দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

"মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও", এই কথাটাই বোধ হয় নাড়িয়ে দিয়েছিল জনাব আতাউর রহমানকে।

এক মানুষ আরেক মানুষের পাশে দাঁড়াবে। এক মানুষ অন‍্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। এই চিরায়ত। কিন্তু যখন মানুষে বিশ্বাস থাকে না, তখন টুপি, লুঙ্গি, পৈতে, ধুতি, পদবী দেখিয়ে বোঝাতে হয় আসলেই কে, কি! নির্বাচনের আগে ও পরে অকাল মৃত্যু ঘটেছে যুযুধান সম্প্রদায়ের মধ‍্যে কারণে অকারণে। সে বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু একটা সত‍্য বারবার উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে মহামারী অতিমারী বরাবর তাদের কাছে টেনেছে। আর যখন কোথাও মনুষ্যত্বের পরাজয় ঠেকাতে আরেক মনুষ্যত্ব এগিয়ে এসেছে তখনই তা বিরলতম ঘটনা মনে হয়েছে বাস্তবে ও খবরের শিরোনামে।

নির্বাচনের পরবর্তী পর্যায়ে যখন রাজনৈতিক হিংসার শিকার অনেক মানুষ। তখন ক্ষয়িষ্ণু মানবিকতায় এক অনন্য মেক ওভার দেখল বীরভূম। বিষয়:- এক করোনা আক্রান্ত হিন্দুর মৃতদেহ দাহ করার জন্য কাউকে পাশে পাচ্ছে না মৃতের ভাই হাও হাও করে কাঁদছে। তখনই আবির্ভূত এক যুবক। যার ধর্ম পরিচয় দিতে হয়, দুটো কারণে। এক, এই ঘটনা বিরল, শুশ্রুষাকারী। দুই, কোন রাজনৈতিক পরিবেশ এই মানবিক সম্পর্ক নষ্ট করতে পারেনি। পাশাপাশি, এই ঘটনা আখছার না হলেও মনের ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে বলে, কার বা কাদের কতটা প্রয়োজনীয়, তা অন্তিম ঠিক করে দেয়। 

তাই আজকের ঘটনার মসীহা বাংলা সংস্কৃত মঞ্চের সদস্য আতাউর রহমান। মঞ্চের সভাপতি সামিরুল ইসলামের ফোন পেয়ে এই মহতী কাজে লেগে পড়েন তিনি। 

"কেউ গোরে কেউ শ্মমানে ঠাঁই"। এই তো বেশির ভাগ মানুষের অন্তিম ইচ্ছা। কিন্তু পরিস্থিতি এখন মানুষের ক্ষমতার বাইরে যে, মৃতের স্ত্রী পুত্র পরিবার কাছে এই অন্তিমে কাছে থাকতে পারেন না। তাই তো প্লাসটিকে আপাদমস্তক ঢাকা মৃত সুধাময় কর্মকারের (৩৮, নাম পরিবর্তিত) দেহ সামনে মানুষ কত অসহায়। তাই তো কথা হয়-- মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।

সেই মুহূর্তে  মৃতের পরিবারের একমাত্র চিন্তা  আদৌ হবে কি স‍ৎকার তাঁর। মৃতের আসল বাড়ি বাঁকুড়া। বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই মহম্মদ বাজারে স্পেয়ার স্পার্টসের ব‍্যবসা করতেন। তাঁরা দুই ভাই এক সঙ্গে থাকতেন। মৃতের বাড়িতে স্ত্রী, এগারো বছরের পুত্র সন্তান ও ছয় বছরের কন‍্যা। কয়েকদিন আগে রামপুরহাট শহরের এক বেসরকারী নার্সিং হোমে করোনা সঙ্ক্রমণ নিয়ে ভর্তি হন। শুক্রবার সকালে মারা যান। সমস‍্যা শুরু হয় তারপর। হাসপাতালের ডোম তেইশ হাজার টাকার প‍্যাকেজে দেহ পোড়াতে রাজী হন। আর তাঁরা ছাড়া কেহ দেহ ছোঁবে না। ঠিক হয় নলহাটির এক শ্মশানে হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী দাহ করা হবে দেহ। কিন্ত সেখানে যেতেই স্থানীয় মানুষ শববাহী শকটে ঢিল ছুঁড়তে থাকে মানুষ। তাঁদের একটাই বক্তব্য, আমাদের সম্প্রদায়ের সব মৃতদেহ এখানে দাহ হয়। কিন্তু  করোনায় - "না"। সঙ্গে আছেন আতাউর সাহেব। কি আর করেন, শেষে রামপুরহাটের এক শ্মশানে দেহ দাহ করা হয় হিন্দু রীতি মেনেই। এই দুঃসময়ে ফুল কেনা, পৌরসভার গাড়ি ভাড়া থেকে ডোমকে দিয়ে দাহ করানো পুরো সৎকারে পাশে একমাত্র মৃতের ভাইয়ের শ্মশান যাত্রী আতাউর রহমান ও শববাহী গাড়ির চালক। যাঁরা দুজনেই রোজাদার। সৎকার সম্পন্ন করে দুজনেই বাড়ি ফিরে ইফতার করেন। এর থেকে বড়ো সিয়াম বা পূণ্যের আর কি আছে!

আতাউর রহমান বলেন, মানুষ হিসেবে যেটুকু করা উচিৎ, সেটুকুই করেছি। এরপর আর কি বলার থাকতে পারে! এভাবেই মনুষ্যত্ব বারবার হিংসার উপর জয়ী হয়। সম্প্রীতি বজায় থাকে। সমাজ টিকে থাকে।

(www.theoffnews.com - Birbhum corona secularism)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours