দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘তৈল’-প্রবন্ধের শেষ বাক্যে লেখেন: ‘মনে রাখা উচিত—এক তৈলে চাকা ঘোরে, আর-তৈলে মন ফেরে।’ উপাচার্য সম্ভবত কর্তাদের মন ফেরাতে চেয়েছেন। নইলে এরকম হয়? যে,'পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হারের কারন' খুঁজতে অনলাইনে আলোচনা সভা করতে বসবেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।  আগামী ১৮ মে এই আলোচনা সভা হবে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। তবে রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি বিজড়িত এরকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিভাবে রাজনৈতিক আলোচনা হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রবীন আশ্রমিক থেকে শিক্ষা মহল। অধ্যাপকদের একাংশের মতে, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক ইস‍্যু আসতে পারে। তাবলে কোন রাজনৈতিক দল বিধানসভা নির্বাচনে কেন ব‍্যর্থ হলো এর কারণ অনুসন্ধান তো রাজনৈতিক দল করবে। বিশ্বভারতী কেন? যদিও স্বয়ং উপাচার্য নিজেই নরেন্দ্র মোদির উত্থান নিয়ে বই লেখেন। এই লেকচার সিরিজের বিষয় বাছা নিয়ে উপাচার্যের নিজ বৃত্তের মধ‍্যে  থাকা অধ‍্যাপকরা উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, উনাকে বললে, কিছু শোনেন না।  রাজনীতি বিষয় হলে, একদলের জেতা অন্যদলের পরাজয়, উভয়ই আলোচনার বিষয় হতে পারতো। 

বিশ্বভারতীর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যাচ্ছে আগামী ১৮ মে বিশ্বভারতীর উদ্যোগে ৩৫ তম লেকচার সিরিজের আয়োজন করা হয়েছে। ওই দিন বিকাল চারটে নাগাদ জুম অ্যাপ এর মাধ্যমে লেকচার সিরিজে বক্তৃতা করবেন ভারত সরকারের নীতি আয়োগের জয়েন্ট অ্যাডভাইজার সঞ্জয় কুমার। তিনি এর আগে দিল্লির সেন্টার ফর স্টাডি অফ ডেভলপিং সোসাইটি তথা সিএসডিএ এর প্রাক্তন অধিকর্তা ছিলেন। জানা গেছে ওই লেকচার সিরিজে পৌরহিত্য করবেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী স্বয়ং।

এর আগেও একাধিক বিষয়ে বিশ্বভারতী লেকচার সিরিজ করে বিতর্কে জড়িয়েছে । সিএএ নিয়ে বক্তৃতার জন্য সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তকে আমন্ত্রণ জানাতেই বিপত্তি বাঁধে। ছাত্র আন্দোলনের জেরে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা আটক থাকতে হয়। কিন্তু তাতেও শিক্ষা নেননি তিনি। কারন এবারও লেকচার সিরিজের বিষয় প্রকাশ্য আসতেই বিতর্ক চরম আকার নিয়েছে। কারন এবার বিশ্বভারতী জারি করা বিজ্ঞপ্তির বিষয় "পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে বিজেপির ব‍্যর্থ হলো কেন?" এই বিষয় প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়। কারন হিসেবে সর্বস্তরের অভিমত একটি রাজনৈতিক বিষয় কেন বিশ্বভারতীর মত রবীন্দ্র প্রতিষ্ঠানে আলোচনার বিষয় হবে। এই ইস্যুতে বিশ্বভারতীর ঘরে বাইরে শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা। বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সমিতি - 'কর্ম সমিতি' আচার্য তথা দেশের প্রধানমন্ত্রীর মনোনিত সদস্য দুলাল চন্দ্র ঘোষ তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি সংবাদ মাধ‍্যমকে বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয় এটা জানি। তবে অন্য একটি রাজনৈতিক দলের হারের কারন খোঁজার জন্য বিশ্বভারতীর মত প্রতিষ্ঠানের আলোচনার কি প্রয়োজন আছে? বিশ্বভারতী তো কোন পার্টি নয়।" তিনি এও প্রশ্ন তুলে দেন যে, একজন নীতি আয়োগ এর পরামর্শ দাতা এই বিষয়ে কি বা বলবেন? তা বলার বিষয়টি কি আদৌ কেন্দ্রীয় সরকার জানেন।" তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, "এমন রাজনৈতিক বিষয়ের উপর আলোচনা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি দিয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।" 

বিশ্বভারতীর অন্দরে এই নিয়ে তীব্র বিতর্কের মাঝেই শান্তিনিকেতনের প্রবীন আশ্রমিক সুপ্রিম ঠাকুর সংবাদ মাধ্যমকে বিশ্বভারতীতে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ নিয়ে সমালোচনা করে বলেন, "এটা খুবই অন্যায় কাজ। বিশ্বভারতীতে কোন দিনই রাজনীতি হতো না। গুরুদেব কোন দিনই বিশ্বভারতীর সঙ্গে রাজনীতিকে যুক্ত করেননি। কিন্তু এখন বিশ্বভারতীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি ঢুকেছে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানকে এভাবে নষ্ট করে দিলে খুবই কষ্ট হয়।" 

প্রসঙ্গত বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে কেন্দ্র করে সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা ভোট নজর কেড়েছিল। কারন শাসক দল, বিজেপি উভয়েইকে কত বেশি উপাচার্য ঘনিষ্ঠ তা মরিযা ভাবে প্রমান করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। বিজেপির প্রার্থী অনির্বাণ গাঙ্গুলী রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে উপাচার্যের বিরুদ্ধে তোপ দেগে দাবি করেছিল, বর্তমান উপাচার্য বিশ্বভারতীর যোগ্য নয়'। ওই সময়েই এদিকে উপাচার্যকে দিল্লি দুইবার তলব করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক। কারন তার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ জমা পরেছে। শুধু তাই নয় খোদ বিজেপির একাংশ এই নিয়ে সরব হয। সূত্রের খবর ইতিমধ্যেই দিল্লিতে এই ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। অধুনা নির্বাচনে তার প্রভাব পরে। বিগত নির্বাচনে বোলপুর শহরে দশ হাজারের মতো ভোটে শাসক দল পিছিয়ে পড়ে। এবার সেই মার্জিন চার হাজার মতো কমে। বিশ্বভারতীর অধ্যাপকদের একাংশের মতে আসলে উপাচার্য লেকচার সিরিজে এমন বিষয় বেছে নিয়ে দিল্লির শাসক দলের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, 'আমি তোমাদেরই লোক।' 

রবীন্দ্রনাথের নামের প্রতিষ্ঠানে এহেন বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে সোচ্চার জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তিনি বলেন, "ও একটা পাগল সেটা আবার প্রমানিত। পাগল বলেই এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা সভা করছে। ওর বিজেপি করা ঘুচিয়ে দিতাম যদি করোনা প্রকোপ এত না বাড়ত।"

তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী জানা গিয়েছে, চরম বিতর্কের জেরে প্রস্তাবিত উক্ত লেকচার সিরিজ বাতিল করা হয়েছে অনিবার্য কারণে।

(www.theoffnews.com - Visva Bharati University)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours