তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
প্যারিচরণ সরকারের নামে কলকাতায় দুটি রাস্তা আছে। প্রথমটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও হেয়ার স্কুলের মধ্যবর্তী অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে প্রসারিত নাম প্যারিচরণ সরকার স্ট্রিট। ওপর রাস্তাটি বিডন স্ট্রিটে। তাঁর বাড়ির কাছে প্যারি রো নামে নামাঙ্কিত হয়েছে। বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও চিত্র জগতের প্রবাদ পুরুষ ছবি বিশ্বাসের পিতামহ ছিলেন কালী প্রসন্ন বিশ্বাস। তাঁর আবাস ভবনের নাম ছিল কালী নিকেতন। বিডন স্ট্রিট ও গোয়াবাগানের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। ভবনটি ৩৪ নম্বর বিডন স্ট্রিটে অবস্থিত। ১৯২২ সালে তাঁর বাড়ির সামনে গলিপথটি কালী বিশ্বাসের নামে নামাঙ্কিত হয়। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাঁর বাড়িতে ছিল বিরাট পুস্তক সংগ্রহ। তাঁর কৃতি সন্তান ছবি বিশ্বাস রঙ্গমঞ্চে ও সিনেমাতেও অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
৩৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটের এই বাড়িতে রামকৃষ্ণ দেবের প্রদর্শিত কল্পতরু উৎসবের প্রথম সূত্রপাত হয় ১৯০১ সালে। এই ভবনটি নাগ ভবন নামে খ্যাত। ১৯২৩ সালে রামকৃষ্ণের শিষ্য কালী প্রসাদ চন্দ্র ৪০ নম্বর বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে শ্রী রামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটি (পরেমঠ) স্থাপন করেন। ইনি পরবর্তী কালে পরিচিত হন স্বামী অভেদানন্দ নামে। বেদান্তে তাঁর অসামান্য দক্ষতার জন্য লোকে তাঁকে কালী বেদান্ত বলে ডাকতো।
৪৬ নম্বর বিডন স্ট্রিটে থাকতেন কবিরাজ যামিনী রায়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করে তিনি আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এবং পরে আয়ুর্বেদ কলেজ ও তৈরি করেন। উল্টোডাঙ্গায় কবিরাজ যামিনী রায়ের নামে যামিনী কবিরাজ রো নামে একটি রাস্তা আছে। তাঁর অবদানের শেষ নেই এই বাংলায়। মৃত্যুর আগে ইনি দুই লক্ষ টাকা দান করেন ওই কলেজের জন্য। তবে বিডন স্ট্রিটের মধ্যমনি ছিলেন সেকালের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও দান বীর রাম দুলাল দে সরকার (১৭৫২ -১৮২৫)। ৬৭ নম্বর বিডন স্ট্রিটের বিশাল ভবন তাঁর বসত বাটি ছিল। রামদুলাল সরকার (দে) একই মানুষ। এই রাম দুলালের জন্ম দমদমের রেকজানি গ্রামে। এর নামেই রাস্তা রাম দুলাল সরকার স্ট্রীট।৬৭ ই বিডন স্ট্রিট -- রামদুলাল দে (দেব সরকার)-র বাড়ির ঠিকানা এটাই। তিনি ছিলেন ভারত-মার্কিন বাণিজ্যের পথিকৃৎ এবং প্রথম আধুনিক বাঙালি কোটিপতি। তাঁর মার্কিন বাণিজ্যিক অংশীদাররা তাঁকে এতটাই সম্মান করতেন যে তাঁরা একটা জাহাজের নামকরণ করেছিলেন রামদুলাল দে-র নামে। জাহাজটি সালেম বন্দর (বোস্টনের কাছে) থেকে কলকাতা বন্দর পর্যন্ত বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছে। জর্জ ওয়াশিংটনের একটি চমৎকার আঁকা ছবিও তাঁকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে আসল বাড়ির একটি নাটমন্দির এবং কিছু ঝাড়বাতিই কেবল অবশিষ্ট আছে। ১৭৭০ সালে রামদুলাল দে এখানে দুর্গাপূজা শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই পুজো তাঁর দুই ছেলের নামে নামাঙ্কিত হয়ে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ছাতুবাবুর আসল নাম ছিল আশুতোষ এবং লাটুবাবুর আসল নাম ছিল প্রমথনাথ দেব। এ নাম বললে প্রাথমিক ভাবে হয়তো এঁদের চিনতে একটু হোঁচট খেতে হতে পারে। কিন্তু এই নামের আড়ালেই লুকিয়ে আছেন চিরপরিচিত সেই মানুষ দু’টি— ছাতুবাবু এবং লাটুবাবু। পুরনো কলকাতার গল্পগাছা এই দুই ভাইকে বাদ দিয়ে নেহাতই অসম্ভব। বড় ভাই ছাতুর নাম আশুতোষ আর ছোট ভাই লাটুই হলেন প্রমথনাথ। কলকাতার ইতিহাসে ছাতুবাবু-লাটুবাবু বিখ্যাত হয়ে আছেন আরও একটি কারণে --- বুলবুলির লড়াইয়ের জন্য। কলকাতার বাবুদের অনেক রকম বিদঘুটে শখের একটি ছিল বুলবুলির লড়াই। অঢেল ঐশ্বর্যের মালিক ছাতুবাবুর ছিল খাঁটি বড়লোকের মেজাজ। বুলবুলির লড়াইয়ের প্রতি তাঁর এমনই অদম্য নেশা ছিল যে বাজি ধরে খেলতে গিয়ে ফতুর হতেও তাঁর আপত্তি ছিল না। ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের নিজস্ব বুলবুলির সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। পাখিকে দানাপানি খাইয়ে প্রচুর টাকা ব্যয় করে যুদ্ধ কৌশল শেখানো হত। এমনকী বুলবুলির জন্মকুষ্ঠি নিয়েও চলত বিস্তর গবেষণা। এই বেলগাছিয়ার অতিথিশালা উনি তৈরি করেন। উনার দানের শেষ নেই। এই হিন্দু কলেজের পেছনে উনার অবদান অনেক খানি। উনারি দত্তক পৌত্র ছিলেন অনাথ নাথ দে। যার নামে অনাথ নাথ দেব লেন।
রামদুলাল দে (১৭৫২-১৮২৫) প্রথম বাঙালি কোটিপতি। শৈশবে পিতৃমাতৃহীন এবং নিঃস্ব রামদুলাল পরবর্তী জীবনে একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। কলকাতার হাটখোলার বানিয়া মদনমোহন দত্তের বাড়ির সরকার বা গৃহস্থালির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে রামদুলাল দের ব্যবসায়িক জীবনের সূচনা হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা যায় যে, একবার তাকে নিলামে কিছু জিনিস কিনতে পাঠানো হয়। কিন্তু নির্ধারিত নিলামি জিনিসটি অলাভজনক মনে করে তার পরিবর্তে তিনি একটি ভাঙা জাহাজ কেনেন, যা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এক লক্ষ রূপী লাভ হয়। এ ঘটনার পর মদনমোহন দত্ত নিলামের পুরো অর্থ রামদুলালকে দান করেন এবং তাকে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার অনুমতি দেন। শোনা যায় তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যের পর উনি তাঁর মালিক মদন মিত্রর বাড়িতে অতি সাধারণ পোশাকে দেখা করতে গিয়েছিলেন। শুধু উনি যে পোশাক পরে প্রথম চাকরি করে গিয়েছিলেন, সেই পোশাক পরেই যখন উনার বাড়িতে ঢুকেছিলেন, বাড়ির দারোয়ান রামদুলালকে ঢুকতে বাধা দেন, মানে চিনতে পারেননি। রামদুলালের সাথে নব্য বাঙালি ও ব্যবসায়ীদের কোনও মিল নেই। এই কারণেই নামের পাশে বাবু নেই। আর এই সব কারণেই ইনি প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ।
বেলগাছিয়াতে এক বিশাল অতিথি শালা তৈরি করে, প্রতিদিন এক হাজার লোককে সিধা দান করা হতো, হিন্দু কলেজ তৈরিতে ৩০০০০.০০ টাকা বারাণসীর শিব মন্দির নির্মাণে ২,২২০০০ টাকা, মাদ্রাজার দুর্ভিক্ষে ১০০০০০ টাকা, এমন অসংখ্য সামাজিক কারণ ও প্রকল্পে তাঁর প্রভূত দান আছে। এত দান ধ্যানের পরও ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুর সময় তাঁর সম্পত্তির পরিমান ছিল এক কোটি ২২ লক্ষ টাকা। আজকের দিনে এই টাকা কত হতে পারে কেউ ভাবতে পারেন? এদের বাড়ির দুর্গাপুজোও ঐতিহাসিক।
রামদুলালের কোষাগার ফুলেফেঁপে উঠেছিল অচিরেই। বলা হয়, রামদুলাল দেব ছিলেন বাংলার প্রথম কোটিপতি। এই রামদুলাল দুর্গাপুজোর প্রচলন করলেন ১৭৭০ সালে, তাঁর বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে। তিনি প্রয়াত হবার পর উত্তরাধিকার সূত্রে পুজোর দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর দুই পুত্র আশুতোষ নাথ দেব বা ছাতুবাবু, ও প্রমথনাথ দেব বা লাটুবাবুর ওপর। কলকাতার বাবু কালচারের দুই দিকপাল ছিলেন এই দুই ভাই। ছাতু বাবু দানেও ছিলেন অকৃপণ। তিনি হিন্দু দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার টাকা ১৮৪৬ সালে দান করেন। অতিথি শালা দেবালয় এবং সালকিয়াতে গঙ্গার ঘাট (যা ছাতু বাবুর ঘাট নামে পরিচিত) ও শ্বশান ঘাট নির্মাণে বহু অর্থ ব্যয় করেছেন। বিভিন্ন হিন্দু তীর্থে তাঁর নিদর্শন এখনও বর্তমান।
পূজাপার্বন ও বিভিন্ন উৎসবে ছাতুবাবু ও লাটু বাবু প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। রামদুলাল দে সরকারের আদি বাড়ির সামনের গলিপথ লাটু বাবু লেন নামে নামাঙ্কিত হয়েছে। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছাতু বাবুর নামে বেলেঘাটা অঞ্চলে একটি রাস্তা আছে। বিডন স্ট্রিটে ছাতু বাবুর বাজার যেটা লোকমুখে প্রচারিত সেটি স্থাপন করেছিলেন রামদুলালের পোষ্য পুত্র অনাথ নাথ দেব। এই অনাথবাবুর বাজার উত্তর কলকাতার প্রধান বাজার গুলির অন্যতম ছিল। ১৪ বিঘা জমির উপর ৬৭ নম্বর বিডন স্ট্রিটে রামদুলালের প্রধান বাস ভবন অবস্থিত ছিল। এখন ছাতু বাবু ও লাটুবাবুর বৈঠক ঘর, নাচ ঘরের অস্তিত্ব নেই। ১০ এ লাটুবাবু লেনে দুটি শিব মন্দির আছে প্রতিষ্ঠাতা আশুতোষ দেব।
রাম দুলালের যে বিপুল অর্থ ভান্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন তাঁর পুত্রেরা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ না করে তৎকালীন বাবু কালচারের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন, বহু অর্থ অপব্যয় করলেন। তবে তাদের উত্তর পুরুষগণ সঞ্চিত অর্থ জনকল্যাণ ও দেশ হিতার্থের জন্য অনাথ নাথ দেব ট্রাস্ট এস্টেট প্রতিষ্টা করে কলকাতার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। (সমাপ্ত)
(www.theoffnews.com - Beadon street)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours