তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

একশো চুয়ান্ন বছর আগে বিষ্ণুপুর থেকে মান্দারনের পথে বাংলা উপন্যাসের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। ২৬ জুন মানে আজ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। বাঙালির অনেক প্রত্যাশার দায় এই বৃহৎ বাঙালিটিকে নিতে হয়েছে। কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমের জন্মস্থান, দু’-চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা তাঁর নাম-জড়িয়ে-থাকা স্কুল-কলেজে তাঁর মুর্তিতে নিয়মরক্ষার মাল্যদান ছাড়া, বিশেষ কোনও উদযাপন আজ এ বঙ্গে ঘটবে বলে মনে হয় না। অথচ, রবীন্দ্রনাথের আগে আধুনিক বাঙালি চিন্তাবিদ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া, আর কেউ ছিলেন না।

বঙ্কিমচন্দ্র কেবল ঔপন্যাসিক বা প্রাবন্ধিক নন, এক গভীর চিন্তক। ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর একটি নিজস্ব দর্শন ছিল। হিন্দুত্বে আস্থা রেখেও, সে দর্শন গভীর ও ব্যাপক। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই হিন্দুত্বও নিছক কোনও দেবতার জয়ধ্বনি নয়, কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসটির কারণে বঙ্কিমচন্দ্রকে সঙ্কীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রকট মুর্তি হিসেবে দেখার একটা ‘ট্র্যাডিশন’ আজও সমানে চলছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তা বোধের প্রধান নির্ভর শক্তি ছিল, বাঙালি ও বাংলা ভাষা। যা আজ আক্রান্ত গোবোলয়ের চেতনার দ্বারা। আরও বিশদে বললে, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির গোষ্ঠীকে ভর এবং লক্ষ করেই ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তার বোধ তৈরি করতে চেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। সফল কতটা হয়েছিলেন, সে বিচার ইতিহাস করবে। কিন্তু এ কথা মনে রাখা ভাল, যে ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই দ্বিতীয়ার্ধে ভারতবর্ষে বাঙালির এই কোণঠাসা অবস্থা হয়নি। তখনও বাংলার ভাবনা আর সমগ্র ভারতের ভাবনার মধ্যে আজ আর কালের তফাত ছিল।

বঙ্কিমের ইতিহাস-চিন্তা তাই রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রথমশিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১২৮১) বইটির সমালোচনা-সূত্রে প্রকাশিত হয় বঙ্কিম সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। ওই সমালোচনায় বঙ্কিম লিখছেন, ‘সাহেবেরা যদি পাখী মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। গ্রীন্‌লণ্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাওরি জাতির ইতিহাসও আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্তি, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষধচরিত, গীতগোবিন্দ লিখিত হইয়াছে, যে দেশ উদয়নাচার্য্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, সে দেশের ইতিহাস নাই। মার্শমান্, স্টুয়ার্ট্ প্রভৃতি প্রণীত পুস্তকগুলিকে আমরা সাধ করিয়া ইতিহাস বলি; সে কেবল সাধ-পুরাণ মাত্র’।

কিন্তু শুধু ইতিহাসের জন্য ইতিহাস নয়, ‘অহঙ্কার অনেক স্থলে মনুষ্যের উপকারী; এখানেও তাই। জাতীয় গর্বের কারণ লৌকিক ইতিহাসের সৃষ্টি বা উন্নতি; ইতিহাস সামাজিক বিজ্ঞানের এবং সামাজিক উচ্চাশয়ের একটি মূল। ইতিহাসবিহীন জাতির দুঃখ অসীম। এমন দুই একজন হতভাগ্য আছে যে, পিতৃপিতামহের নাম জানে না; এবং এমন দুই এক হতভাগ্য জাতি আছে যে, কীর্তিমন্ত পূর্বপুরুষগণের কীর্তি অবগত নহে। সেই হতভাগ্য জাতিদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য বাঙ্গালী’।

ইতিহাস, অনেক জায়গায় আবেগ এবং কিছুটা অনৈতিহাসিকতা-মিশ্রিত ইতিহাসও তাই বঙ্কিম সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। বাংলা উপন্যাসের জন্মও তাই হল ইতিহাসের হাত ধরে, ১৮৬৫ খ্রীস্টাব্দে, বিষ্ণুপুর থেকে মান্দারনের পথে। নির্জীব, এলানো বাংলা ভাষার প্রবাহকে ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়ে শুরু হল ‘দুর্গেশনন্দিনী’, বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক উপন্যাস, ‘৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। দিনমণি অস্তাচলগমনোদ্যোগী দেখিয়া অশ্বারোহী দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। কেন না, সম্মুখে প্রকাণ্ড প্রান্তর; কি জানি, যদি কালধর্মে প্রদোষকালে প্রবল ঝটিকা বৃষ্টি আরম্ভ হয়, তবে সেই প্রান্তরে, নিরাশ্রয়ে যৎপরোনাস্তি পীড়িত হইতে হইবে। প্রান্তর পার হইতে না হইতেই সূর্যাস্ত হইল; ক্রমে নৈশ গগন নীলনীরদমালায় আবৃত হইতে লাগিল। নিশারম্ভেই এমন ঘোরতর অন্ধকার দিগন্তসংস্থিত হইল যে, অশ্বচালনা অতি কঠিন বোধ হইতে লাগিল। পান্থ কেবল বিদ্যুদ্দীপ্তিপ্রদর্শিত পথে কোন মতে চলিতে লাগিলেন’।

বাংলা ভাষার এই দীপ্তি দেড়শো বছরেরও বেশি আগে সম্ভব হয়েছিল। নিছক উপন্যাস লেখার জন্য উপন্যাস লিখলে তা সম্ভব হত বলে মনে হয় না। বঙ্কিমচন্দ্র সে পথে যাননি। বাংলা ভাষাকে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তার প্রকাশ যোগ্যতাকে বিস্তার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিস্তারকে আমরা মনে রাখিনি। ‘সাহিত্যসম্রাট’ তকমা লাগিয়ে আদর করে শিকেয় তুলে রেখেছি বঙ্কিম রচনাবলীকে। আর, প্রয়োজনমতো ব্যবহার করেছি তাঁকে। ব্যবহার করার সময়, নিজেদের স্বার্থেই মনে রাখিনি সমগ্র বঙ্কিমকে। ‘আনন্দ মঠ’-এর প্রথম দিককার সংস্করণগুলি উল্টে দেখিনি, দেখলে চোখে পড়ত, সেখানে সন্তানদলের প্রতিপক্ষ ইংরেজ। ভাল করে তাঁর প্রবন্ধগুলি পড়িনি। পড়লে খুঁজে পেতাম এই বঙ্কিমকেও, যিনি বলছেন, ‘মনুষ্যজাতিমধ্যে কাহারই বহুবিবাহে অধিকার নীতিসঙ্গত হইতে পারে না’। এর সঙ্গে যোগ করছেন পাদটীকা, ‘কদাচিৎ হইতে পারে বোধ হয়। যথা অপুত্রক রাজা, অথবা যাহার ভার্যা কুষ্ঠাদি রোগগ্রস্ত। বোধ হয় বলিতেছি, কেন না, ইহা স্বীকার করিলে পুরুষের বিপক্ষেও সেইরূপ ব্যবস্থা করিতে হয়’।

১৮৩৮-এর ২৬ জুন জন্ম হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের। আর বছর সতেরো পরে তাঁর জন্মের দু’শো বছর হবে। তখন এ বঙ্গে উদযাপনের ঢল নামবে হয়তো। আপাতত মুর্তিপুজোর অভ্যেস ছেড়ে, ‘বঙ্কিমী-বাংলা’ বলে দূরে সরিয়ে না রেখে, নতুন করে পড়া শুরু করা যাক গোটা বঙ্কিমকে।

বঙ্কিমচন্দ্র মনে করতেন যে, বাঙালির ইতিহাস নেই এমন নয়, অথচ আমরা নানা অতিকথা গিলে আর পরের মুখে ঝাল খেয়ে সেই অতীতের কথা ভুলে গিয়েছি। বখতিয়ার খিলজি সতেরো জন ঘোড়সওয়ার সঙ্গে নিয়ে তামাম বাংলা জিতে নিলেন, মিনহাজউদ্দিনের এই ‘উপন্যাস’ নিছকই গল্পকথা। একে বাংলার ‘ইতিহাস’ বলতে অস্বীকার করেন বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৮০ সালের এক প্রবন্ধে। ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ নামের সেই প্রবন্ধে বঙ্কিম চেয়েছিলেন ‘প্রমাণ’: গৌরবের প্রমাণ, অগৌরবেরও। বাংলার অতীত থাকলেও ‘ইতিহাস’ নেই, অর্থাৎ পাশ্চাত্য অর্থে ‘ইতিহাস’ নামক ভাষার ও হেতু-পরম্পরার এক বিশেষ রীতি মেনে গড়া বৃত্তান্তটি বাঙালির নেই। বাঙালির ইতিহাস লিখতে হবে। ‘যে বাঙালি, তাহাকেই লিখিতে হইবে।’

একই কথা বলেন অক্ষয়কুমার মৈত্র, যিনি বাংলা ভাষায় ইতিহাস সম্পর্কিত প্রথম সাময়িকপত্র ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ প্রকাশ করেন ১৮৯৮ সালে। পত্রিকাটি চলে ১৯১১-’১২ সাল অবধি। বঙ্কিমের প্রবন্ধ প্রকাশের কিছু পরেই স্বদেশি আবেগের আবহে ঐতিহাসিক গবেষণার ‘বৈজ্ঞনিক’ রীতি স্থির করে জাতিসত্তা নির্মাণের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। বাঙালির ইতিহাস নেই। ‘বাঙ্গালী নিজে চেষ্টা না করিলে সে ইতিহাস লিখিত হইতে পারে না।’ ১৯০৭ সালে লেখাতে সেখানে অক্ষয়কুমার আরও বলছেন যে, ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার সঙ্গে বাংলার সংস্রব থাকলেও ‘বাঙ্গালাদেশের বিশেষত্বের অভাব নাই’। আধুনিক রীতিতে ইতিহাস লেখার আয়োজনে বঙ্গদেশ যে আর সব প্রদেশ থেকে খানিক পিছিয়ে আছে, এ কথাও তিনি বলেছেন অন্যত্র অদ্ভুত চক্র। ইতিহাস রচনা করবে ‘বাঙালি’ নামক জাতি, আবার সেই ইতিহাসজাত বাঙালি লিখবে ‘ইতিহাস’ নামক বয়ান। এই চক্রে ঘুরে হয়রান হয়েছিল উনিশ শতকের বাঙালির নিজ জাতিপরিচয় নির্মাণের চেষ্টা। হিন্দু কলেজের কালাপাহাড়ির কাল পেরোবার পর এই বৃত্তাকার কক্ষপথটি স্পষ্ট হয়। আমরা পরাধীন, বিশ্বজনীন আধুনিকতার দরবারে আমরা কোণঠাসা। তবে এ বার ঘরে ফিরি, গড়ে তুলি বাঙালির ‘জাতীয়’ বা ‘ন্যাশনাল’ ইতিহাস ও সংস্কারের উদ্যোগ— এই জিনিস একেবারে স্বদেশি পর্ব পর্যন্ত ছিল, সন্দেহ নেই। তার চাইতেও জরুরি কথা, পশ্চিমের ধারায় শিক্ষিত বাঙালির পরের প্রজন্ম বিজেতাদের বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সঙ্গে এক অন্তর্ঘাতী সমঝোতায় আসতে চেয়েছিল। নিউটনের মেধা, শেক্সপিয়র ও বায়রনের কাব্যরস এবং ছাপাকলের উত্তেজনা বঙ্গদেশের আঙিনায় আছড়ে পড়েছিল প্রায় একই মুহূর্তে। কথাটা অনেকেই খেয়াল রাখেন না। ‘আধুনিক’ বাঙালি হওয়া মানে কেবল জাতীয় খোলে গুটিয়ে যাওয়া নয়, বরঞ্চ তা পাশ্চাত্য ইতিহাসের সদৃশ বয়ানের চাইতে এগিয়ে— এটা প্রমাণের তাগিদ অনুভব করেছিলেন বঙ্কিম থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত অনেক চিন্তক, তাঁদের দেশীয় কুসংস্কারের সমালোচনা যতই তীব্র হোক না কেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের কথাই ধরা যাক। তিনি মনে করতেন বঙ্গদেশে এক বৌদ্ধিক আলোড়ন হয়েছিল বটে। তবে সেটি হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে নয়, চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়ে। ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ প্রবন্ধে তিনি বলছেন যে, তুলনায় তাঁর কালের বাঙালি ছিল প্রান্তিক, নিজেদের ইতিহাস জানতে পর্যন্ত শাসকদের মুখাপেক্ষী, সৃষ্টি-জ্ঞানে-কর্মে আত্মবিস্মৃত এক জাতি। লেখাটিতে তিনি যে ঐতিহাসিক মডেলটির প্রসঙ্গ পাড়ছেন সেটি কিন্ত ইউরোপীয় রেনেসেন্সের। কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর গ্রিক পণ্ডিতরা এলেন ইতালি ও পশ্চিম ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে, আরম্ভ হল নতুন করে গ্রিক-লাতিন ভাষার তালিম, ধ্রুপদি ভাষায় লেখা পাণ্ডুলিপির উদ্ধার-সম্পাদনা-মুদ্রণ-তর্জমা, ধ্রুপদি ও খ্রীস্টান সংস্কৃতির সমবায়ে শিক্ষা ও সভ্যতার সৃষ্টি-নির্মাণ-সংস্কার— এই গণপাঠ্য ভাষ্যের আদলে তিনি পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর ‘Renaissance’ ব্যাখ্যা করলেন, প্রয়োগ করলেন ইংরেজিতে শব্দটিও লাতিন হরফে। ইউরোপে পেত্রার্কা, গালিলেও, লুথার, বেকনরা যা করেছেন তার তুলনা তাঁর কালের বঙ্গদেশ নয়। ‘আমাদিগেরও একবার সেইদিন হইয়াছিল। অকস্মাৎ নবদ্বীপে চৈতন্যোচন্দ্রোদয়; তার পর রূপসনাতন প্রভৃতি অসংখ্য কবি ধর্মতত্ত্ববিৎ পণ্ডিত।’ রূপ-সনাতন আদতে কর্নাটকের লোক কি না, তাঁদের পূর্বসূরিদের ভাষা তেলুগু ছিল কি না, এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ অবান্তর। তখন তাঁরা চৈতন্য-পরিকর, যদিও মহাপ্রভুর শিষ্যেরা সকলে বঙ্গভাষী ছিলেন না। বঙ্কিম এর পর রঘুনাথ শিরোমণি, গদাধর, জগদীশ, রঘুনন্দনের মতো দার্শনিক ও স্মৃতিকারদের, এবং চণ্ডীদাস এবং চৈতন্য-পরগামী কবিদের নাম করেছেন। বিদ্যাপতিও আছেন ফর্দে, তাঁর বাঙালিয়ানা নিয়ে বোধহয় তখন সংশয় কম ছিল।

কিন্তু ইতিহাসের কথাই যখন হচ্ছে, তখন খটকা লাগে ভেবে যে, কেন উনিশ শতকে পৌঁছে জাতিপরিচয় নিয়ে এতটা উদ্বেগ ও আগ্রহ বোধ করল বাঙালি? এমনকি, যার মাতৃভাষা বাংলা সেই বাঙালি, এমন সংজ্ঞার্থের প্রস্তাব কেন করতে হল অক্ষয়কুমার মৈত্রকে ১৯০৭ সালে ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ প্রবন্ধে? সেই শশাঙ্ক থেকে লক্ষ্মণসেনের রাজত্ব অবধি বাংলার প্রতাপের কথা তো পড়ি ইতিহাসে, পাল রাজাদের সময়ে বাংলার নৃপতিরা সাম্রাজ্য পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলার সুতি, রেশম আর আফিম তো মোগল আমলের শেষ দিকেও ছিল আর্থিক বৈভব ও রাজনৈতিক বিবাদের হেতু। বলতে পারেন, স্বদেশি আন্দোলনের তাগিদ ছিল এমন শিকড় এবং সংহতির সন্ধানের নেপথ্যে। কিন্তু তাতে তো সব কথা বলা হল না। বঙ্কিমচন্দ্র এ ব্যাপারে চিন্তা করছিলেন ঢের আগে থেকে। ও দিকে হিন্দু মেলা প্রথম বসিয়েছিলেন ডিরোজিওর এককালের শিষ্য রাজনারায়ণ বসু ১৮৬৭ সালে, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নবগোপাল মিত্রের সঙ্গে মিলে।

বোধহয় বঙ্কিমচন্দ্রই ঠিক ধরেছিলেন। বাঙালির জাতিপরিচয়ের সঙ্কট ছিল পরতন্ত্রের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন। মহাপ্রভুর সময়ে বাঙালি পরাধীন সে অর্থে ছিল না, যে অর্থে সে ছিল কোম্পানি ও ব্রিটিশ শাসনে। রাজার যদি হয় পরদেশে বাস, তবেই আসল ‘পরতন্ত্র’। তুর্কি-পাঠান-মোগলরা ছিল বাংলার শাসকদের— তাদের জাতিপরিচয় যাই হোক, অধিরাজ। বিদ্রোহ না করলে নবাব-সুলতানদের কালে বাংলা ছিল কার্যত স্বশাসিত। ‘লিবার্টি’ মানে স্বাধীনতা, ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স’-এর অর্থ স্বতন্ত্রতা। বাঙালি বাকি ভারতবর্ষের সঙ্গে এক পরতন্ত্র কারণ ‘ভারতবর্ষের রাজা ভারতবর্ষে নাই’। ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা’ প্রবন্ধে বলছেন বঙ্কিমচন্দ্র: ‘যে দেশের রাজা অন্য দেশের সিংহাসনরূঢ় এবং অন্যদেশবাসী, সেই দেশ পরতন্ত্র।’ যতই ‘লিবার্টি’র কথা বলুন ডিরোজিও ও রামমোহনের শিষ্যেরা, আসল সমস্যা রাজনৈতিক পরতন্ত্র। মনে রাখতে হবে, হিন্দু মেলার এক দশক আগেই মহাবিদ্রোহ, যে বিদ্রোহ ছিল নব্যবাঙালির সমর্থন বঞ্চিত। এবং মহাবিদ্রোহের পরের বছরই ঘটে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে অবিভক্ত ভারতের অন্তর্ভুক্তি।

চৈতন্যদেবের সময়কে বাংলায় শিক্ষা-সংস্কৃতির এক নবজন্মের (বা নবায়নের বা নবজাগরণের— renaissance শব্দের একাধিক অর্থ) কাল বলে শনাক্ত করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। সেই আলোড়নের প্রসঙ্গে তিনি ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রসঙ্গ তোলেন, স্মরণ করেন পেত্রার্কার কথা। নেপাল থেকে ‘ডাকার্ণব’ সহ বিভিন্ন দোহাকোষ এবং চর্যার পুঁথি এনে সম্পাদনা করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের অনুরাগী, বঙ্কিমের মতো তাঁরও বাড়ি ছিল নৈহাটিতে। বঙ্গদেশে দীনেশচন্দ্র সেন ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মতো তিনি ছিলেন ইউরোপীয় অর্থে ‘হিউম্যানিস্ট’— মানবিকীবিদ্যার মৌল রসদ হিসাবে যাঁরা পুথি-পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেন, এ গোত্রের বিদ্বান। তাঁর কি সায় থাকত বঙ্কিমচন্দ্রের সিদ্ধান্তে?

সম্পূর্ণত হয়তো নয়। হরপ্রসাদ চেয়েছিলেন ইংরেজ শাসনে বাংলার বিদ্যাচর্চায় যে অনুকূল বায়ু বইছে তার সদ্ব্যবহার করতে। ১৮৮৬ সালে সাবিত্রী লাইব্রেরিতে এক ভাষণে তিনি ইউরোপীয় রেনেসেন্সের তুলনা করেন তাঁর নিজের কালের বঙ্গদেশের সঙ্গে, চৈতন্যদেবের সময়ের সঙ্গে নয়। তখন ইউরোপে ‘গ্রীকদিগের সাহিত্য পুনঃপ্রচারিত হইয়াছিল মাত্র’। অন্য দিকে এখন বাংলায় ‘কি হইয়াছে একবার দেখ দেখি’। এই বলে তিনি পুরনো বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃত ও পালি সাহিত্য, ইংরেজি, মায় ফরাসি, জার্মান, ইতালীয় সাহিত্যকে বাঙালির বিস্তৃত পাঠ ও চর্চার ক্ষেত্র হিসাবে দেখাতে চাইলেন। ‘এত সম্পদ কাহার ভাগ্যে ঘটে?’ এর বিশ বছরের মধ্যে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের মন্দিরে এক সংগ্রহশালায় বাঙালির জাতিপরিচয়ের যাবতীয় স্মারক একত্র করার চেষ্টা হবে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতো কর্মঠ মানুষের নেতৃত্বে। অথচ হরপ্রসাদ চাইছেন বাঙালির এক ব্যাপক বিশ্বজনীন পরিচয়। পরিষদের রজতবর্ষ পূর্তিতে সচিব রামেন্দ্রসুন্দর জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা এশিয়াটিক সোসাইটির আদলে গড়া এক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাঁদের কাজের পরিসর তুলনায় ছোট। তাঁদের ক্ষেত্র বঙ্গদেশ, এশিয়া মহাদেশ নয়। এর সঙ্গে হরপ্রসাদের উচ্চাভিলাষের তুলনা করুন। বঙ্কিমচন্দ্র এবং হরপ্রসাদের প্রস্তাব এক হিসাবে পরস্পরের সম্পূরক। দু’জনেই চাইছেন বাঙালির আত্মপরিচয়ের বিস্তার, এক আধুনিক বিশ্বজনিনতা। বঙ্কিমচন্দ্রে তার ঐতিহাসিক প্রতিরূপ এক স্বাধীন অতীতে, হরপ্রসাদের বিচারে তার আসন্ন সুযোগ পরাধীন বঙ্গদেশে। বাঙালির জাতিপরিচয়ের সঙ্কট রয়েছে। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Bankim Chandra Chattopadhyay)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours