দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
একুশের নির্বাচনে আরেকবার প্রমাণ হলো জনতাই জনার্দন। ইভিএম নয়। জনতাই শিরোনাম দেয়। তাই শিরোনামটা বাদ থাক।
কালকেই ভোট গণনার দিন পরিযায়ী শ্রমিকের মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনা দিয়ে শুরু করছি। যদিও এটা একটি পথ মাত্র। গন্তব্য নয়। কিন্তু তাতে কি? কর্তাভজাদের কাছে কালকে গুরুত্বপূর্ণ অনেকটা "জিপসিদের 'কান্তে হোন্দো' নামের এক ধরণের ফ্লামেংকো ঘরানার গা ছমছম করা 'খেলা হবে' সঙ্গীত। খেলা একটা হোলো। কারণ হিট উইকেটে মৃত্যু বা যে কোন ফাউল প্লে, 'দিদি ও দিদির' মতো স্লেজিং খেলারই অঙ্গ। এটা বাংলায় ঘটবে, ঘটছে। তার জ্বাজল্য প্রমাণ ইলামবাজার থানার অন্তর্গত ইলামবাজার পঞ্চায়েতের গোপালনগর গ্রাম। এখানেই এক পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে গণনার দিন। পিতৃদত্ত নাম একটা ছিল। গৌরব সরকার (২৯)। বছর খানেক আগে তার বিয়ে হয়। বিভিন্ন রাজ্যে রুজি রোজকারের জন্য যেতে হয় মজদুরী করতে। রবিবার ভোট গণনার দিন, বেশ কয়েক রাউণ্ডে এগিয়ে যায় শাসকদল। তারপর স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব বের করে উল্লাস জটলা। বেশ কয়েকজন তৃণমূল কর্মী দল বেঁধে যাওয়ার সময় গোপালনগরে গৌরব সরকারের বাড়িতে ভাঙচুর শুরু করে। তাদের থামাতে যায় গৌরব সরকার ও তার ভাই সেতু সরকার। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় তার। ছোট ভাই সেতু সরকার বোলপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মৃত গৌরব সরকারের বাবা গৌরাঙ্গ বাবুর অভিযোগ, শুধুমাত্র বিজেপি করার জন্য তাঁর ছেলেকে পিটিয়ে মারা হলো।
বিজেপি তৃণমূল তো একটা নাম মাত্র। আসল অযাচিত মৃত্যু। কেন? কি ছিল এবারের নির্বাচন? আমরা সবাই জানি, এই নির্বাচন ডেমোক্র্যাট রুজভেল্ট বনাম রিপাবলিকান ল্যান্ডনের ছিল না। সোস্যাল সিকিউরিটি ও আনএমপ্লয়মেন্টের নিউ ডিল পলিসি নিয়ে ইস্তেহার হবে, অলীক কল্পনা । আমরাও আমেরিকান নয়। তবে ভোট দিই। এখনো পার্সেন্টেজ দেখা হয় নি। তবে কেউ রুজভেল্টের মত ষাট শতাংশ ভোট পেতেই পারেন। কেউ ল্যাণ্ডনের মত ছত্রিশ, আবার কারো ভাগ্যে দুই ছটাক ও জোটে না। তা হোক। তবে এখানে মোদ্দা কথা উইকেট পড়বে, খেলা হবে। এখনো খেলা অনেক বাকি, সেটি জানান দিয়েছেন স্বয়ং অনুব্রত। সেটা কখন, কিভাবে ক্রমশ প্রকাশ্য।
নথিপত্র ঝাঁকি থেকে যা বেরুচ্ছে, তাতে বাম কংগ্রেস, বিজেপি ও তৃণমূল প্রত্যেকেই জয় পরাজয়ের নিজ নিজ পর্যালোচনা করবে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের মতে, হয়তো অন্য দল থেকে আগত প্রার্থী মেনে নিতে পারেনি মানুষ। যেটা বলতে পারলেন না, দুর্নীতি গ্রস্থ প্রার্থী। এক মুখ। সেটাও পুরোপুরি ঠিক নয়। দুর্নীতি গ্রস্থ নেতা ও দলবদলুদের নিয়ে উন্নাসিকতা কবে ছিল বাংলার? ইতিহাস কি তাই বলে? আগে বলা হত বাঙালি আত্মঘাতী। কেউ বললেন, এবার নির্বাচনে দেখা গেল বাঙালি আত্মঘাতী নন, তার প্রমাণ এবার অবাঙালীদের উপর বাঙালির জয়। তাহলে, বন্দরে ফিরহাদ তৃণমূলের প্রতীকে জিতলেন কি ভাবে? বিজেপির একটি গোষ্ঠীর ক্ষুণ্ন অভিব্যক্তি, হিন্দু আত্মঘাতী। বুঝলো না। বাংলার হিন্দু ও ইউপির হিন্দু এক নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের হিন্দুরা যতটা অত্যাচারিত, এখানে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সেরকম মাপের কিছু নেই। তাই শুধু হিন্দুত্ব টনিক এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। গোমূত্র, গোময় ও গোমাতা কনসেপ্ট গুহ্য রাখতে হবে। বিজেপির প্র্যাগমেটিক এসব তত্ত্ব শুনে আধুনিক শিক্ষিত প্রজন্ম হাসে। অনেকেই মনে করে এসব আরেক ধরনের "মাদ্রাসা সেকেলে"। আধুনিক মনস্কতার দরকার। তাহলে মুসলিমরা কিভাবে একত্রিত। এটা সংখ্যালঘু চরিত্র। ইনসিকিউরিটি অনুভূতি থেকে আসে। তাই বিজেপি প্রার্থীর গাড়ির পিছনে বাচ্চা মুসলিম ছেলেরা লাঠি নিয়ে ছুটছে এমন দৃশ্য এই নির্বাচনে দেখা গেছে। অপেক্ষা করুন, হিন্দুরা সংখ্যালঘু হলে পারুক না পারুক, মনে প্রাণে এটাই চাইবে। শাসক সহ বাম কংগ্রেস মানুষকে বোঝাতে সমর্থ বিজেপি কোন রাজনৈতিক দল নয়, ইজরাইলীদের মতো একটি হিন্দু সন্ত্রাসী দল। যাদের লক্ষ্য মুসলিম খতম করা। আজ সেই কাজে মুসলমানদের বিশ্বাস অর্জনে সব থেকে সক্ষম শাসকদল। আর কংগ্রেস যে পারেনি, তার প্রমাণ রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত জেলা ও অঞ্চলে তাদের 'শূণ্য পরিনাম'। এটা মেনে নিতেই হবে মুসলিম মেয়েরা শুধু সিরিয়াল দেখে না, তারা রাজনৈতিক ও স্বধর্ম সংস্কার সচেতন। যেমনটি অন্যের ক্ষেত্রে সেরকম খাটে না। স্বধর্মের প্রতি সম্মান হিন্দুদের খুবই কম। অনেক ক্ষেত্রে তা লজ্জা। তার যথেষ্ট কারণ থাকতেই পারে। তাই তো কনসলিডেটিড ভার্সেস সেগ্রিগেটিট কমিউন্যাল ইনার্সিয়াল ফ্রেমে বন্দী সব রাজনৈতিক দল। সে তাত্ত্বিক কারণে বাম কংগ্রেস মানুক আর নাই মানুক, এই ফ্রেমের বাইরে সব আপেক্ষিক। কেউ বলছেন, নবাগত প্রার্থীর জন্য অনেকের হার, তাহলে অদিতি মুন্সীর কাছে শমীক ভট্টাচার্য্য হারতেন না। কেউ বলছেন দল পরিবর্তন অনেকের হারের কারণ। তাহলে উত্তরবঙ্গে শঙ্করবাবুর কাছে অশোক ভট্টাচার্য্য হারতেন না।
রাজনীতিতে শেষ কথা আছে বলে আমি মনে করি না। আত্মসমালোচনা কিন্তু উভয় পক্ষের দরকার। মনে রাখতে হবে রাজ্যে কোষাগার শূন্য। উল্টে কাটমানির স্বর্গরাজ্য এই রাজ্য। জনগন শাসকের পক্ষে বিপুল ভোট দিয়েছে কিন্তু রাজধর্ম পালনের জন্য। এই রাজ্য যেমন শাসককে সহজে সরায় না। তেমনি মুখ ফেরালে একটি আসনও দেয় না যেমন এবারে ৩৪ বছরের একদা শাসিত সিপিএমের অবস্থা। আবার কিন্তু ভোট হবে যদি ভারতে গণতন্ত্র জীবিত থাকে।
পরিশেষে একবার মনে করিয়ে দিই এক নদীর কথা। স্পেনের সিয়ারা মরিনা পর্বত থেকে উৎপত্তি রিও টিন্টো নদীর। দেখতে খুব সুন্দর লোহিত নদী। কিন্তু এই নদীর ক্ষার মাত্রা খুব কম। আর অম্লত্ব এত বেশী জলে লোহা পর্যন্ত গলে যায়। সেই জলে স্নান করুন। কঙ্কাল হয়ে বেরিয়ে আসবেন।
(www.theoffnews.com - West Bengal election)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours