কেয়া ঘোষ, ফিচার রাইটার, আসানসোল:
গত প্রায় পনেরো কুড়ি দিনের মধ্যে তিনটে এমন ভয়ংকর হাড় হিম করা অপরাধমূলক ঘটনা শহর কলকাতা ও তার আশেপাশে ঘটে গেছে যার কথা ভাবলে আমাদের মত সাধারণ মানুষের হাত পা মন মস্তিষ্ক সব কেমন ভয়ে অসাড় হয়ে যায়। শিক্ষা, সংস্কার এবং সামাজিক সচেতনতা কতখানি তলানিতে গিয়ে ঠেকলে তবে এমন এক একজন অপরাধীর সৃষ্টি হতে পারে! তাহলে ধরে নিতে হচ্ছে যে, যে ধারার শিক্ষা এবং সংস্কার তারা পাচ্ছে তা একেবারেই ফলপ্রসূ নয়! জন্ম থেকেই তো তারা অপরাধী হয়ে এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়নি। তিলে তিলে একটু একটু করে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা জন্ম নিয়েছে। আমার প্রশ্ন এখানেই! কিসের অভাব অথবা কিসের প্রাচুর্য তাদের এইরকম অপরাধমূলক কাজে প্রবৃত্ত করছে?
সুদূর পাঞ্জাব থেকে পালিয়ে এসে নিউটাউনের মত জনবহুল এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে বহুতল আবাসনে লুকিয়ে থাকা দুষ্কৃতী, মালদহের কালিয়াচকের মাত্র ১৮ বছর বয়েসের একাধিক বাড়ীর মানুষজনকে নির্দয়ভাবে হত্যা করার অপরাধে অপরাধী কিশোর, কিংবা ইংরাজীতে এমএ ডিগ্রীধারী পাকা চোর যার শখ হল চুরি করা। এই তিনটে রোমহর্ষক ঘটনা আমাদের সন্তান পালনের আমূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে একটা মস্তবড়ো প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় গোটা সমাজকে। কোথাও কি একটা মস্তবড়ো ফাঁক থেকে যাচ্ছে? মনস্তত্ত্ববিদেরা অবশ্যই এ নিয়ে প্রচুর আলাপ আলোচনা করবেন করছেন সমাজমাধ্যমে, সংবাদপত্রে। তাতে আখেরে কোনও লাভ কি আদৌ হচ্ছে?
গলদটা কোথায়? আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের বিচারে গলদটা গোড়ায়। এ পর্যন্ত বা এর আগেও যতগুলো নৃশংস অপরাধ আমরা ঘটতে শুনেছি তার সব-কটিতেই নাটের গুরু বা প্রধান অপরাধী বিভিন্ন বয়সের পুরুষ। তা চোদ্দ থেকে মধ্য চল্লিশেরও হতে পারে। আসলে ভারতবর্ষে আজও জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে আমরা পুত্রসন্তানেরই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কন্যাসন্তানদের এখনও ভারতবর্ষ সঠিক ভাবে গ্রহণ করার মানসিকতায় অশিক্ষিতই থেকে গেছে। তাই পুত্রের গরবে গরবিনী বা গর্বিত পিতা- মাতার মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয়ে তারা এক-একজন জুনিয়র কংস হয়ে ওঠে। ছোটবেলা থেকেই তারা বাবা- মায়েদের তাদের প্রয়োজন এবং শখ মেটানোর যন্ত্র বলে মনে করতে থাকে। আমরা তো এখন আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বই পড়ি না। বাচ্চাদেরও পড়াই না। তাই এখন আর কেউ ভুবনের গল্পও জানে না। চুরি করার অপরাধে যখন ভুবনকে কারাগারে বন্দী করা হয়েছিল তখন বিদ্যাসাগরের ভুবন তার মাসীর কান কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছিল কারণ মাসী প্রথম চুরি করার পরে তাকে বারণও করেনি এবং সাবধানও করেনি এই বলে যে চুরি করা মস্তবড়ো অপরাধ।
আজকের সমাজে ঠিক সেইরকমই সঠিক অনুশাসনের অভাব, অগাধ প্রশ্রয় এবং অর্থের প্রাচুর্য বর্তমান প্রজন্মকে লাগামছাড়া হতে বাধ্য করেছে। তার সঙ্গে রয়েছে বিনোদন এবং কম্পিউটারের রহস্যময় দুনিয়ার বিপুল হাতছানি।ছোটবেলা থেকেই হয়ত ছোটখাট নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে তাদের এই অপরাধ প্রবনতা দেখা গিয়েছিল কিন্তু বাৎসল্য স্নেহের প্রাবল্যে তা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। একটা সময়ে বাড়তে বাড়তে সেটা অবশেষে মহীরুহ। লাগাম ছাড়া প্রশ্রয় বা লাগামছাড়া শাসন কোনটাই বোধহয় সন্তানদের জন্য সুখকর নয়।
কোনও সংশোধনাগারেই কি এদের সম্পূর্ণ সংশোধন সম্ভব? এমন কোনও আদর্শই কি আমরা সামনে রাখতে পেরেছি যাকে তারা অনুসরণ করতে পারে। যতদিন স্কুল, কলেজ, খেলাধূলা নিয়ে ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত থাকত ততদিন তবুও কিছুটা আশা ছিল। আজকের এই ভয়ংকর অতিমারীর কালে তাদের সামনে আমরা কোন ভবিষ্যৎ সাজিয়ে রেখেছি যাতে গহীন আঁধারে তারা পথভ্রষ্ট না হয়? যাদের জীবন থেকে এই দুটো বছর চলে গেল তাদের ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে? কেউ কি ভেবেছেন একবারও?
(www.theoffnews.com - society crime guilty)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours