেশ উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। মদ্যপান তখন ছিল তাঁর নিত্যসেবা। দ্বারকানাথ ঠাকুর মারা যাবার পর এক বিরাট টাকা ঋণের বোঝা এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। বাধ্য হয়ে তিনি সমস্ত বিলাসিতা ত্যাগ করেন। বন্ধ হয় তাঁর মদ্যপানও। পুত্র রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্যে না খেলেও মদ খাওয়া নিয়ে খুব একটা ছুঁৎমার্গ দেখাননি। ক্ষণিকা-র ‘মাতাল’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘...স্মৃতির ঝারি উপুড় করে ফেলে/ নয়নবারি শূন্য করি দিব,/উচ্ছ্বসিত মদের ফেনা দিয়ে/ অট্টহাসি শোধন করি নিব।’ বাঙালি অবশ্য তাঁর নির্দেশ মানতে কোনও কার্পণ্য করেনি।

রক্ষণশীলেরা যতই বাধা দিক, মদের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বোধ হয় মনুষ্যসমাজ সৃষ্টির সেই প্রথম লগ্ন থেকেই। দিল্লি কা লাড্ডুর মতো মদও, যো পিয়া ও পস্তায়া, যো নেহি পিয়া, ওভি পস্তায়া!

প্রাবন্ধিক সমীর সেনগুপ্ত অনেক বই ঘেঁটে, অনেক হিসেবপত্র দেখে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। যে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ রীতিমত মদ খেতেন। শুধু তাই নয়, বড়দের সঙ্গে বসে মদ না খাওয়ার মধ্যবিত্ত ন্যাকামো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। সবার সাথেই তিনি বসে মদ্যপান করতেন। এমনকি ছোটদের সঙ্গেও খেতেন। মদ্যপানের প্রতি নাকি তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও ছিল। তাই অন্য কোনও মদ্যপকে তিনি কখনও মানা করেননি মদ খেতে! সাহিত্যিক নির্মলকুমারী মহলানবীশ তাঁর বিলেতবাসের গল্পে জানিয়েছিলেন, এক ভোজসভায় তিনি জেদের বশে পর পর সাত গেলাস মদ খাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁকে কার্যত জোর করে হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ঘর অবধি পৌঁছে দেওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর হাত ছাড়তেও রাজি হননি। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যের প্রিয় রানি চন্দও বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁকে মদ্যপানের অভ্যাসটি শিখিয়েছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন মদ খেতেন, তার ওপর আর কথা চলতে পারে? রানি চন্দ্রও বলতে পারেননি।

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ এই মদে আসক্ত হয়েছিলেন ঠাকুর বাড়ির সংস্কৃতি থেকেই। কারণ মদ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল ঠাকুরবাড়িতে বহুদিন আগে থেকেই।

পণ্ডিতেরা বলেন, ভারতে মদের প্রচলন নাকি খ্রীস্টপূর্ব চার হাজার অব্দেও ছিল! আর বঙ্গদেশে? সেটা অবশ্য পণ্ডিতেরা ঠিক বলতে পারেননি, তার কারণ খ্রীস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর আগের তেমন কোনও ইতিহাসই এই বঙ্গভূমির পাওয়া যায় না। গেলেও খুবই কম। তা থেকে মদ্যপানের প্রমাণ দেওয়া খুবই কঠিন। বাংলার সমাজজীবনের ঠিকঠাক ইতিহাস পাওয়া যায় খ্রীস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকে, অর্থাৎ, মুসলিম যুগ বা মধ্যযুগ থেকে। সে যুগে বিভিন্ন ধরনের মদ তৈরিতে বাঙালির পারদর্শিতা কারও থেকে কম ছিল না। তালের রস, ইক্ষু বা আখের রস, নারিকেলের জল এমনকী দুধ থেকেও তৈরি হতো নানা রকমের মদ। তা ছাড়া গুড়, চাল, গম, মধু থেকে তৈরি মদের বহুল প্রচলন তো ছিলই। মঙ্গলকাব্যগুলিতে দেখা যায়, শিব নেশার দেবতা হিসেবে খ্যাত হলেও শিবপুজোর সময় মদ্যপান নিষিদ্ধ। আবার কালী বা দুর্গার মতো শক্তিপুজোর সময় মদ্যপান নিষিদ্ধ ছিল না, বিশেষত কালীপুজো তো সিদ্ধই হবে না মদ ছাড়া! বিভিন্ন ধরনের মদের মধ্যে গুড় থেকে তৈরি এক প্রকার ‘গৌড়ীয় মদ্য’-এর খ্যাতি নাকি বাংলা ছাড়িয়ে ভারতের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছিল। এ ছাড়াও ভাত পচিয়ে তৈরি সস্তার চোলাই গরিবদের কাছে ছিল স্বর্গ! (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - wine Kolkata)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours