তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
কিংবদন্তি এক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন।
যিনি আমেরিকায় কেন সারা পৃথিবীতে বিরল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ ভুলে গেছে লিঙ্কনকে শুধু অতিরিক্ত মুনাফা ও যুদ্ধবাজ সর্বগ্রাসী নীতির জন্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের উত্থানটা বিস্ময়কর। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অনেকে ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছেন, নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। আবার সেই ভাগ্যের অসাধারণ ম্যাজিকে অনেকে অর্জন করেছেন অসামান্য খ্যাতি। সময়কে পরাজিত করে হয়ে উঠেছেন সর্বকালের সেরা কিংবা আলোচিত একজন। এদের মধ্যে অনেকে আবার একেবারে শূন্য থেকে জীবন শুরু করে পৌঁছেছেন পূর্ণতার শীর্ষে। এদেরই একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। মার্কিন ইতিহাস তো বটেই সমগ্র বিশ্বেই সর্বকালের সেরা শাসক কিংবা রাজনীতিবিদের তালিকায় অনায়াসে চলে আসে তার নাম। আব্রাহাম লিঙ্কনের ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষতার কারণে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও দারুণ শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয় তাকে। লিঙ্কনের শৈশব ছিল নিদারুণ কষ্টে ভরপুর। দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত ছিল তার পরিবার। বাবা মুচি ছিলেন। জুতা সেলাইয়ের কাজ করেও সংসার ঠিকমতো চালাতে পারতেন না তিনি। মাঝে মাঝে লিঙ্কন নিজেও বাবার কাজে সহযোগিতা করতেন। এই পরিবেশেই আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠেন আব্রাহাম লিঙ্কন। তখনও কেউ ভাবতে পারেনি এই ছেলে একদিন ইতিহাস হবে। ইতিহাস লিখবে। বিস্ময়কর সেই উত্থানের গল্প নিয়েই রকমারির এই আয়োজন।
আব্রাহাম লিঙ্কন আমেরিকা তথা আধুনিক দুনিয়ার ইতিহাসের এক কিংবদন্তি। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন জম্মগ্রহণ করেন ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রয়ারি এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল। অত্যন্ত গরিব পরিবারে জম্মগ্রহণ করেও স্বীয় প্রচেষ্টায় আমেরিকার অধিপতি হতে পেরেছিলেন। তার শৈশব ও কৈশোর ছিল দরিদ্রতা আর সংগ্রামে ভরপুর। এরপরও তিনি তার ভাগ্যকে পাল্টে ফেলতে পেরেছিলেন।
লিঙ্কনের বাবা মূলত জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। এই পেশার আয় থেকেই সংসার চালাতেন তিনি। জুতা তৈরিতে তার খ্যাতি ছিল। কিন্তু সামান্য আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো তার। কখনও কখনও লিঙ্কন নিজেও বাবার কাজে হাত লাগাতেন। বাবার কাছ থেকে জুতা সেলাইয়ের কাজ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন লিঙ্কন। সেই ছোটবেলা থেকেই লিঙ্কনকে সবাই মুচির ছেলে বলে খ্যাপাত। সবাই তাকে নীচু দৃষ্টিতে দেখত। বাবাকে নিয়ে আর দরিদ্রতাকে নিয়ে সবাই উপহাস করত। বন্ধুদের মধ্যে কেউই লিঙ্কনের সঙ্গে খুব একটা মিশতে চাইত না। তবে লিঙ্কন ছিলেন অদম্য। ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড মানসিক দৃঢ়তা ছিল তার। কোনোমতেই দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না তিনি। নিজের স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে জীবনে এগিয়ে চলেন। এরপর আস্তে আস্তে উত্থান শুরু হয় নতুন এক লিঙ্কনের। পরের গল্পটা সাফল্যে মোড়া।
মুচির ছেলে ছিলেন বলে তাকে সব সময়ই অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। তখন তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে মাত্র পরিচিতি লাভ করছিলেন। একবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা দিতে শুরু করলে এক ধনী ব্যক্তি তাকে থামিয়ে দেন। লোকটি তাকে বলেন, ‘লিঙ্কন আপনি মনে হয় ভুলে যাচ্ছেন আপনি একজন মুচির ছেলে। আপনার বাবা লোকের জুতা সেলাই করে। এমনকি তিনি আমাদের পরিবারের জন্য জুতা তৈরি করে দেন।’ এ নিয়ে তখন হাস্যরসের সূচনা হয়। কিন্তু লিঙ্কন লজ্জা পেলেন না। বরং দৃঢ়ভাবে এর জবাব দেন। তিনি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, আমার বাবা জুতা তৈরি করেন। তিনি খুবই দক্ষ একজন মুচি। কেউ কখনও আমার বাবার তৈরি জুতা নিয়ে অভিযোগ করেননি। আপনিও মনে হয় আমার বাবার তৈরি জুতা নিয়ে কোনও অভিযোগ রাখছেন না। যদি তার জুতা নিয়ে কোনও অভিযোগ না থাকে তাহলে মানতেই হবে তিনি সেরা। আমি আমার বাবাকে নিয়ে গর্ববোধ করি এবং আমি নিজেও জুতা সেলাই করি।’ লিঙ্কনের এই উত্তরে সবার হাস্যরস বন্ধ হয়ে যায়। উল্টো সবাই মুগ্ধ হয়। এভাবেই জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা বাধাগুলো ডিঙিয়ে সাফল্যের শীর্ষে উঠে আসেন লিঙ্কন।
আমেরিকার কেন্টাকি রাজ্যের একটি ছোট্ট গ্রামে কিংবদন্তি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের জম্ম। তার বাবা টমাস লিঙ্কন যে মুচি ছিলেন সেটা আগেই বলা হয়েছে। তিনি লেখাপড়া কিছুই জানতেন না। অতি কষ্টে দীন-দরিদ্রের মতো তিনি সংসার চালাতেন। লিঙ্কনের বয়স যখন চার তখন পাল্টে যায় তার আবাসস্থল। বাবা টমাস লিঙ্কন তখন পরিবার নিয়ে ইন্ডিয়ানা রাজ্যের অরণ্যময় অঞ্চলে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করলেন। বলা বাহুল্য, সেই জায়গাটি তখনও মানুষের বসবাসের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বাড়ির চারদিকে জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য বড় বড় খুঁটি পোঁতা থাকত। তখন লিঙ্কনের বাবার পেশাও পাল্টে যায়। কাঠের কাজ আর শিকার করেই নতুন করে সংসারের হাল ধরেন তিনি। এই কঠিন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে করতে লিঙ্কন হয়ে ওঠেন পরিশ্রমী ও সাহসী।
লিঙ্কনের বয়স যখন ছয়, তখন হঠাৎ করেই তার মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন সেখানে কোনও চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। এক গ্রাম্য ডাক্তার থাকতেন পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে। প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই সাত দিন পর মারা গেলেন লিঙ্কনের মা। মা মারা যাওয়ার এক বছর পরের ঘটনা। লিঙ্কনের বাবার পূর্ব পরিচিত এক মহিলার কিছু দিন আগে স্বামী মারা গিয়েছিল। সংসারে একজন মহিলার প্রয়োজন বিবেচনা করে তাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন টমাস। আব্রাহাম লিঙ্কনের সৎ মা অবশ্য তাকে আদর করতেন। মূলত সৎ মায়ের আগ্রহে লিঙ্কন শিখেছিলেন লিখতে, পড়তে, অঙ্ক করতে। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন, আমার স্কুল জীবন সর্বসাকুল্যে এক বছরের বেশি নয়। ধীরে ধীরে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পা দিলেন লিঙ্কন। দীর্ঘ দেহ, উচ্চতায় ছয় ফুট চার ইঞ্চি। লম্বা হাত, বলিষ্ঠ দেহ। দেহ অনুপাতে মাথাটি ছোট, যখন হাঁটতেন শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ত। তার বয়স যখন উনিশ, তখন নিউ অর্লিয়েন্স বন্দরে কিছু পণ্য নিয়ে যাওয়ার ভার পড়ল তার ওপর। একটি বড় নৌকা বোঝাই পণ্য নিয়ে রওনা হলেন লিঙ্কন।
সেখানে এসেই লিঙ্কন প্রথম দেখলেন নিগ্রো শিশু নারী পুরুষদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। দাসপ্রথার ব্যাপকতা দেখে তিনি এতখানি বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন তার এক সঙ্গীকে বলেছিলেন যদি আমি কোনও দিন সুযোগ পাই এই জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানব। নিউ অর্লিয়েন্সে ভালোই ব্যবসা করলেন লিঙ্কন। তার কাজে খুশি হয়ে পণ্যের মালিক তাকে নিউ সালেমের গুদামের ম্যানেজার করে দিলেন। এখানে কাজের তেমন চাপ ছিল না। অবসরের সময়টুকু তিনি নানা বিষয়ের বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন।
গুদামের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে পরিচয় ঘটে লিঙ্কন। একটি প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচন কেন্দ্রে কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। এরপর নিজের অজান্তেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। মধুর ব্যক্তিত্ব, সহযোগিতামূলক আচরণ, স্পষ্টবাদিতার কারণে অল্প দিনেই তিনি নিউ সালেমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি পরিচিত হলেন স্থানীয় একটি সরাইখানার মালিক জেমস রুটলেজর সঙ্গে। তিনি লিঙ্কন স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করেন। এর মধ্যেই ইলিনয় রাজ্যের প্রাদেশিক নির্বাচন শুরু হলো। কয়েকজনের উৎসাহে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন লিঙ্কন। কিন্তু রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণে তিনি নির্বাচনে পরাজিত হলেন। বেকার হয়ে পড়লেন।
এরপর বাধ্য হয়ে নিউ সালেমে পিয়নের চাকরি নিলেন। ১৮৩৪ সালে আবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন। এবার তিনি জয়লাভ করলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাকে যেতে হলো ইলিনয়ে। পরিষদের কাজকর্মের অবসরে তখনই তিনি আইন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক অভিপ্রায় যখন তার মধ্যে জেগে উঠল, লিঙ্কন দেখেন, তিনি তার কথার শক্তি দিয়ে তার প্রতিপক্ষদের কাবু করে ফেলার ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি তাদের প্রতি কড়া সমালোচনা ছুড়ে দিলেন। ১৮৪০ সালে এক রাজনৈতিক সভায় তিনি তার প্রতিপক্ষ লেস থমাসের নকল করে তাকে মজা করেছিলেন যা দর্শক তুমুলভাবে করতালি দিয়ে স্বাগত জানায়। অল্পদিনের মধ্যেই ইলিনয়ের রাজনৈতিক জগতে নিজেকে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন। অবশেষে ১৮৪৭ সালে ওয়াশিংটন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন ওয়াশিংটনের রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ হোয়াইট হাউসের অদূরেই গড়ে উঠেছে নিগ্রো দাসদের খোঁয়াড়। বিভিন্ন জায়গা এবং দেশ থেকে নিগ্রো দাসদের এখানে নিয়ে আসা হতো তারপর দক্ষিণের বাজারে চালান করে দেওয়া হতো।
দীর্ঘদিন ধরে লিঙ্কন ছিলেন এই দাস প্রথার বিরোধী। লিংকন পার্লামেন্টের সভায় কলম্বিয়া রাজ্যে দাস ব্যবসা বন্ধ করার জন্য একটি বিল উত্থাপন করলেন। সম্মিলিত বিরোধিতায় সেই বিল অগ্রাহ্য হলো। ব্যর্থ হয়ে লিঙ্কন ফিরে এলেন স্প্রিং ফিল্ডে। আবার আইন ব্যবসা শুরু করলেন। রাজনীতিতে আর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তার। কিন্তু দাস প্রথার বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়ে উঠলেন ঠিকই। ১৮৫৪ সালে নতুন রিপাবলিকান পার্টি গঠিত হলো। এই দলের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। তিনি এই দলের রাজনৈতিক আদর্শের কথা এত সুস্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করলেন, সব দেশ তার বাগ্মিতায় মুগ্ধ হলো। এর অল্প দিনের মধ্যে এক ঐতিহাসিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন লিঙ্কন। দক্ষিণের রাজ্যগুলো দাস প্রথার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি তুলতে আরম্ভ করেছিল। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ডগলাস প্রবলভাবে এই দাস প্রথা সমর্থন করতে আরম্ভ করলেন।
দক্ষিণের রাজ্যগুলো যখন বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য জোরালো দাবি পেশ করছিল লিঙ্কন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, একটি রাষ্ট্র কখনও দ্বিধাবিভক্ত হতে পারে না। আমেরিকা অবশ্যই এক এবং ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এই সময় রিপাবলিকান দলের জাতীয় সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য লিঙ্কনের নাম ঘোষণা করা হলো। রিপাবলিকান দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলেন লিঙ্কন। আর তার বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটিক দলের হয়ে প্রার্থী হলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ডগলাস। ডগলাসকে হারিয়ে লিঙ্কন আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন। ১৮৬১ সালের ফেব্রয়ারিতে লিঙ্কন স্প্রিং ফিল্ড ছেড়ে ওয়াশিংটনের দিকে রওনা হলেন। সঙ্গে স্ত্রী মেরি। তার এত দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই জয় আমৃত্যু লিঙ্কনের সব মানসিক শান্তিকে কেড়ে নিয়েছিল।
১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের যুদ্ধের প্রায় চার মাস পর ১৯ নভেম্বর পেনসিলভেনিয়ার গেটিসবার্গে শহীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে এক স্মরণসভায় সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন লিঙ্কন। বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফটো-সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফাররা ঠিকমতো ক্যামেরা সেট করার আগেই মাত্র তিন মিনিটে ২৭২ শব্দের বক্তৃতা শেষ করেন লিঙ্কন। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, Government of the People, by the People, for the People অর্থাৎ, ‘গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য’। যা গণতন্ত্রের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা হিসেবে আজও বিবেচিত। এই বক্তৃতার পর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন উপস্থিত জনতা। এমনকি হাততালি দিতেও ভুলে যান তারা। অনেকের ক্যামেরা সচল করার আগেই শেষ হয়ে যায় তিন মিনিটের বক্তৃতা। প্রচলিত নিয়মে অনুষ্ঠানের মূলবক্তা ছিলেন পেশাদার এবং বাকপটু অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট, যিনি প্রায় দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট দুঃখ করে বলেন, ‘আমি যদি আমার দুই ঘণ্টার বক্তৃতায় লিঙ্কনের তিন মিনিটের বক্তৃতার মূল কথার কাছাকাছি কিছু বলতে পারতাম, তাহলে আমার জীবন ধন্য হতো।’
আব্রাহাম লিঙ্কন যে চিঠিটা লেখেন তাঁর পুত্রের জন্য শিক্ষককে, সেই চিঠি আজও ইতিহাস বিখ্যাত।আব্রাহাম লিঙ্কনের ছেলের শিক্ষকের কাছে লেখা চিঠি।
মাননীয় মহোদয়,
আমার পুত্রকে জ্ঞানার্জনের জন্য আপনার কাছে প্রেরণ করলাম। তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন -এটাই আপনার কাছে আমার প্রত্যাশা। আমার পুত্রকে অবশ্যই শেখাবেন -সব মানুষই ন্যায় পরায়ন নয়, সব মানুষই সত্যনিষ্ঠ নয়। তাকে এও শেখাবেন-প্রত্যেক বদমায়েশের মাঝেও একজন বীর থাকতে পারে, প্রত্যেক স্বার্থপর রাজনীতিকের মাঝেও একজন নিঃস্বার্থ নেতা থাকেন। তাকে শেখাবেন -পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চাইতে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মুল্যবান। এও তাকে শেখাবেন -কিভাবে পরাজয়কে মেনে নিতে হয় এবং কিভাবে বিজয়োল্লাস উপভোগ করতে হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও তাকে দিবেন। যদি পারেন নীরব হাসির গোপন সৌন্দর্য তাকে শেখাবেন। সে যেন আগেভাগেই একথা বুঝতে শেখে-যারা পীড়নকারী তাদেরকে সহজেই কাবু করা যায়। বইয়ের মাঝে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, তাও তাকে শেখাবেন। আমার পুত্রকে শেখাবেন, বিদ্যালয়ে নকল করে পাশ করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক।
নিজের উপড় তার যেন সুমহান আস্থা থাকে-এমনকি সবাই যদি সেটাকে ভুলও মনে করে। তাকে শেখাবেন, ভদ্রলোকের প্রতি ভদ্র আচরণ করতে, কঠোরদের প্রতি কঠোর হতে। আমার পুত্র যেন এ শক্তি পায়- হুজুগে মাতাল জনতার পদাঙ্ক অনুসরন না করার। সে যেন সবার কথা শোনে এবং সত্যের পর্দায় ছেঁকে যেন ভালটাই শুধু গ্রহণ করে- এ শিক্ষাও তাকে দেবেন। সে যেন শেখে দুঃখের মাঝে কিভাবে হাসতে হয়। আবার কান্নার মাঝে লজ্জা নেই-সে কথা তাকে বুঝতে শেখাবেন। যারা নির্দয়, নির্মম তাদেরকে সে যেন ঘৃনা করতে শেখে আর অতিরিক্ত আরাম-আয়েশ থেকে সাবধান থাকে। আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না, কেন না আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না থাকে, থাকে যেন তার সাহসী হবার ধৈর্য। তাকে এ শিক্ষাও দেবেন- নিজের প্রতি তার যেন সুমহান আস্থা থাকে আর তখনই তার সুমহান আস্থা থাকবে মানব জাতির প্রতি।
ইতি
আপনার বিশ্বস্ত,
আব্রাহাম লিঙ্কন
(www.theoffnews.com - Abraham Lincoln)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours