তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

উত্তম কুমার মানেই পুরোনো কলকাতার ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট রাস্তা, সব পুরোনো কলকাতার অলি গলি। যাই হোক আমার বেশ মনে আছে আমাদের পাড়ায় মানে পাইকপাড়ায় থাকতেন ধীরেন দাস। সেকালের খ্যাত নামা গায়ক অভিনেতা অনুপ কুমারের বাবা। উনার মৃত্যু দিনে এসেছিলেন উত্তম কুমার। সেকি কান্ড, আমি তখন খুব ছোট। সাল ১৯৬১। রাস্তায় খুব ভীড়, আমি ছুটে গেলাম ভীড় দেখতে। গিয়ে দেখলাম উত্তম কুমার দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। হটাৎ অনুপ কুমার বাইরে এসে চিৎকার করে বললেন আমার বাবা মারা গেছেন আর আপনারা উত্তম কুমার দেখতে এসেছেন। এই কথা শোনার পর উত্তম কুমার বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলেন।

কিছুই করার নেই এটাই জনপ্রিয়তা। উত্তম কুমারের সাথে খুব ছোট রোলে কাজ করেছেন, তাদের মুখ থেকে শুনেছি অনেক গল্প। যেমন একজনের মেয়ের বিয়ে টাকা জোগাড় করতে পারছে না। শুটিং এর ফাঁকে উত্তম কুমারকে বললেন। শুনে উত্তম কুমার বললেন আমি কি করবো? আমি কি তোমার দায়িত্ব নিয়েছি নাকি। তার পর শুটিং এর শেষে ওই লোকটাকে ডাকলেন আর বললেন আমি কাল রাত দুটোয় তোমার বাড়িতে যাচ্ছি চিন্তা করো না। আমাদের পাড়ার রামদাকে সবাই চেনে। উনি বললেন উনার অভিজ্ঞতার কথা। একদিনের কাজ ছিল উত্তম কুমারের সাথে। খাবার দেয়নি প্রোডিউসার। উনি চার অক্ষরের গালাগালি করে বললেন আমার জন্য খাবার পাঠাবে প্রোডিউসার ওটা তোকে দিয়ে দেবো কারণ আমার খাবার তো বাড়ির থেকে আসবে। এরকমও শোনা যায় বহু সময়ে খাবার টেবিল উল্টে ফেলে দিয়েছেন এক্সট্রারা খাবার পাইনি বলে। শুধু অভিনয়ের জোরে স্টার হননি। যাঁদের সাথে কাজ করছেন তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া আর ভালোবেসে মর্যাদা দেওয়ার কথাটা উনি বুঝতেন। এখন টালিগঞ্জের খুব পুরোনো টেকনিশিয়ানরা উনাকে ভোলেননি।উনি একদিনে উত্তম কুমার হননি। উনি ছিলেন ফ্লপ মাস্টার। অনেক অপমান এবং জ্বালা যন্ত্রনা পেরিয়ে উত্তম কুমার হয়েছেন। এই উত্তম কুমার হয়ে উঠার পেছনে একজন শিল্পীর কথা বলতেই হবে, উনি হলেন পাহাড়ী সান্যাল। শুনুন পুরো গল্পটা। উত্তম কুমারের পরপর তিনটি ছবি ফ্লপ। তবুও ছেলেটি স্টুডিওপাড়ায় একটা রোলের জন্য ঘুরে বেড়ায়। ছেলেটিকে দেখলে সবাই রংতামাশা করে। ফ্লপ মাস্টার জেনারেল বলে হাসাহাসি করে। ছেলেটির চোয়াল ক্রমশ শক্ত হতে থাকে। মনে মনে আরও কঠিন প্রতিজ্ঞা করে সে। কিন্তু করলেই তো হবে না। সুযোগ পেতে হবে। কিন্তু কে দেবে সুযোগ?

কেউ না জানলেও একজন জানতেন, এই ছেলেটি পারবে। তিনি হলেন পাহাড়ী স্যান্যাল। প্রায় দিন তিনি ছেলেটিকে লক্ষ্য করেন। কিন্তু কোনও কথা বলেন না। ঠিক এমন সময় নির্মল দে তাঁর নতুন ছবি ‘বসু পরিবার’ করার জন্য নায়ক হিসেবে ঠিক করলেন কালী ব্যানার্জিকে। কালী ব্যানার্জি তখন বিখ্যাত নায়ক। কিন্তু নির্মল দে কালী ব্যানার্জির ডেট পেলেন না। নিজের ঘরে বসে ভাবছেন, এখন তাহলে কী করা! এমন সময়ে ঘরে এলেন পাহাড়ী স্যান্যাল। পাহাড়ী স্যান্যালকে সব খুলে বললেন। পাহাড়ী স্যান্যাল অল্প হেসে বললেন, ‘দূর, এত চিন্তা করছ কেন? হাতের কাছেই নায়ক রয়েছে।’

নির্মল দে লাফিয়ে উঠলেন, ‘কে?’ তারপর নায়কের নাম শুনে ধপ করে বসে পড়লেন। বললেন, ‘পাহাড়ীদা আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন? ওকে নিলে সিনেমা হলগুলিতে ঢিল পড়বে, কে সামলাবে বলুন?’

পাহাড়ী স্যান্যাল বললেন, ‘নামটা পাল্টে দাও, কেউ জানতে পারবে না। আমি কথা দিচ্ছি, ওকে নিয়ে ঠকবে না। এখন ও ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে। শুধু অস্ত্র তৈরি করার অপেক্ষা।’ নির্মল দে কি মনে করে, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটিকে ডেকে পাঠালেন। পাহাড়ী স্যান্যাল বললেন, ‘বাপু, বাপের দেওয়া নামের মায়া কি ছাড়তে পারবে? তাহলে একটা সুযোগ আছে।’ ছেলেটি আস্তে আস্তে মাথা নাড়াল। পাহাড়ী স্যান্যাল বললেন, ‘অন্য নাম আছে তোমার?’ ছেলেটি একটু থেমে বলল, ‘দাদু আমাকে উত্তম বলে ডাকতেন।’ লাফিয়ে উঠলেন পাহাড়ী স্যান্যাল। বললেন, ‘নির্মল, দেরি করো না। উত্তম নামটা লাগিয়ে দাও। লেগে যাবে।’ তা-ই হলো। লেগে গেল। হিট হলো বসু পরিবার। বাঙালি পেয়ে গেল এক নতুন নায়ক—উত্তম কুমার। [তথ্যসূত্র: এক এবং অদ্বিতীয়, ডিসেম্বর, ২০১২ সংখ্যা, সাইন ইন্ডিয়া সিনেভিশন অ্যান্ড মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা]। এর পর তো বাকি টা তো ইতিহাস।

শুরুর সেই লড়াইটা ছিল ভয়ংকর, ফ্লপ এবং ফ্লপ। হাত থেকে কনট্রাক্টের কাগজ ছিনিয়ে নিয়েছেন প্রযোজক। মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার চেহারাটা নায়কোচিত নয়।’ তুলনাটা চলে আসত প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে। দ্বিতীয় প্রতিপক্ষও তখন নেপথ্যে দাঁড়িয়ে; সেই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ‘মাচো-হিম্যান’ ইমেজে গত শতাব্দীর পঞ্চাশোর্ধ বাঙালিরা তখনও আত্মহারা। হৃদয়ের কুঠুরিতে লেখা হয়ে গেছে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা প্রমথেশ বড়ুয়া-এই দুই নাম। তাদের পাশে নবাগত উত্তম কুমার। ভাগ্যিস ‘বসু পরিবার’ (১৯৫২) বক্স অফিসের মুখ দেখেছিল। না হলে আজকের বাঙালি কোথায় পেত এই উত্তম কুমারকে? বঙ্কিম গ্রিবা, হৃদয়ে তোলপাড় করা হাসি আর অভিনয়ের চূড়ান্ত আধুনিকতা-এগুলোই উত্তমের সাফল্যের তাস।

যদুবংশ’ ছবির শুটিং চলছে। সাতের দশকের গোড়ার দিক। পার্থপ্রতিম চৌধুরী, পরিচালক, হেঁকে উঠেছেন, ‘‘অল লাইটস’’। পজিশন নিতে গিয়ে উত্তমকুমার খেয়াল করলেন, টপ থেকে কোনও একটা লাইট ঠিকমত তাঁর শরীরে এসে পড়েনি। তখন উপরে কাঠের পাটাতনে লাইটম্যানরা দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতেন, নির্দেশ মতো সুইচ অফ-অন করতেন। সে দিন তেমনই এক জন, নাম তাঁর কালী, হাঁক শোনার পরও ভুলে গেলেন আলো জ্বালতে। শট অবশ্য হয়ে গেল, তবে হয়ে যাওয়ার পর কালীকে ডেকে পাঠালেন উত্তম। শুনে কালী কাঁপতে কাঁপতে উত্তমের মেক-আপ রুমে এলেন। এমনিতে তাঁর কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই বিড়ি চেয়ে খান উত্তম, কিন্তু কাজের ভুলের তো কোনও ক্ষমা নেই। কিন্তু উত্তম বকুনি না দিয়ে সস্নেহে তাঁকে বললেন, ‘‘কী হয়েছে রে কালী? অন্যমনস্ক ছিলিস মনে হল, এনি প্রবলেম?’’ হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন কালী, বলেন, ‘‘মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে দাদা, কিন্তু আমি কিছুতেই টাকা জোগাড় করে উঠতে পারছি না। তাই... এমনটা আর হবে না।’’

পরের দিন স্টুডিয়োতে বেরনোর আগে উত্তমের বাড়িতে তাঁরই নির্দেশ মতো কালীকে নিয়ে হাজির পার্থপ্রতিমের সহকারী বিমল দে। তাঁদের দুজনকে নিয়ে স্টুডিয়ো যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে উত্তম কালীর হাতে হাজার পাঁচেক টাকার একটা খাম ধরিয়ে বললেন, ‘‘এটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখ।’’ এটাই উত্তম কুমার। সৌমিত্র চ্যাটার্জী বহুবার সাক্ষাৎকারে বলেছেন উনার থেকে প্রশংসার অপেক্ষায় থাকতাম।

কেমন ছিলেন ব্যক্তি উত্তমকুমার, মৃত্যুর চার দশক পরে সেটা নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা প্রয়োজনহীন। মানুষ উত্তম মিশুকে; বন্ধু উত্তম আড্ডাবাজ, পুত্র উত্তম মাতৃভক্ত; ইন্ডাস্ট্রির ‘বড়দা’ উত্তম দানশীল; প্রেমিক উত্তম মেদুর; শ্বশুর উত্তম স্নেহশীল; অগ্রজ উত্তম অভিভাবকসম; পেটুক উত্তম ভোজনবিলাসী ইত্যাদি অজস্র আদিখ্যেতা উত্তমকুমারকে নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গত দু’বছর উত্তমকুমারের সিনেমা নিয়ে একটি বইয়ের গবেষণায় বারবারই চোখে পড়েছে এই রকম গদগদ অসংখ্য স্তুতি। সত্যি বলতে, ঘরে ঘরে এ রকম অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা দাদা, সন্তান, শ্বশুর, প্রেমিক হওয়ার বিভিন্ন পরীক্ষায় হয়তো সসম্মান উত্তীর্ণ হবেন। কিন্তু উত্তমকুমার একটাই হয়, একটাই। কাজেই ব্যক্তি উত্তমকুমারকে টেনেটুনে অভিনেতা বা স্টার উত্তমকুমারের সমকক্ষ করার এই যে বার্ষিক প্রকল্প বাঙালি প্রত্যেক বছর তার জন্ম আর মৃত্যুদিনে হাতে নেয়, সেটা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু না।

বরং এতে উত্তমের কিছুটা ক্ষতিই হয়, কারণ ব্যক্তি উত্তম খুবই সাধারণ— মধ্যবিত্ত, ভিতু, অনেকাংশে রক্ষণশীলও বটে। ঝুঁকি না নিতে পারার সহজাত অক্ষমতা ভাল সিনেমা বাছার ক্ষেত্রে তাঁকে ডুবিয়েছেও বেশ কিছু বার— এই নিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রী বা অগ্রগামীর সরোজ দে’র কিছু স্পষ্ট উল্লেখও আছে। এটা বিশেষ করে চোখে পড়ে মধ্য-সত্তরের দশকে, যখন নিজের উপকথাসুলভ জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে উত্তম কিছু ভাল সিনেমা উত্তরকালকে দিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করলেন না। বরং নিজেকে বিলিয়ে দিলেন ইন্ডাস্ট্রিকে ‘বাঁচাতে’। থুড়ি, বিলিয়ে দিলেন না, বলি দিলেন। দয়াশীল উত্তম ইন্ডাস্ট্রির জন্য কল্পতরু হলেন। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Uttam Kumar)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours