তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হতো ইতিহাসের আদিকাল থেকেই। যেমন - দেহপসারিণী, বে^...শ্যা, রক্ষিতা, খান^...কি, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোগু, গণিকা ইত্যাদি।

তবে কামসুত্র গ্রন্থের লেখক 'বাৎস্যায়ন' পতিতাদের ৯ টি ভাগে ভাগ করেছেন, তা হলো - "বে^...শ্যা বিশেষ প্রকরণ - ‘কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিণী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশ বিনষ্টা, রূপজীবা এবং গনিকা—এই কয়টি বে^...শ্যা বিশেষ [কামসুত্র: চতুর্থ ভাগ – ষষ্ঠ অধ্যায় - ২৪]"

ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬ তম সূক্তের পঞ্চম ঋকে আছে - "সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা"। ইতিহাসবিদ, 'মরিস ভিন্টারনিৎসের' মতে এখানে যে "বিশ্যা" শব্দটি আছে তার থেকেই নাকি "বে^...শ্যা" কথাটির উৎপত্তি।

George Ryley Scott তার (A history of prostitution from antiquity to the present day) 'পতিতা বৃত্তির ইতিহাস' নামক বইয়ে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে - "পতিতা অর্থাৎ বে^...শ্যারা হলো সেই সম্প্রদায় ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে - জীবিকা অর্জন করে।"

তবে জর্জ রালি স্কট তার বইতে, আরো এক শ্রেনির পতিতার কথা বলেছেন, যারা অর্থ ছাড়াই পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক করে তাদেরকে তিনি Amateur Prostitutes অর্থাৎ ‘পেশাহীন পতিতা’ বলে অভিহিত করেছেন।

পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি সৃষ্টির আদিকাল থেকেই॥ পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে প্রচুর অপ্সরার উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন – উর্বশী, মেনকা, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, সরলা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু – এরকম অনেক স্বর্গ বে^...শ্যার নাম আমরা পাই। বাংলা ডিকশনারী মতে অপ্সরা অর্থ - স্বর্গের বারাঙ্গনা বা বে^...শ্যা; সুরসুন্দরী। [সং. অপ্ + সৃ + অস্ = অপ্সরস্ = অপ্সরা]।

"মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, একজন বে^...শ্যা ভাল প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে। এই জীবিকা সম্বন্ধে বৌদ্ধ ধর্মেরও একই মত। (তথ্যসুত্র: বাংলা পিডিয়া)"। মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনি ঋষির নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা 'স্বর্গবে^...শ্যা' দেখে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌন মিলন করেছিলেন। বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা – এরাই হলো সেইসব মুনি ! মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তি গুলির মধ্যে পতিতা বৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। ওই কারণেই বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুর লিখেছেন – ‘মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল’ (দেবলোকের যৌনজীবন, পৃঃ ৬২)। বাংলা ডিকশনারী মতে মৈথুন অর্থ; রতিক্রিয়া, রমণ, স্ত্রী-পুরুষের যৌন সংসর্গ। [সং. মিথুন + অ]।

'আইয়্যামে জাহেলিয়া' যুগে আরবে পতিতাবৃত্তি সহ আরো অনেক খারাপ কাজ চালু ছিল। ইতিহাসবিদ পি.কে হিট্টি বলেন, 'মহানবী (সাঃ) এর আবির্ভাবের একশ বছর আগে আইয়্যামে জাহিলিয়া শুরু হয়।' ওই যুগে ইমরুল কায়স, তারাকা আমর, লবীদ, যুহায়ে নামক কবি অশ্লীল কবিতা রচনা করতো। এ ব্যাপারে মাওলানা আকরাম খাঁ তার বইয়ে লিখেছেন, 'পুংমৈথুন, স্ত্রীমৈথুন এবং পশু মৈথুন তাদের ভিতর প্রচলিত ছিল এবং তা তারা স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করত।'

"পতিতা বৃত্তির আরো সরস বিবরণ পাওয়া যায় 'বাৎস্যায়ন' আমলে এবং তার লেখা কামসূত্র বইয়ে। 'বাৎস্যায়ন' তাঁর বাল্যকাল কেটেছিল এক বে^...শ্যালয়ে। এবং সেখানে তাঁর মাসি কাজ করতেন। ঐখান থেকেই তিনি কামকলা সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করেছিলেন। [ তথ্যসুত্র: Ascetic of Desire,Sudhir Kakar, Overlook Press,2000]"

ওই সময় পতিতাবৃত্তি এবং যৌনতা খুব স্বাভাবিক এবং সন্মানিত বিষয় ছিল। কামসূত্রের ০৬ - ভার্যাধিকারিক (৩.১) এর ৫৩ নম্বর শ্লোকে আছে - "স্বামী যাহাকে প্রচ্ছন্ন ভাবে কামনা করে, তাহার সহিত স্বামীর সঙ্গম করিয়া দিবে ও গোপন করিয়া রাখিবে।।৫৩।।"

তাছাড়া বাৎস্যায়নের সময় বে^...শ্যারা আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতো বিয়ে, সন্তান জন্মদান, ঘর-সংসার করতো বে^...শ্যা বৃত্তিকে ত্যাগ না করেই। কিন্তু বিয়ের পর প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বে^...শ্যা বৃত্তিতে আর কোনো বাধা ছিল না।

অ্যাথেন্সের আইন প্রণেতা ও কবি সোলোন (খ্রী.পূ. ৬৩৮-খ্রী.পূ. ৫৫৮) প্রাচীন গ্রিকের - যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসাবে গণ্য হতেন, খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম বে^...শ্যালয় স্থাপন করেন। "ইতিহাসের জনক হিসাবে খ্যাত হিরোডেটাস এর লেখায় 'পবিত্র বে^...শ্যাবৃত্তির' প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং সেবা শুশ্রূষার নমুনা হিসাবে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হত অন্যদের সঙ্গে। তাদের বাধ্য করা হতো যৌনসঙ্গম করতে। [তথ্যসুত্র: Cf. Herodotus, Book I, para 199]"

"বহু আগে থেকেই প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স ও রোমে পতিতা বৃত্তি চালু ছিল। এমনকি অনেককে বাধ্য করা হতো পতিতাবৃত্তি করতে। ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডেরো প্রথম জীবনে বে^...শ্যা ছিলেন। পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই। [তথ্যসুত্র: Thomas A. McGinn, The Economy of Prostitution in the Roman World,2004]"

চীনে পতিতাবৃত্তির ইতিহাস সুপ্রাচীন। 'Fang Fu Ruan' তার লেখা 'Sex in China' বইয়ে লিখেছেন, [Ying-chi is the first independent prostitutes in Chinese history.]। অর্থাৎ 'Ying chi' চীনের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন পতিতা। তার খদ্দের ছিল, উচ্চ শ্রেনির ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া চিনে Tang (তাং) রাজবংশ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বে°...শ্যাবৃত্তি চালু করেছিল। পরবর্তী Shang (সাঙ) রাজবংশ বিভিন্ন স্থান থেকে পতিতাদের সংগ্রহ করে 'হাঙ চৌ' শহরে বসবাসের ব্যবস্থা করে ফলে সেখানে বড় মাপের পতিতালয় তৈরি হয়। [ তথ্যসুত্র: Sex in China; Fang Fu Ruan; Springer Science & Business Media,31-Oct-1991]

"প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রীষ্টপূর্ব ৩২১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৭) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতা বৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষের চিত্র পাওয়া যায়।

কৌটিল্যর আরেক নাম ছিল চাণক্য। তিনি প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রন্থ 'অর্থশাস্ত্র' - এর রচয়িতা। আর কৌটিল্যের সময় দেহব্যবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। ওই সময় দেহব্যবসা ছিল সন্মানিত পেশা। জ্ঞানী লোকেরা এ শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। [তথ্যসুত্র: কৌটিল্য: প্রেম ও নৈতিকতা, ড. প্রতাপ চন্দ্র, কলকাতা, ২০০০]"

আরো এক ধরনের পতিতাবৃত্তি চালু ছিল ভারতে - (Sacred prostitution) ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি। অর্থাৎ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে যৌন মিলন। এ ধরনের কাজে যে ব্যক্তি জড়িত থাকেন তাকে বলে দেবদাসী। দেবদাসী মন্দির সেবিকা। বর্ধিত অর্থে মন্দিরের বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী বা গণিকা। এখনও গোপনে ভারতের অনেক মন্দিরে দেবদাসী প্রথা চালু আছে।

এছাড়া "উত্তর ভারতে জিপসি সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়ে শিশুকে পতিতা বানানোর এক ধরনের প্রথা ছিল। বিহার ও উত্তর প্রদেশে ছিল নায়েক, পশ্চিম ভারতের গুজরাটে দেহে ও বর্ণের পতিতা এবং দাক্ষিণাত্যে ছিল মোহর নামক উপজাতীয় পতিতা। [তথ্যসুত্র: দৈনিক আজাদি ৪মে - ২০১৩]"

আর এইসব কারণেই মধ্যযুগ থেকেই পতিতার প্রসঙ্গ ও পরিচয় সাহিত্যে পাওয়া যায়। "পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিদারের রাজসভায় রচিত হয় গ্রন্থ 'লজ্জত উন নিসা' (একটি ভারতীয় কামোদ্দীপক উপাখ্যান)। যা ওই যুগেরই বিদ্যমান কামোদ্দীপক রচনা গুলির একটি। [ তথ্যসুত্র: Lazzat Un Nisa, translated by Jane Fine, Classex Books, 2002]"

সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তাঁর "কাদম্বরী" গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বে^...শ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাত। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বে^...শ্যারাই পরিয়ে দিত। "নবম শতকে 'কুট্টনীমত' গ্রন্থ লিখেছিলেন কাশ্মীরের মন্ত্রী ও কবি 'দামোদর গুপ্ত'। 'বিকরবালা' নামের এক বৃদ্ধা বে^...শ্যার উপদেশ নামা নিয়েই মুলতো 'কুট্টনীমত' গ্রন্থ লেখা। বাৎসায়নের কামসূত্রের মতোর 'কুট্টনীমত' একটা কামশাস্ত্র গ্রন্থ।" এছাড়া মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্য গুলিতেও বে^...শ্যা নারীর উল্লেখ আছে। দোনা গাজির- সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল, আবদুল হাকিমের- লালমতি সয়ফুল মুল্লুক, শুকুর মাহমুদের- গুপীচন্দ্রের সন্ন্যাস -- এইসব কাব্য পুথিতে বে^...শ্যা- সংস্কৃতির সরস বিবরণ দেওয়া রয়েছে।

বৃটিশ আমলের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে কি অবস্থা ছিল ওই সময়।

"১৮৫৩ তে কলকাতা শহরে ৪০৪৯ টি বে^...শ্যাগৃহ ছিল যাতে বাস করছিলেন ১২,৪১৯ জন যৌনকর্মী। ১৮৬৭ তে ছিল ৩০,০০০ জন। ১৯১১ সালের আদশুমারি অনুযায়ী ১৪২৭১ জন। ১৯২১ সালের আদম শুমারিতে অনুযায়ী ১০,৮১৪ জন যৌনকর্মী ছিল কলকাতায়। [তথ্যসুত্র: দেবাশিস বসু, 'কলকাতার যৌনপল্লী', সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বার্ষিক সংকলন ৫,২০০১]"

কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরো অনেক বেশী হবে। "কলকাতায় খুবই রমরমা ছিল বে^...শ্যাদের জগৎ। গৃহস্থের বাড়ির পাশে বে^...শ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বে^...শ্যা, চিকিৎসালয়ের পাশে বে^...শ্যা, মন্দিরের পাশে বে^...শ্যা। [তথ্যসুত্র: বিনয় ঘোষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, ১৯৯৯, পৃ. ৩০২-০৩]"

"বিশেষ করে রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা, ইমামবক্স এগুলো ছিল বে^...শ্যাদের আখড়া। [তথ্যসুত্র: বিশ্বনাথ জোয়ারদার, পুরনো কলকাতার অন্য সংস্কৃতি, ২০০৯, পৃ. ৩৪-৩৮]" (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - prostitution)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours