সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

অবশেষে আজ রাজভবণে রাজ্যের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শপথ বাক্য পাঠ পড়িয়ে দিলেন। এই শপথ বাক্য পাঠ কতটা আন্তরিক ভাবে গ্রহণীয় নাকি নিছক আনুষ্ঠানিক ভাবে উদাসনীয় তা আগামী সময় নিশ্চয়ই জানান দেবে কোনও সন্দেহ নেই। তবু রাজ্য এগিয়ে চলুক সামাজিক ভাবে, আর্থিক ভাবে ও সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে- রাজ্যবাসী হিসেবে এ যে আমারও একান্ত কামনার। একথা অনস্বীকার্য এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয়বারের জন্য তৃণমূল সুপ্রিমো হিসেবে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন একজন মহিলা হিসেবে, যা অবশ্যই নজিরবিহীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে।

তবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয়বারের মুখ্যমন্ত্রীত্ব শপথের মূহুর্তে কিছু অবধারিত অপ্রিয় প্রশ্ন উঠে আসেই। যা অবশ্যই শাসককে খুশি করবে না এটুকু নিশ্চিত।

এই রাজ্যে ভোটে হেরে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ফের মুখ্যমন্ত্রী পদে কে প্রথম শপথ নিলেন?

রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর কে প্রথম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সোজা দরজা ছেড়ে পিছনের গলি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হলেন?

নির্বাচনোত্তর রাজ্যে হিংসার আগুন জ্বলছে শাসকের স্পনসরশীপে। এই ঘটনাবহুলের অভিঘাত এতটাই যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফোন করে রাজ্যপালের কাছে খবর নিচ্ছেন। আর রাজ্যপাল কার্যকরী মুখ্যন্ত্রীকে সতর্ক করছেন। সেই মুখ্যমন্ত্রী কে?

উপরিউক্ত সব প্রশ্নের একটাই উত্তর-- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই প্রসঙ্গগুলি পর্যালোচনা করতে গিয়ে একটা ঐতিহাসিক অতীত মনে পড়ে গেল। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী একদা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন একেবারে প্রকাশ্যে। সেদিন নরেন্দ্র মোদী ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। আজ আবার সেই কথাটাই একাংশ বঙ্গবাসীর মনে উঁকি দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী আপনি শুধু তৃণমূলের মুখ্যমন্ত্রী নন। আপনি সিপিএমের, বিজেপির, কংগ্রেসের, আইএসের সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। সমগ্র বাংলার গর্বের মুখ্যমন্ত্রী আপনি। তাই রাজধর্ম পালন আপনার কাছেই কাম্য। রাজ্যে যে কোনও মূল্যে শান্তি ফেরান। এই দাবিতে কিন্তু কোনও আপোষ নয়। রাজ্যবাসী পশ্চিমবঙ্গকে রক্তলীলার বধ্যভূমি তৈরি করার জন্য তৃণমূলকে বিপুল পরিমাণ ভোট দেয়নি। ভোট দিয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মনস্কামনায়। তাই তাঁদের নিরাশ করার অধিকার আপনার নেই। হয় রাজধর্ম পালন আপনি আগেই করুন স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে নচেৎ আশা করবো রাজ্যপাল আপনার ব্যর্থতার পরবর্তী পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর রাজধর্ম পালন করবেন। কে রাজধর্ম পালন করবে তা ঠিক করার দায়িত্ব অবশ্যই এখন আপনার কোর্টে। কোনও অজুহাত নয়। রাজধর্ম পালনের মাধ্যমে দিয়ে রাজ্যে শান্তি ফেরান এই একটাই আবেদন আপনার কাছে। এটাই এখন বঙ্গবাসীর আপনার কাছে চাওয়া অর্জুনের পাখির চোখ।

রাজ্যে শাসন কার্য চালাতে গেলে কিছু প্রশংসা কিছু সমালোচনা হবেই। তবে একটা অনুরোধ আছে। কাটমানি কালচার কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করুন আর অনুদান বেলানো বন্ধ করুন। দু টাকার চাল বিলিবন্টনে কত ব্যাপক সংখ্যক মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছে সেটা রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মানদন্ড হতে পারে না। বরং আপনার তৃতীয় বারের মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে সেই দৃশ্য প্রত্যাশা করবো, দু টাকা দড়ে কেজি চাল কেনার জন্য লাইনে দাঁড়ানোর মতো পর্যাপ্ত সময় আর রাজ্যবাসীর হাতে যেন না থাকে। হতেই পারে রাজ্যের কোষাগার শূন্য। এক টাকা থেকে দশ পয়সা অনুদান দিয়ে মোট নব্বই পয়সা তৈরি করা বন্ধ করে, অর্থের পুঁজিবাজার মূল্যায়ন ঘটিয়ে ওই এক টাকাকে এক টাকা দশ পয়সায় পরিণত করুন। বিশ্ব অর্থনীতির এটাই মূল মন্ত্র, অনুদানে কোনও জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। প্রয়োজন শিল্পভিত্তিক পুঁজিনিবেশ। আর তাতেই যে রাজ্যবাসীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার প্রাণ ভোমরা লুকিয়ে আছে, এটা আপনাকে মানতেই হবে। কিন্তু সেই আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসে যায় কাটমানি কালচার ও অশান্তির আবহ। এই দুটি ক্ষেত্রে আপনি প্রকৃত প্রশাসক হলেই পরিস্থিতি ফেরানো অবশ্যই সম্ভব। অন্যথায় রাজ্যে পুঁজির খরালগ্নও কাটবে না আর আপনিও ভাঙা রেকর্ড বাজাবেন রাজ্যপাল ও প্রধানমন্ত্রীর বহুল বিরুদ্ধাচারণের। এতে রাজ্যে আখেরে কি লাভ বলতে পারেন?

তবে আপনি যদি ভেবে থাকেন একুশের নির্বাচন এই রাজ্যের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচন তবে আমার কিছু বলার নেই। আপনার ভাবনা আপনার স্বাধীনতা। শুধু একটাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই বাংলা শাসককে সহজে ফেলে দেয় না কেরলের মতো। তাই তো সিপিএম চৌত্রিশ বছর রাজ্য শাসন করেছে। আপনিও তৃতীয় বারের জন্য শাসনের সুযোগ পেলেন। কিন্তু এবার সিপিএম কিন্তু একটিও আসন পায়নি। আপনার মতো পোড় খাওয়া ঝানু রাজনীতিবিদ নিশ্চয়ই এই ইঙ্গিত কতটা অর্থবহ তা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন।

অনেকেই বলবেন, আপনি মুখ্যমন্ত্রীর এত তীব্র সমালোচক কেন? আসলে আমার পরিচয়, আমি দলদাস নই। কোনও দলের সদস্য বা সমর্থকও নই। আমি সাংবাদিক। আমি এডিটর। তাই শাসকের বিরুদ্ধে কলম ধরা আমার নৈতিক কর্তব্য। বছর এগারোর আগেকার কথা। স্থান পানাগড় লাগোয়া দার্জিলিং মোড়। রাত সাড়ে তিনটে বাজে। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের তখন আমি সুযোগ পেলেই তুমুল সমালোচনা করতাম। ঠিক সেই মূহুর্তে আজকের এই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাস্তার ধারে একটি ধাবায় এসে বেঞ্চিতে বসলেন আমাদের চার পাঁচজনের সঙ্গে। উনি সেখান থেকে সিঙ্গুর যাবেন ঠিক করেছিলেন। পুলিশ সূত্রে একটি গোপন খবর আমি পেয়েছিলাম। বুঝে গিয়েছিলাম উনি একটুপর বিপদে পড়তে চলেছেন বুদ্ধবাবুর পুলিশের হাতে। আমি সেই গোপন তথ্যটি সেদিনের বিরোধী নেত্রীকে একেবারে একান্তে ওই ভোররাতে জানিয়ে দিই। তখন তিনি আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, আমিও খবর রাখি। তবে খবরটা বলে ভালো করেছেন। পরক্ষণেই বললেন, নাইবা চা খেলেন। গরীব দিদির দেওয়া বিস্কুট অন্তত খান।

কি করবো দিদিভাই? ওই যে বললাম আমি দলদাস নই। আপনি আমার সম্মানীয় মুখ্যমন্ত্রী। এখন যে আপনি শাসক। আর আমি এডিটর। তোষামদির কলম যে আমার বুকপকেটে থাকে না। আবার আজকে সেদিনের মতো বিপজ্জনক কোনও তথ্য আপনার পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে পেলে, সেটাও কিন্তু সেদিনের মতো এদিনের বিরোধী নেতাকে জানাতে একটুও দেরি করবো না গোপনীয়তা বজায় রেখে, এ'ব্যাপারে একদম নিশ্চিত থাকবেন। তবে এটুকু কথা দিতেই পারি, আপনার ভুলকে সঠিক বলে আপনাকে গাড্ডায় ফেলার মতো ক্ষতিসাধন আমি করবো না কোনদিনই। তবু আজ আপনার এই শপথের শুভদিনে একটাই ঈশ্বরের কাছে কামনা করি, আজকের প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন ভারত শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হোন। আপনার সমালোচনা করার কোনও সুযোগ যেন আর আমরা না পাই। এতসব সমালোচনা লিখে লিখে আমিও সত্যি বেশ ক্লান্ত। এবার যে একটু জিরতে চাই...

(www.theoffnews.com - Chief Minister Mamata Banerjee West Bengal)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours