দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

অনেকেই, না বুঝে বলেন ক্ষুদিরাম হবো না। শহীদ হবো না। সেটা যতোটা না ঠিক, ততোটা বেঠিক বাঙালির শহীদ সাজা বা কাউকে শহীদ সাজানোর আবেগ ঘন ইচ্ছে! এটা আমার কথা না। নিন্দুকের কথা। নিন্দুকদের কোন কাজ থাকে না। যখন সব কিছু ঠিক ঠাক চলছে, তখন খুঁত ধরা কাজ। নাই কাজ তো খই বাছ!

তার চেয়ে বরং গল্প শুনি। কেউ কেউ বিদ্যাসাগর – ‘কার’ সাহেবের গল্প শুনিয়েছেন। মোক্ষম জবাব ছিল। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাঙালির জন্য এর থেকে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু একটা কথা ভুললে হবে না, বিদ্যাসাগর কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কার সাহেবকে ট্যাঁক দেখিয়ে, তাঁর কাজ না সেরে চলে আসেননি। সামনে টেবিলে তোলা পা সমেত কার সাহেবের চটি জোড়া তোলা। বিদ্যাসাগর কিন্তু কাজ সেরেই ফিরেছিলেন। সময়ের অপেক্ষা করেছিলেন। তাই মনে হয়, বাঙালি তার অস্মিতাই বুঝতে পারেনি। না বুঝেই মাঝে মাঝে তার উদাহরণ টানে ক্ষুদ্র স্বার্থে। তাই থাক! আজ আপনাদের সেই গল্প শোনাবো। 

উর্দু গল্পের দিকপাল লেখক সাদাত হাসান মান্টোর “শহীদ সাজ ও শহীদ শহীদ খেলা”। গল্পে এক মারোয়ারী ব্যবসায়ীর কথা আছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ব্যবসায়ী লাভের কথা ভেবে, পাকিস্তান চলে যায়। পাকিস্তানে গিয়ে রিফিউজি ক্যাম্প করেন। ব্যবসায়ী হিসেবে সারাজীবন সফল হলেও, এবার লস খেলেন। এবার ভাবলেন হজ্বে যাবেন। কারণ ওখানে সবাই পায়ের তলায় চাপা মারা যান, শহীদের মর্যাদা পান। বেহেস্তে যেতে পারা যায়। তার মানেই অনন্ত সুখে গমন। এবার তিনি ভাবলেন, সব থেকে ভালো শহীদ বানানোর ব্যবসা। সেই পরিকল্পনা মাফিক এক বৃদ্ধাকে ট্রেন লাইনে শুইয়ে দিলেন। কিন্তু ট্রেনের হুইসেল শুনেই, বুড়ি দৌড় দিল। নতুন ব্যবসার ফন্দি আঁটলেন। তবে এবার দৌড়ের অপশন রাখতে চাইলেন না। ব্যবসাটা অবশ্য শহীদ সাজা বা শহীদ সাজানোর থাকলো। শুধু থাকলো না কোন দৌড়ানোর অপশন। তৈরী করতে লাগলেন হাসপাতাল (ধরে নিন, বাঁধ, সেতু সহ) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আর তা ধ্বসে যেতেই মানুষ শহীদের মর্যাদা পেল। বেহেস্তে গেল। রাষ্ট্র প্রেসমিট করে ক্ষতিপূরণ দিল। মানবতার এমন মহান দৃষ্টান্ত ইতিহাসে স্মরণীয় থাকার প্রতিশ্রুতি পেল।

জানি, গল্পটা শুনেও, আপনাদের মনে গুন গুন করছে- সরফরোশি কি তমন্না আব হামারে দিল মে হ্যায়। দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু এ কাতিল মে হ্যায়। অবসর গ্রহণের পরের দিন যশস্বী আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা হলেন। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী দায়িত্বভার নিলেন মুখ্য সচিবের। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বেতন অঙ্ক ঘোষণা করে বুঝিয়ে দিলেন বাঙালী আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে তিনি একইভাবে আছেন। নিজের পদ- অঙ্কের কোন হের ফের হচ্ছে না। এখন প্রশ্ন যে আলাপনবাবুর জন্য তিন মাস এক্সটেনশনের মঞ্জুরী কেন্দ্র দিয়েছিল, তা পরিবর্তন করে ২৮ তারিখে কেন তাঁকে (কেন্দ্রের কর্মীবর্গ ও প্রশিক্ষণ মন্ত্রক) ডিপার্টমেন্ট অফ পার্সোনাল এন্ড ট্রেনিংয়ে ডেকে পাঠালো? ঘটনার সূত্র খুঁজতে গেলে পাব, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত বৈঠক সূচীর কথা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী থাকতে চাইলেন না, কারণ সেখানে রাজ্যের বিরোধী নেতা উপস্থিত ছিলেন। বিরোধী নেতা তো বিধান সভাতেও উপস্থিত থাকবেন। যাইহোক, মুখ্যমন্ত্রী না থাকলেও, সেই রিভিউ বৈঠকে মুখ্যসচিব তো থাকতে পারতেন। তিনি ইয়াস নিয়ে তাঁর যুক্তিপূর্ণ দাবি রাখতে পারতেন। ভাবলেন হয়তো—কিম করিষ্যামি! তবে ওস্তাদের মার দিলেন শেষ রাতে। নো এক্সটেনশন, গ্রেসফুল সুপারএ‍্যানুয়েশন! 

বৈঠক হলে, কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো? বঙ্গবাসী দেখতে পেত জটুয়া সাহেব যেমন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে ব্যাগরা চিঠি লিখেছিলেন, সেরকম চিঠি রাজ্যের বিরোধী নেতা মোদীকে লিখছেন কিনা? মোদ্দা কথা তিনি কোন বাধা দিচ্ছেন কিনা?  কিন্তু বাংলা দেখতে ব্যস্ত যেন তেন প্রকারেন মোদী বিরোধিতা। যা এখন জাতীয় রাজনীতিতে নির্ভরযোগ্য উপাদেয় উপাদান। তবে গোকুলে বাড়িছে লবি, সে গুড়ে বালি। আসল কাজে জ্যোতিবাবুর সময় সেটা দেখেছি! সে এক অন্য প্রসঙ্গ। এখন থাক!

এখন দেখি বাঙালীর অস্মিতা! অবশ‍্যই দাপুটে বাঙালি দময়ন্তী সেনকে পাশ কাটিয়ে। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। এখন যেটি পরিষ্কার, আমরা নবীন পট্টনায়েককে দেখে শিখবো না। নীতির পার্থক্য থাকলেও, রাজ্যের স্বার্থে একত্রে বসা যায় না? কিন্তু পারফর্ম তো মানুষের ডিমাণ্ড মোতাবেক হয়েই থাকে। আমরা চাই, যুদ্ধক্ষেত্রে গোলা ছোঁড়া হোক। সৈনিক শহীদ হোক। খেলা হোক। এই খেলা ২০০১ সালেও হয়েছে তামিলনাড়ুর জয়ললিতা এবং বাজপেয়ী এবং আদবানীর সাথে। আবার সেই খেলা বঙ্গে। তবে দুটো ঘটনার মধ্যে পার্থক্য আছে। জয়লিতা শপথ নিয়েই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী করুনানিধির বাড়ি পুলিশ দিয়ে রেড করিয়েছিলেন এবং তাঁকে অ্যারেস্ট করিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে সেই আইপিএসদের উপর কেন্দ্রের কোপ পড়েছিল। অবসরের পর কেন্দ্রের কোপে পড়া ডেপুটি পুলিশ কমিশনার স্টেট প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য এবং পরে স্টেট ইনফরমেশন কমিশনার হন। আইপিএস ক্যাডার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এবং ডিপার্টমেন্ট অফ পার্সোনাল এণ্ড ট্রেনিংয়ের অধীন আইএএস  ক্যাডার। ১৯৬৯ সালের অল ইণ্ডিয়া সার্ভিসের ৭ নং রুল অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে রাজ্য ও কেন্দ্র দ্বিমতে কোন ব্যবস্থা নিতে পারবে না। তবে যেটা কেন্দ্র পারে, সেটা মুখ্যসচিব নিয়োগ করে দেখিয়েছে। ১৯৫৪ সালের রুল ৬ (১) ভারতীয় পুলিশ সার্ভিস রুলে ডেপুটেশনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রকে যে অধিকার দেওয়াছিল তা নাড্ডাকে আক্রমণের সময় রাজ্য সরকার গুরুত্ব দেয়নি। তাই এডিজি রাজীব মিশ্র আরও দুই অফিসারের সেন্ট্রাল ডেপুটেশনের সময় রাজ্য কেন্দ্র দ্বৈরথের নির্যাস বেরিয়েছে ‘তাঁরা’ গুড অফিসার। রাজ্যে আশ্রয় পেলে সেন্ট্রাল ডেপুটেশনে নিষেধাজ্ঞাকে থোড়াই কেয়ার করেন যে কোন অফিসার। আগেও মুখ্য সচিব মলয় কুমার দে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পাঁচ অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল। কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তাঁরা তৃণমূলের ধর্ণায় হাজির ছিলেন। কিন্তু যেহেতু আইনত ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রাজ্যের হাতে। তাই রাজ্যের তরফে একটাই উত্তর ছিল, কোন অফিসার শাসক দলের ধর্ণায় হাজি ছিল না। তখন অবশ্য বাঙালি অস্মিতায় কোন দাগ কাটেনি! তাই  ঔদ্ধত্যের বাঙালি, করণীয়কে এড়িয়ে অকারণ ইস্যু করে নিজের শিরদাঁড়া ঋজু ভাবতে পারে! অজুহাত খাড়া করতে বিদ্যাসাগর ও তরু সিংকে স্মরণ করতে পারে! আরেক বাঙালি হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে বাঙালি বেমালুম ভুলে গেলেন! তিনি তো বলেছিলেন,’ তৈলের একটি আশ্চর্য সম্মিলনী শক্তি আছে। আর নিষ্কৃত্রিম তৈল অতি দুর্লভ’।          

(www.theoffnews.com - Alapan Bandyopadhyay)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours