তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

যিশু কেমন দেখতে ছিলেন? ইতিহাসের চোখে তাঁর আসল চেহারাটি কেমন ছিল? সিসারো মোরায়েস দেখিয়েছেন যে প্রথম শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যে বাস করা ইহুদিদের শরীর, চুল ও চোখের রঙ ছিল কালো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্ম আর শিল্প দুটোই ইউরোপ কেন্দ্রিক হয়ে পড়ার কারণে যিশুর এই চেহারাটিই সবচেয়ে বেশী পরিচিতি পেয়েছে - একজন দাড়িওয়ালা শ্বেতাঙ্গ মানুষ, যার রয়েছে লম্বা বাদামী চুল এবং নীল চোখ। বিশ্বের প্রায় দুইশো কোটি খ্রীস্টানের কাছে এটিই যিশুর পরিচিত ছবি, কিন্তু বাস্তবের সাথে হয়তো এর খুব কমই মিল রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যিশু সম্ভবত ছিলেন কালো, খাটো এবং তিনি চুল ছোট করেই ছাঁটতেন - যেমনটা দেখা যেত ওই সময়ের অন্য সব ইহুদির মধ্যে। যিশু আসলে দেখতে কেমন ছিলেন, বাইবেল পড়ে তা জানার উপায় নেই। বাইবেলে যিশুর জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে, কিন্তু তাঁর চেহারা সম্পর্কে কোন বর্ণনা নেই। 

"গসপেলগুলোতে তাঁর শরীরের কোন বর্ণনা নেই, বলা হয়নি তিনি লম্বা ছিলেন না-কি খাটো, সুদর্শন না শক্তপোক্ত - শুধু বলা হয়েছে, তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ৩০ বছরের মতো," বলছেন নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসবিদ জোয়ান ই. টেলর। লন্ডনের কিংস কলেজের ধর্মতত্ত্ব ও ধর্ম গবেষণা বিভাগের এই অধ্যাপক একটি বই লিখেছেন - হোয়াট ডিড জেসাস লুক লাইক? অর্থাৎ যিশু দেখতে কেমন ছিলেন? "এই যে তথ্যের অভাব, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ," বলছেন আরেকজন ইতিহাসবিদ আন্দ্রে লিওনার্দো শেভিতারিস, যিনি ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরের ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। "যিশু দেখতে কেমন ছিলেন, তা তাঁর প্রথম দিককার অনুসারীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিবেচ্য ছিল বলে মনে হয় না। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যিশুর চিন্তা-ভাবনার বিষয়টি লিপিবদ্ধ করা"।

২০০১ সালে বিবিসি প্রযোজিত একটি তথ্যচিত্রের জন্য মুখমণ্ডল পুনর্গঠন বিষয়ক ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড নিভ বাস্তবের কাছাকাছি যিশুর একটি প্রতিমুর্তি তৈরি করতে তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কাজে লাগান। যিশু যেখানে বাস করতেন সেখান থেকে পাওয়া প্রথম শতকের তিনটি খুলি ব্যবহার করে তিনি এবং তাঁর দল একটি ত্রিমাত্রিক মডেল দাঁড় করান, আর তৈরি করেন এমন একটি মুখমণ্ডল, যা হয়তো হতে পারতো যিশুর মুখ। ওই সময়ের ইহুদিদের কঙ্কাল থেকে দেখা গেছে যে তাদের গড় উচ্চতা ছিল ১.৬০ মিটার, আর বেশীর ভাগ পুরুষের ওজন ছিল ৫০ কিলোগ্রামের একটু বেশী।

যিশু কি দেখতে ইউরোপীয়দের মতো ছিলেন?অধ্যাপক টেলর যিশুর বাহ্যিক চেহারা সম্পর্কে এ রকমই একটি ধারণায় পৌঁছেছেন। "বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক গঠনের দিকে থেকে ওই সময়ের ইহুদিরা আজকের ইরাকী ইহুদিদের অনুরূপ। তাই আমার মনে হয় যিশুর চুল ছিল ঘন বাদামী থেকে কালোর মধ্যে, চোখ বাদামী, বাদামী ত্বক - একেবারেই একজন মধ্যপ্রাচ্যের পুরুষ," টেলরের বক্তব্য। ব্রাজিলের গ্রাফিক ডিজাইনার এবং ফরেনসিক ফেসিয়াল রিকনস্ট্রাকশন বিশেষজ্ঞ সিসারো মোরায়েস বিবিসি ব্রাজিলের অনুরোধে যিশু খ্রিস্টের একটি বৈজ্ঞানিক ইমেজ তৈরি করেন। তাঁর মন্তব্যে তিনি বলেন, "যিশু নিশ্চিতভাবে শ্যামবর্ণের ছিলেন। কারণ ওই অঞ্চলের মানুষের গায়ের রঙটাই এমন। এরা মরুভূমির মানুষ, যাদের থাকতে হয় প্রখর সূর্যের নীচে।"

আরেকটি মজার বিষয় হলো যিশুর চুল। ঈশ্বরের বানী প্রচারের জন্য যিশুর নির্বাচিত ১২ জনের একজন পল লিখেছিলেন যে "লম্বা চুল রাখা পুরুষের জন্য গ্লানিকর", তাই যিশুর লম্বা চুল রাখার কথা নয়, যদিও ছবিতে এমনটা দেখানো হয়। "তখনকার রোমে পুরুষদের মধ্যে প্রচলন ছিল দাঁড়ি কামিয়ে রাখা এবং চুল ছোট করে কাটা। যদিও প্রাচীন আমলে দার্শনিকেরা সম্ভবত লম্বা দাঁড়ি রাখতেন," বলছেন ইতিহাসবিদ জোয়ান টেল।অধ্যাপক লিওনার্দো শেভিতারিস বলছেন, যিশুর তৃতীয় শতকের যে প্রতিরূপটি পাওয়া গেছে, তাতে তাকে একজন তরুণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যার ছিল ছোট চুল। বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করেন এভাবে: "তাকে অনেকটা তরুণ একজন দার্শনিকের মতো দেখা গেছে - একজন দাঁড়িওয়ালা দেবতা নয়, বরং একজন শিক্ষক"।

সাও পাওলো ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক উইলমা স্টিগাল দেখান যে খ্রিস্টানদের প্রথম দিকের আইকোনোগ্রাফিতে যিশুকে অনেক রকমভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে - "কখনো দার্শনিক বা শিক্ষকের মতো দাঁড়ি সহ, কখনো দাঁড়ি ছাড়া, টিউনিক পড়া, কখনও সূর্য দেবতার মুখাবয়ব, আবার কখনো বা সাধারণ একজন মেষপালক।"

যিশুর স্বর্গীয় রূপ সম্পর্কে অধ্যাপক টেলর বলেন, গত বেশ কিছু শতাব্দী ধরে যিশুর যে ছবিটি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটি একটি স্বর্গীয় রূপ - ঈশ্বরের পুত্র। এই ছবিতে যিশু মানবীয় নন। "এই বিষয়টি সবসময়েই আমাকে মুগ্ধ করেছে," বলছেন তিনি।লম্বা চুল-দাঁড়ির যিশুর ছবিটি উঠে আসে মূলত মধ্যযুগে, বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে।অধ্যাপক শেভিতারিস যেমনটা বলছেন, ওইসব ছবিতে যিশুকে দেখানো হয়েছে একজন অপরাজেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে - ইতিহাসের ওই সময়ের রাজা কিংবা সম্রাটদের মতো করে।

সাও পাওলোর ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ফ্রান্সিসকো রিবেইরো নেটো বলছেন, প্রাচ্যের গির্জাগুলোতে যিশুকে সব সময়েই বিশেষভাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, যেমন তাঁর শির উঁচু, তাঁর দুই চোখের মাঝখানের ভাজে প্রজ্ঞার চিহ্ন এবং নশ্বর পৃথিবী ছাড়িয়েও তাঁর দেখার ক্ষমতা। "অনেকের মাঝে যখন তাকে দেখানো হয়েছে, তখন তাকে দেখানো হয়েছে বড় করে, যার মানে হলো তিনি অন্য মানুষদের তুলনায় শ্রেয়। আর ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে দেখানো হয়েছে জীবন্ত এবং গরিমা সমৃদ্ধ, যা ধারণা দেয় যে তিনি পুনরায় ফিরে আসবেন।"

কিন্তু পশ্চিমের গির্জাগুলো এমন ধরা বাঁধা কোনও নিয়ম অনুসরণ করেনি। ফলে শিল্পীরা নিজেদের মতো করে যিশুর ছবি এঁকেছেন। "অনেক ছবিতে তাকে আঁকা হয়েছে মিষ্টি করে, আবার কোন কোন ছবিতে তিনি কষ্ট ভোগ করছেন কিংবা একজন শহীদ," বলছেন রিবেইরো নেটো। আসলে যিশু মুর্তির ও বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পাল্টেছে। প্রত্যেক যুগে শিল্পীরা নিজস্ব কল্পনা ও যিশু সম্পর্কে ধ্যান ধারণা দিয়ে এক একজন একরকম মুর্তির কল্পনা করেছেন।

খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের নবী যিশু, যাকে মুসলিমরা ঈসা (আ.) বলে অভিহিত করে থাকেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে দেখতে কেমন ছিলেন-এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক। তাঁর গায়ের রং ও দৈহিক গড়ন নিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে বিতর্ক চলছে। আমাদের সবার মনে যিশুর যে অবয়ব তা নাকি ঠিক নয়। আসলে যিশুকে কেমন দেখতে ছিল তা নিয়েই রয়েছে অনেক মত। এই প্রশ্নটা অনেক দিনের যে, ঠিক কেমন দেখতে ছিলেন যিশু খ্রিস্ট? সাধারণত যিশুর যে ছবি আমরা দেখি, তার সঙ্গে মিল নেই গবেষকদের বক্তব্যের সঙ্গে।

গবেষকরা বলছেন, যিশুর গায়ের রং মোটেও ফর্সা নয়। বরং, অনেকটাই কালো। ওপরের ছবির মতো খাটো, গায়ের রং কালোর দিকে। চুল কোঁকড়ানো। মোটামুটি এরকমই দেখতে ছিলেন যিশু খ্রিস্ট।যিশুর সময়কার একটি খুলির ওপরে ফরেন্সিক পরীক্ষার পরে মেডিক্যাল আর্টিস্ট রিটার্ড নিয়েভ এই ধরনের মুখের আদল পেয়েছেন। শুধুমাত্র সমসাময়িক মানুষের চেহারা সম্পর্কে ধারণার ভিত্তিতে এর আগেও যিশুর প্রকৃত মুখ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রশ্নাতীত নয়।

গবেষক নিয়েভ জানিয়েছেন, স্থান এবং কালের ভিত্তিতে যিশুর সমসাময়িক একটি খুলির ওপরে ফরেন্সিক পরীক্ষাটি করা হয়েছে। বাইবেল থেকে টুকরো টুকরো তথ্য নেওয়ার পাশাপাশি নিয়েভ ব্যবহার করেছেন ফরেন্সিক অ্যানথ্রোপলজি-কে। এই পদ্ধতিতে পুরাতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক তথ্য কাজে লাগানো হয়। সবরকম পরীক্ষা করে গবেষকদের দাবি, যিশুর আনুমানিক উচ্চতা ছিল ৫ ফিট ১ ইঞ্চি, ওজন প্রায় ৫০ কেজি। গঠনও ছিল মজবুত।

ঈশ্বর পুত্র যিশু। এটা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, গৌর বর্ণের, টিকালো নাক, ঘাড় ছাপিয়ে যাওয়া এক ঢাল মাথার চুল। যেন গ্রীক সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। কিন্তু ঐতিহাসিকরা বলছেন, যিশুর ঘাড় পর্যন্ত চুল হতেই পারে না। কেন না রোম সাম্রাজ্যের আইন ছিল ৩০দিন অন্তর চুল কাটাতে হবে। পুরুষদের মাথায় চুল রাখা ছিল আইন বিরুদ্ধ। চরম দণ্ডনীয়। জুলিয়াস সিজার, অগাস্টাস, রাজা হেরোদ, রোম সম্রাট বেরিয়াসের মাথার চুল ছিলো ছোট। ইহুদীরাও এই নিয়ম মানতে বাধ্য ছিল। যে রাতে যিশু গ্রেপ্তার হন, সেদিন তিনি কিদ্রণ খাল পেরিয়ে একটি বাগান বাড়িতে ছিলেন। সৈন্যরা এলে যিশু বলেন, তোমরা কি নাসরীয় যিশুকে খুঁজছো? আমিই সেই। সৈন্যরা প্রথমে বিশ্বাস করেনি। তাদের ধারণা ছিল যিশু হবেন, দিব্য সুন্দর ব্যক্তিত্ববান মানুষ। তখনতো দূরের কথা, আজ পর্যন্ত যিশুর জীবন্ত কোনও ছবি পাওয়া যায়নি। যিশুর প্রথম চার শিষ্য যাঁরা যিশুর বাণী লিপিবদ্ধ করেছেন কেউ যিশুকে চোখে দেখেনি। সময়টা ১০০ খ্রীস্টাব্দ। যিশুর অন্যতম শিষ্য সাধু টমাস বলেছেন, আমাদের প্রভু দেখতে সুন্দর ছিলেন না। যিশুর মৃত্যুর ২০০ বছর পর শিল্পীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে যিশুর ছবি আঁকতে শুরু করেন। বাইজান্টাইন এর শিল্পীরা মহাবিশ্বের রাজা বানাতে দেবরাজ জিউসের তরুণ বয়সের ছবি বানিয়ে তাকে যিশু নামে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু বাইবেল পড়ে জানা যায় না যিশু কেমন দেখতে ছিলেন? ওই অঞ্চলের মানুষের যা স্বাভাবিক রঙ। চীনের যিশু উপাসকরা তাদের মত পোশাক পরান। ইউরোপে যিশু ফর্সা। ইথিওপিয়ার মানুষ যে যিশুকে উপাসনা করেন, সেই যিশুর গায়ের রং কালো।

তাছাড়া আর একটা বড় কারণ হলো, খ্রীস্টান ধর্ম সারা পৃথিবীতে সফল ভাবে প্রমাণিত করা সেই কারণেই যীশুর চেহারায় ঐশ্বরিক রূপ প্রদান করা হয়েছিল। ইউরোপের চার্চ যে অবর্ণনীয় মানুষের ওপর হত্যা লীলা চালিয়েছিল যীশুর নামে তাকে ঢেকে রাখার জন্যই ওই রূপের মোহ জাল প্রচার করতে হয়েছিল। কল্পিত যীশুর মুখ ও চেহারা সচেতন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Jesus Christ Kashmir face)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours