শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

আশির দশকে আফগানিস্তানে রুশদের উপস্থিতি মার্কিনীদের জন্য "শিরদর্দ" হয়ে গিয়েছিলো। প্রথমত তখন রুশ মার্কিনীদের ঠান্ডা (?) লড়াইয়ের যুগ। দুই পরাশক্তি তাদের পছন্দের শাসকদের ক্ষমতায় আনছেন, আবার ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। সমাজতন্ত্র ও গনতন্ত্রের নামে! তারা কোনও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করছিলেন না। আদতে, এখনও করে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর সমাজতন্ত্র রপ্তানি আপাদত বন্ধ। অবশ্য মার্কিন সরকারের নেতৃত্বে গণতন্ত্র রপ্তানী কিছুটা চলমান! যদিও তারা মধ্যপ্রাচ্যে সুলতানগিরি, আমিরী, রাজা বাদশাতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে। মার্কিন শাসকেরা ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, কিউবা, বাংলাদেশ ভারত,পাকিস্তানে গনতন্ত্র দেখতে চায়। তাদের ভাবখানা এমন গণতন্ত্র পৃথিবীর মানুষের জন্য দরকার, তবে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নয়। মার্কিনীদের চরম ধর্মান্ধ, স্বৈরাচার, খুনি শাসক পছন্দনীয় হতে পারে। তাতে সমস্যা নেই। সমাজতান্ত্রিক শাসকের উপর তাদের  যত গোস্বা। সেই গোস্বাতেই আমেরিকা সৌদি আরবকে মাদ্রাসায় বিনিয়োগ করতে অনুরোধ করে। সৌদির বাদশাতন্ত্র এক বাক্যে রাজি হয়ে যায়। তারা পেট্রোডলার পাকিস্তানে ছিটাতে থাকে। ভাত ছিটালে নাকি কাকের অভাব হয় না। এমনিতেই মাদ্রাসাগুলো টাকার জন্য ঘর-বাড়ি হাটে মাঠে বাজার ঘাটে ঘুড়ে বেড়ায়। এবার খোদ টাকা চলে এলো মাদ্রাসার দুয়ারে! আর যায় কোথায়, মাদ্রাসার দরকার টাকা আর আমেরিকার চাই, তালেবে এ এলেম কাম জেহাদী! সৌদি আরব, আমেরিকা ও আমেরিকার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর টাকা, ট্রেনিং ও মগজ ধোলাইয়ে গড়ে তোলা হলো তালিবান। যারা কাবুল থেকে রুশদের বিতাড়ন করতে মার্কিনীদের তরুপের তাস হিসেবে ব্যবহৃত হলো। কম খরচ ও নিজেদের জীবনের অনেক কম ক্ষতির করে অন্যের কাধে বন্ধুক রেখে আমরিকা তার সাধ মেটালো। সৌদি আরবের এই বিনিয়োগের কথা আমরা জানতে পেরেছি খোদ সৌদ পরিবারের বেতাজ বাদশা বিন সালমানের মুখেই। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সে খবর দুনিয়ার সামনে এসে গেছে। বোঝা গেল, যারা তখন, "আফগানিস্তানে খোদাকে দেখেছি" নামে একটি বই ঢাকার বাজারে ছেড়েছিল। আসলে ওই বইটার নাম হওয়া উচিত ছিল, আফগানিস্তানে মার্কিন ও সৌদি আরবের ভাড়াটে পাকিস্তানিদের দেখেছি! 

যাই হোক অবশেষে রুশরা কাবুল থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়। এমনকি এক সময়, খোদ  সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নই ভেঙ্গে যায়। সাড়া বিশ্বে আমেরিকা অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে এই তালিবানদের সাথেই আমেরিকার দহরম মহরমেরও ইতি ঘটে। পরস্পরের সাথে সংঘাতে বাধে। আবারও সাপুঁড়ের সাথে সাপের লড়াই দেখতে পেল পৃথিবীর মানুষ।

কাবুলে রুশদের সমর্থিত সরকার হটানোর কারনে দীর্ঘ দিন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার নিরংকুশভাবে সকল স্বার্থ রক্ষা হলো বটে। তবে, দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই সারা পৃথিবীতে জঙ্গিবাদীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আস্তানাও গড়ে তুলতে লাগলো। একদিন সেই জঙ্গিবাদের ঢেউ টুইন টাওয়ারে গিয়েও আছড়ে পড়ল। তখন, টনক নড়লো মার্কিনীদের।  এবার মার্কিন বোমারু বিমান উড়ে এলো কাবুলে। সৈন্যও ঢুকে গেলো। অদ্ভুত! কাবুল এখন, রুশদের হাত থেকে মাকির্নীদের কব্জায়। ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক আফগানিস্তান ততদিনে মোল্লাতন্ত্রের কাবাডি খেলার ময়দানে রূপ নিয়ে নিয়েছে। কলেজ বন্ধ, স্কুল বন্ধ, নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ। থাকবে কেবল মাদ্রাসা! সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্বাস ব্যাতিত সব অশুদ্ধ, অন্যায় বলে নির্ধারন করা হলো। সকল আধুনিকতা তাদের কাছে পাপ কাজ। সমাজতন্ত্র ঠেকাতে গিয়ে গনতন্ত্রকেই কবর দেওয়া হয়েছিল। তবুও যেন সমাজতন্ত্র না আসে। আফগানিস্তানের পাশাপাশি পাকিস্তানও হয়ে উঠলো জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য।

দেড় যুগেরও পরে, আমেরিকা নাকি কাবুল থেকে চলে যাবে বলেছে। আসলেই চলে যাবে নাকি নতুন রূপে ফিরে আসবে তা সময়ই বলে দেবে। কিছু মার্কিন সৈন্য সিরিয়ে নিতেই আফগান বাহিনী ও সৈন্যদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে গেছে।  তালিবানেরা কাবুল দখল করে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে। তা একটা শিশুও জানে। তারপরও আমেরিকা কাবুল থেকে চলে যেত চাইছে কেন? খোদ আফগান সরকার অনুরোধ করছে, মার্কিনীদের সৈন্য কাবুলে রাখতে! তবুও এখন, আমেরিকা চলে যেতে চাইছে। অথচ, তারা এক সময় কোনও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই কাবুলে ঢুকে পরেছিল। তখন কেউ বলেনি, গণতন্ত্র রপ্তানি করতে তোমরা মার্কিনীরা আমাদের কাছে এসো।  

এমন তো নয়, যে, এক দিকে দক্ষিণ এশিয়া যাতে কোনও ভাবেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র না হতে উঠতে  পাারে। কেন না, দিনে দিনে সমাজতান্ত্রিক চায়না প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে আমেরিকার। এমন কি কোনও অবস্থাতেই যাতে, ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানে গণতন্ত্রও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না নিতে পারে। তার জন্য পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের আঁতুর ঘর করে রাখা হলো! 

বৃটিশরা কেন বিভক্ত করেছিল ভারতকে? হিন্দু মুসলিম হাজার বছর এক সাথে থাকতে পারলে ১৯৪৫ এর পর কেন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলো না! পরাধীন ভারতে দুটি সম্প্রদায় পাশাপাশি থাকলো, স্বাধীন ভারতে ভিন্ন হয়ে গেল কেন? এটা  আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার উপস্থিতির আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক। তা জানি। তবে কোথায় যেন একটা অশনি অসঙ্গতিও আছে মনে হয়! 

আমেরিকা কেন চলে যেতে চাইছে কাবুল থেকে? তেল নেই? সোনা নেই? তাই! তেল ও সোনা তো আগেও ছিল না। তাই না! তবুও কেন চলে যেতে চায়? যে কারনে কাবুলে ঢুকে ছিল, সে প্রয়োজন কি ফুঁরিয়ে গেছে? ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগ কি খতম?  রুশদের তাড়ানো, আবার যে তালিবান দিয়ে রুশ তাড়ালো, সেই তালিবানকে কাবুল থেকে হটানো। এখন মার্কিনীরা চলে গেলে রুশরা আবার কাবুলে ঢুকবে না তো? আর তালিবানেরা তো কাবুলের ঘাড়েই নিশ্বাস ফেলছে! তবুও কেন মার্কিনীরা কাবুল থেকে চলে যেতে চায়? 

কি কারণে কাবুলকে ফের তালিবানের হাতে ভেট দিতে চাইছে হোয়াইট হাউস, মহামহিম জো বাইডেন বিশ্বেশ্বর একটু দয়া করে খোলসা কি বলবেন, এতে আপনার কোন স্বার্থ সুরক্ষিত হবে? আফগানিস্তানে সম্প্রতি গাড়ি বোমায় নিহত কিছু শান্তিপ্রিয় স্কুলছাত্রীর মায়েরা এর উত্তরটা আপনার কাছে জানতে চাইছেন?

(www.theoffnews.com - Afghanistan America Taliban)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours