তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রতেও দেবদাসীদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। কৌটিল্য দেবদাসী প্রথা পর্যবেক্ষণের পর স্পষ্টভাবে বলেন যে, দেবদাসীদের মধ্যে যারা মন্দিরে সেবিকার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে বা অব্যাহতি নিয়েছে তাদের এবং সেই সঙ্গে বিধবা, পঙ্গু মহিলা, সন্ন্যাসিনী বা ভিখারিনী, শাস্তিপণ পরিশোধে ব্যর্থ মহিলা, গণিকার মা এবং পশম, তুলা, শণ ইত্যাদি বাছাই-এর কাজে নিয়োজিত মেয়েদের মন্দির উপাধ্যক্ষগণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করত। কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানীর মতে গর্ভধারণ ও পুনঃপ্রজননের দেবীর পূজাকে ভিত্তি করে দেবদাসী শ্রেণির উদ্ভব হয়। মধ্যযুগীয় লৌকিক বিবরণ থেকে জানা যায়, গুজরাটের চার হাজার মন্দিরে দেবদাসী ছিল কুড়ি হাজার, অনেক জায়গায় এদের নাচনি বলা হতো।

সে সময়ের রাজারা নিজ স্ত্রী বাদে রক্ষিতা রাখাটা প্রায় নিয়ম করে ফেলে। এসব দেবদাসীদের কাউকে পছন্দ হলে, রাজারা চাইলেই তাকে নিজের করে নিয়ে আসতে পারতেন। নিঃসন্তান কোনো দম্পতির যখন বাচ্চা হত না তখন খোঁজ পড়ত দেবদাসীর। তাদের পছন্দ অনুযায়ী দেবদাসীকে নিঃসন্তান পরিবারে নিয়োজিত করা হতো পরিবার এবং পারিবারিক সম্পত্তি বিলোপের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এক্ষেত্রে মেয়েদের ঈশ্বরের নিকট উৎসর্গ করে তাদেরকে উচ্চতর সম্প্রদায়ের বা অভিজাত লোকের সন্তান ধারণের জন্য যৌনমিলনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এসব সন্তানরা পরবর্তীকালে ঠাকুরদাদার নাম ধারণ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো।

ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদার এবং ইউ. এন. ঘোষালের মতে, মধ্যযুগে গরীব ঘরের নীচু জাতির মেয়েদের শোষণের উৎস ছিল এই দেবদাসী সম্প্রদায়৷ সে সময় দেবদাসীদের সংখ্যা ছিল সব থেকে বেশি, যার সিংহভাগ ছিল দক্ষিণ ভারতে৷ অনেকের মতে, ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন শুরু হয় ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে৷ বৌদ্ধমঠগুলোতে সন্ন্যাসিনীরাই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু মন্দিরের দেবদাসী হয়ে ওঠে। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রবিদ যোগাশঙ্কর এই প্রথার বিবর্তনের প্রধান যে সব কারণ উল্লেখ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরবলির বিকল্প, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বাড়ানো, প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্মসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে লিঙ্গ উপাসনা, অতিথিদের আপ্যায়নের অঙ্গ হিসেবে পুরুষ অতিথির যৌনসুখ চরিতার্থ করা এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতো উঁচু জাতের লোকেদের দ্বারা নীচুজাতের শোষণ ইত্যাদি।

ইংরেজ আমলেও ছিল এই প্রথার অস্তিত্ব। ইংরেজ রাজ-পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য তৎকালে চেষ্টার কোন ক্রটি ছিল না। দেশে তখন চলতি প্রবাদ—"খুলক-ই-খুদা, মুলুক-ই-সিরকার, হুকুম-ই-সাহিবান আলিসান" অর্থাৎ নরকুল ঈশ্বরের, মাটি সরকারের, আর ক্ষমতা বলতে যা বোঝায় তা সব সাহেবদের। ১৭৯১ সনে কর্ণাটকের নবাব মাদ্রাজের লাট-বাহাদুরকে ভোজের পরে নাচ সহযোগে আপ্যায়ন করেছিলেন। স্যার গ্রান্ট ডাফ-এর সম্মানে আয়োজিত এক ভোজসভায় ভারতীয় নর্তকীরা ও দেবদাসীরা অতিথির আবাহন করেছিলেন পশ্চিমী গীতবাদ্যে।

আধুনিক যুগেও ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ভারতের কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের ইয়াল্লামা, হনুমান এবং শিবমন্দিরে আড়াই লাখ মেয়ে নিয়োগ করা হয়। নেপালে বিশেষ করে দোতি, বাইতাদি এবং দাদেলধুরা জেলাসমূহে দেবদাসীদের এসব প্রতিষ্ঠান ছিল সনাতন প্রথা হিসেবে অতি প্রচলিত। ঊনবিংশ শতকের সূচনায় ফ্রান্সিস বুকানন নামে এক ইংরেজ অভিযাত্রী দক্ষিণ ভারতে আসেন। তিনি লিখে গেছেন, ‘কাঞ্চিপুরমের মন্দিরে দেবদাসী আছে কমপক্ষে একশ’। বিখ্যাত ভারতশাস্ত্রবিদ স্যার মনিয়ের উইলিয়ামস তাঞ্জোর মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন গত শতকের শেষ দিকে । তখনও সেখানে ছিলেন ১৫ জন দেবদাসী।

প্রথাটি যে নারীদের জন্য চরম অবমাননাকর, তা আস্তে আস্তে মানুষ বুঝতে পারে। ১৯০৬ থেকে ৭ সালের দিকে ভারত সরকারকে পতিত মেয়েদের রক্ষা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সনদে সঁই করতে হয়। এই সনদের ফলেই দেবদাসীও আলোচনায় চলে আসে। ১৯১২ সালে পুরানো দিনের ইম্পেরিয়াল কাউন্সিলে হঠাৎ নতুন ধরনের বিল উত্থাপিত হয়। তাও একটি নয়, পরপর তিনটি। তিনটির আবেদন একই– “দেবদাসী প্রথার উচ্ছেদ চাই”। ভারত সরকার জনসাধারণের ধর্মানুভূতি নিয়ে তখন বেশ সতর্ক ছিল। তাদের মতামত ছিল এ প্রথার সঙ্গে দক্ষিণ ভারত বিশেষভাবে জড়িত। তাই কোনো আইন প্রণয়নের আগে সেখানকার অভিমত জানা প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হল তাদের জনগণের এ ব্যাপারে কি মতামত তা জানতে। তাদের পাঠানো মতামতের ভিত্তিতে ১৯১৩ সনে নিযুক্ত হলো কেন্দ্রীয় সিলেক্ট কমিটি। তারা রিপোর্ট জমা দেয় পরের বছর মার্চে। সেপ্টেম্বরে উত্থাপিত হয় সরকারি বিল কিন্তু ভাগ্য দেবদাসীদের খুব একটা সহায়তা করতে পারেনি। ‘বিল’ ভাল করে জানাজানি হতে না হতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মন্দিরের অঙ্গণের চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র তখন সরকারের জন্য অনেক জরুরি। দেবদাসীকে নাচের আসরে ছেড়ে তারা লড়াইয়ে মনোযোগ দিলেন।

কয়েক বছর পরে আবার আলোচনায় আসে দেবদাসী। ডাঃ হরিসিং গৌর মাদ্রাজ বিধানসভায় ১৯২২ সনে তাদের সম্পর্কে আইন দাবি করে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯২৭ সনে কেন্দ্রীয় পরিষদে একই প্রস্তাব পেশ করলেন রামদাস পানতুলু। দু’জনের প্রস্তাবই গৃহীত হলো কিন্তু আইন পাস হলো না কোথাও। সরকার পক্ষ কখনো সংশোধিত প্যানেল কোড দেখালেন তো কখনো সারদা আইনের (১৯২৭) দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। তখন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য এই প্রথার বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করে বলেছিলেন– "কেউ কি দেখাতে পারেন হিন্দুর ধর্মশাস্ত্রে দেবদাসীর বিধান?" কোনো শাস্ত্রজ্ঞ তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। একই প্রশ্ন তুলেছেন গান্ধীজিও, দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে এসে তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন।

অবশেষে দেবতার নামে নারীদের ‘উৎসর্গ' করার কুপ্রথা ১৯৮৮ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয় না। পরবর্তীতে, ২০১৫ সালে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে কর্ণাটক রাজ্যকে এই প্রথা তুলে দিতে নির্দেশ দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এ প্রথা নিয়ে অভিযোগ করে। বর্তমানে ভারতের প্রায় সব রাজ্যই আইন করে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করেছে। এসব আইনের মধ্যে বোম্বে দেবদাসী আইন ১৯৩৪, দেবদাসী মাদ্রাজ আইন ১৯৪৭, কর্ণাটক দেবদাসী আইন ১৯৮২, অন্ধ্রপ্রদেশ দেবদাসী আইন ১৯৮৮ অন্যতম। তাও সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক এবং মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকায় আজও রয়েছে অন্ততপক্ষে ৩৫ হাজার দেবদাসী৷ এদের মধ্যে যৌবন-উত্তীর্ণ অনেকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা শোচনীয়৷ এদের অনেকেই আজ রাস্তার ভিখারি৷ রূপ-যৌবন হারানোর পর, এদের যেন কোথাও ঠাঁই নেই – না মন্দিরে, না ধনীদের ঘরে।অ ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির অধঃপতন হতে শুরু করে বুদ্ধ সংস্কৃতির অবসানের পর কারণ বুদ্ধ সংস্কৃতি বা জীবন বোধ ছিল সনাতন হিন্দু সংস্কৃতির যুক্তিগ্রাহ্য পরিণতি। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - prostitution)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours