সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
আমি রূপসী বাংলার সাংবাদিক হয়ে কুর্ণিশ জানাই সোনার বাংলার এক প্রতিবাদী চরিত্রকে। যিনি প্রকৃতই প্রতিবাদের এক অনন্য নাম "আয়েশা সিদ্দিকা"।
আসলে একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে আজ বাংলাদেশ রীতিমতো ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় প্রতিবাদে সোচ্চার। হোক প্রতিবাদ দিকে দিকে এই মন্ত্রে প্রকৃতই মুখর উদারচেতা বাংলাদেশীরা। তারা যে অনেকটা সুসংবদ্ধ। এবং এককাট্টাও। তাই হয়তো এই ইস্যুতে খানিকটা ব্যাকফুটে স্থানীয় মৌলবাদী জেহাদিরা। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের গতিশীলতার পক্ষে এই মাইলফলক অবশ্যই এক শুভ সূচক।
আলোচনার গোড়ায় পৌঁছাতে গেলে গত মাতৃদিবসে মনোনিবেশ করতেই হয়। সেদিন বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। ফেসবুকের। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি রয়েছেন তাঁর মায়ের সঙ্গে। আর উনার মায়ের সিঁথিতে রয়েছে সিঁদুর।
ব্যাস এই ছবিতে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়় যথারীতি একদল উগ্র মৌলবাদীদের অভ্যন্তরে। ওই পোস্ট ঘিরে শুরু হয় জেহাদি ভাষা। গালাগালি থেকে অভিনেতার ধর্ম নিয়ে কম টানাটানি হয়নি মৌলবাদীদের মন্তব্যে। এমনকি সিঁদুর কেন অভিনেতার মা পড়েছেন তা নিয়েও চলেছে চুড়ান্ত নোংরামি।
বিষয়টা আরও স্পষ্ট করে জানতে চেয়ে আজ ফোনে কথা বলেছিলাম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস'এর বাংলাদেশীয় সাংবাদিক জুলফিকার আলি মানিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, "দাদা এটা কিন্তু পুরোটাই ফেসবুক পোস্ট কেন্দ্রিক ভার্চুয়াল বিতর্ক। আমি চঞ্চলবাবুকে চিনি। বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা। উনার মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া ফটো দেখে কেউ কেউ ধর্মীয় পর্যায়ে খারাপ মন্তব্য করেছেন। এমনকি গালমন্দও করেছেন শুনেছি। এটা সত্যি নিন্দনীয়। এসব মোটেও কাম্য নয়।"
কানাডা থেকে প্রকাশিত একটি ওয়েবনিউজের এডিটর তথা বাংলাদেশের লেখিকা, সাংবাদিক ও নাট্য পরিচালক ইরাণী বিশ্বাসও প্রায় একই কথা বলেন। ফোন সংলাপে তিনি জানান, "একজন বিখ্যাত অভিনেতা যদি এরকম মৌলবাদের স্বীকার হন তাহলে সাধারণ মানুষের পরিণতি খুব সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশে। এসব অমানবিকতা মানা যায় না। আমরা আমাদের পরিধির মধ্যে এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছি। সিঁদুর কে পড়বেন আর কে পড়বেন না, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই নিয়ে ধর্মীয় জিগিরবাজী করা অসভ্যতার নামান্তর।"
হ্যাঁ, দ্য অফনিউজ'এর বাংলাদেশ এডিসনের কাজকর্ম সচল রাখতে গিয়ে যেটুকু নিয়মিত খবর পাচ্ছি, তাতে কিন্তু চঞ্চলবাবুর ছবির সমর্থনে ও মৌলবাদীদের কুরুচিকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের একটা বৃহত্তর অংশের সাধারণ সুশীল সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। এখানে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু নির্বিশেষে সমস্ত উদারচেতা মানুষ তীব্র ভাবে গলা মিলিয়েছেন।
তবু গতকাল এহেন একটা প্রতিবাদী ফেসবুক পোস্ট আমার অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছে অবধারিত ভাবে। প্রতিবাদের ভাষা এত সুতীব্র হতে পারে ধর্মে গন্ডি ছাড়িয়ে তা আমার কল্পনার অতীত। আমার বাংলাদেশী বন্ধু আয়েশা সিদ্দিকা। তিনি বাস্তবিকই প্রতিবাদী। তিনি তিস্তা জলবন্টন প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ করেন প্রকাশ্যে। আবার ধর্মনির্ভর রাজনৈতিকতার কারণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও চরম সমালোচক। অন্যদিকে এই নরেন্দ মোদীর বাংলাদেশ সফরকালে সেখানকার মৌলবাদীদের বাধাদানের চেষ্টাকে তুমুল তুলোধুনা করেন এই প্রতিবাদী নারীই। আবার তিনি তাঁর দেশের সরকারের সাম্প্রতিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কি মুখরই না হয়েছেন। অথচ এই তিনিই ইন্দিরা গান্ধীর ভারত থেকে বর্তমান ভারতের নানা ক্ষেত্রের অকুণ্ঠ সমর্থক। তাঁর লেখনিতে বারবার ভেসে ওকে বঙ্গবন্ধুর জয়গান থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অকৃত্রিম সমর্থন। আমি যতটুকু চিনেছি, বাস্তবিকই আয়েশা সিদ্দিকা হল একজন অন্ধ ধর্ম ও কানাগলির রাজনীতির উর্ধ্বে একজন সাচ্চা মানবিক নারী।
গতকালের তাঁর ফেসবুক ওয়ালে নিজের একটা প্রতিবাদী ছবি পোস্ট করেছিলেন। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনি নিজের সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ছবির ওপরের ক্যাপসনে তিনি লিখেছেন, "মা দিবসে সিঁদুর পরা মায়ের সাথে ছবি দেওয়ার পর চঞ্চল চৌধুরীকে ও তার মাকে যেভাবে অপমান করল আমাদের দেশের মানুষের মত দেখতে ছাগুগুলি তার প্রতিবাদে এ ছবি। যা এবার কাঁঠালপাতা খা।"
মুসলিম সম্প্রদায়ের নারী হয়ে তিনি সিঁদুর নিজের সিঁথিতে লাগিয়ে ঠিক না বেঠিক করেছেন এসব বিতর্ক আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় অর্থহীন। মঙ্গলগ্রহ বিজয়কারী যুগের একজন মানুষ হয়ে এটা অবশ্যই বলবো, "তাঁর ব্যক্তি ভাবনার পছন্দকে ধর্মের উপরে উঠে আমি অকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন করি। উনার ব্যক্তি স্বাধীনতা এই পৃথিবীরই অধিকার।" কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আয়েশা সিদ্দিকার এহেন প্রকাশ্য প্রতিবাদ করতে যে কতখানি বুকের পাটা দরকার হয়েছে তা কিন্তু বিলক্ষণ অনুমেয়। উল্টে 'যা এবার কাঁঠালপাতা খা' বলতে 'ছাগু' বিশেষণকারী মৌলবাদীদেরকেই চ্যালেঞ্জ তিনি করে বসলেন। তাঁর পোস্ট করা ছবির শরীরি ভাষায় আসলে বলতে তিনি বলতে চেয়েছেন, "আমি আমার কাজ করে দেখালাম এই প্রতিবাদের মাধ্যমে। এবার তোরা যা পারিস করে নে যা ছাগলের দল।" ভাবা যায় বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে একজন মুসলিম মহিলির এমনতর চরমতম প্রতিবাদ! আমি তাই ওই পোস্টে তাঁকে উদ্দেশ্য করেই গতকালই একটি মন্তব্য করেছিলাম। লিখেছিলাম, "আপনার উদারতার যেন একটা গোটা আকাশ। সমস্ত ধর্মের মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপনার এই প্রতিকী লড়াই হল একটা থাপ্পর। আপনার পায়ে আমার কুর্ণিশ রইল। বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে এহেন প্রতিবাদ যে ভয়ঙ্কর কঠিন তা আমি ভারতে থেকেও অনুমান করতে পারি। মানুষ যে ধর্মের উর্ধ্বে উঠে মানবতাকে আগে স্থান দিতে পারে সগর্বে, আপনি যে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। সেলাম তুঝে সেলাম।"
তবে উনার পোস্টে ছোট্ট একটি বাক্যের মধ্যে দিয়ে সেরা মন্তব্যটি হয়তো করেছেন আমারই এক সোনার বাংলার বাসিন্দা বন্ধু মলিনা রায়়। তাঁর মন্তব্য, "এভাবেও প্রতিবাদ করা যায়।" শতকরা একশো ভাগ সঠিক বলেছেন মলিনা। প্রতিবাদ যে এমনই হওয়া উচিৎ। যেখানে ধর্মের গন্ডি থাকবে না। যেখানে প্রতিবাদী নিজেই হয়ে ওঠেন মৃত্যুঞ্জয়। যেখানে প্রতিবাদ মানে নিছক ফোকাস টানা কপিবুক বুলি নয়, সেখানে প্রতিবাদ মানে মৌলবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের ব্যতিক্রমী অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করা। সত্যি তো, এভাবেও প্রতিবাদ করা যায়।
ফের বারবার বলে নিজেকে ধন্য করি, "আয়েশা সিদ্দিকা-সেলাম তুঝে সেলাম।"
(www.theoffnews.com - Bangladesh Chanchal Chowdhury film actor and mother sindur)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours