তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

বঙ্কিম জীবন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা না বললেই নয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয় বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তারিখ ২৬ জুন ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫। চট্টোপাধ্যায়দের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রামজীবন চট্টোপাধ্যায় কাঁঠালপাড়ার রঘুদেব ঘোষালের কন্যাকে বিবাহ করেন৷ রামজীবনের পুত্র তথা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র, মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী, বঙ্কিমের পূর্বে তার আরও দুই পুত্রের জন্ম হয় – শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তার অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমের কণিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় বঙ্কিম কোনওদিনই যাননি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তার গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে বিশেষ উপকৃত হননি। তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।” 

১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আনীত হলে, সেখানেই তার প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তার স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন। ১৮৪৭ সালে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনক্লেয়ার তার স্থলাভিষিক্ত হন; তার কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁঠালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতা দুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এই সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাকে শিক্ষা দেন - “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তার পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল।

কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে (অধুনা হুগলী মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তার বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মতো বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু।

তার বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্‌টার পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং বাঙলা তথা ভারতের নবজাগরণের অন‍্যতম মুখ হিসেবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত।

নৈহাটির কাঁটালপাড়ার চাটুজ্জে বাড়ির জমিতে বঙ্কিম করলেন চার কামরার বৈঠকখানা। জমিটি বঙ্কিমের পরিবারের নিকটাত্মীয়া দিগম্বরী দেবীর। নিঃসন্তান দিগম্বরী অল্পবয়সে বিধবা হন। তাঁর দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তির ভাগ পান বঙ্কিমের পিতা যাদবচন্দ্র। দিগম্বরীর জমিতে তৈরি এই বৈঠকখানা ঘর হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্য ও নবজাগরণের এক পীঠস্থান। এই ঐতিহাসিক কক্ষে বসেই লেখা হয় ‘বন্দেমাতরম্‌’ সঙ্গীত। এখান থেকেই বেরিয়েছে ‘বঙ্গদর্শন’, ‘প্রচার’ ও ‘ভ্রমর’ পত্রিকা।

বিখ্যাত ‘বঙ্গদর্শনের আড্ডা’-র অক্ষয়চন্দ্র সরকার, নবীনচন্দ্র সেন, দীনবন্ধু মিত্র, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দামোদর মুখোপাধ্যায় নিয়মিত আসতেন এই ঘরে। এই ঘরের ইতিহাসের সঙ্গে বঙ্গীয় নবজাগরণ বা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠ পর্বের যোগ থাকলেও হারিয়ে গেছে সেই অসহায় বিধবা দিগম্বরী দেবীর নাম, যিনি গোটা চাটুজ্জে পরিবারে পরিচিত ছিলেন ‘ছোটো ঠাকুরাণী দিদি’ হিসেবে। পরিবারের জীর্ণ দলিল আর চিঠিপত্রে তাঁর নামটুকু কেবল মেলে।

বঙ্কিমের মা দুর্গাসুন্দরী দেবী, দিদি নন্দরাণী দেবী, বৌদি নবকুমারী দেবী— সকলের ভূমিকাই বঙ্কিমের জীবনে গভীর। বঙ্কিমের মা দুর্গাসুন্দরী শিক্ষিতা ছিলেন না, কিন্তু পাকা গৃহিণী ছিলেন। বঙ্কিম তাঁর ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে ব্রজেশ্বরের মায়ের চরিত্রটি দুর্গাসুন্দরীর আদলে লিখেছিলেন। বঙ্কিম বলেছিলেন, ছেলেবেলায় মায়ের কাছ থেকে তিনি একটুও নীতিশিক্ষা পাননি— ‘কুসংসর্গটা ছেলেবেলায় বড় বেশি হইয়াছিল। বাপ থাকতেন বিদেশে, মা সেকেলের উপর আর একটু বেশি, কাজেই... নীতিশিক্ষা কখনো হয়নি। আমি যে লোকের ঘরে সিঁদ দিতে কেন শিখিনি বলা যায় না’।

বঙ্কিমের দিদি, অর্থাৎ যাদবচন্দ্র-দুর্গাসুন্দরীর একমাত্র কন্যাসন্তান নন্দরাণী দেবী। দুই ভাই সঞ্জীবচন্দ্র এবং বঙ্কিমচন্দ্রকে ইনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বিশেষত সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতি তাঁর ভালবাসা একটু বেশিই ছিল। বেহিসেবি ও বাউন্ডুলে সঞ্জীবচন্দ্র প্রায়ই অতিরিক্ত দেনার দায়ে পালিয়ে যেতেন কর্মস্থল বিহারের বাঁকিপুরে। সেখানেই তিনি সম্পূর্ণ করেন তাঁর ‘মাধবীলতা’ উপন্যাসটি। নন্দরাণীও মাঝে মাঝে বাঁকিপুরে গিয়ে থাকতেন। এক বার বৌমার সঙ্গে ঝগড়া করে সঞ্জীবচন্দ্রের স্ত্রী নবকুমারী দেবী রাগ করে কাশীধাম চলে যাওয়া মনস্থ করেন। সে যাত্রা নন্দরাণী সামলান। মৃত্যুর আগে কুলপ্রথা অনুযায়ী যাদবচন্দ্রকে অন্তর্জলি যাত্রা করানো হয়েছিল। তিন রাত তিনি নৈহাটির গঙ্গার ধারে একটি ঘরে ছিলেন। সেবার জন্য ছিলেন তাঁর আদরের মেয়ে নন্দরাণী, যাঁকে যাদবচন্দ্র উইল করে নিজের জমি ও বাড়ির একাংশ দিয়ে গিয়েছিলেন। সে দিনের গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে যা এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। বঙ্কিমের প্রিয়তম বৌদি, সঞ্জীবচন্দ্রের স্ত্রী নবকুমারী ছিলেন একান্ত দুঃখিনী। স্বামী তো বটেই, ছেলে জ্যোতিশ্চন্দ্রও তাঁকে আজীবন যন্ত্রণা দিয়েছেন। যথেষ্ট প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও সঞ্জীবচন্দ্র চাকরিজীবনে সফল হতে পারেননি। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে যোগদান করলেও চাকরিক্ষেত্রে চূড়ান্ত অপমান ও অশান্তির জন্য সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেন সঞ্জীব। তাঁর সংসার চালানোর দায়িত্ব এসে পড়ে বঙ্কিমের উপর। খামখেয়ালি, শৌখিন, বেহিসেবি, ঋণগ্রস্ত সঞ্জীবকে নিয়ে স্ত্রী নবকুমারীর মানসিক যন্ত্রণা ছিল অপরিসীম। পুত্র জ্যোতিশ্চন্দ্রও মা নবকুমারীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন, কটু কথা শোনাতেন। বঙ্কিম এই দুঃখিনী বৌদিকে মায়ের মতো ভক্তি করতেন। ভাইপো জ্যোতিশ্চন্দ্রকে চিঠিতে লেখেন— ‘তুমি মাতার প্রতি যেরূপ দুর্ব্যবহার করো, তাহা কানে শুনা যায় না... এরূপ নরাধমের যে সাহায্য বা তাহাকে যে স্নেহ করে, সেও তাহার ন্যায় নরাধম... তোমার মাতা আমার পূজনীয়া। আমি তাঁহাকে খাইতে অবশ্য দিব। কিন্তু তোমাকে দিব না’। এমনকি পুত্রবধূ মোতিরাণীর সঙ্গেও বনিবনা হত না নবকুমারীর।

কিন্তু হায় বাঙালি হিসেবে আজ লজ্জা নেই বলতে তাঁর জন্মদিনে বঙ্কিম বোধকে আমরা ভুলতে বসেছি। বাঙালি কি বিস্মরণ প্রিয় জাতি? (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Bankim Chandra Chattopadhyay)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours