সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

একুশের টানটান উত্তেজনার নির্বাচনে ফলাফলের ক্লাইমেক্স কিন্তু বড্ড একতরফা। সৌজন্যে সিপিএমের এক্স ফ্যাক্টর নীচুতলার ভোট।

ফল ঘোষণার দিনের শেষে জয়ী তৃণমূলের সেকি সদর্প হুংকার, দিদির প্রতি আস্থা রাখলো বাংলা, জয় বাংলা গুজরাটীদের প্রত্যাখান করা করেছে। ভোটে অস্তিত্বহীন সিপিএম আরও একধাপ এগিয়ে বললো, যাক ধর্মীয় মেরুকরণের লড়াইয়ে আমরা জিতলাম, এবার ভাতের লড়াই বাকি।

গোহারা বিজেপি তো কপিবুক কমেন্ট করেই ক্লান্ত, জনগন কেন আমাদের ভোট দিল না তা পর্যালোচনা করবো, মানুষ আমাদের বিধানসভায় বিরোধী রাজনীতির স্বীকৃতি দিয়েছে বলে বাংলার ভোটারদের ধন্যবাদ জানাই।

এতো সব নানা দলের রকমারি বহুল চর্চিত বিবৃতি। পাশাপাশি এটাতো মানতেই হবে এমন ডিংডং নির্বাচন বাংলার রাজনীতিতে এই প্রথম। যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেন ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছিলেন এই বাংলায় দলীয় প্রচারকে কেন্দ্র করে। কিন্তু কেন তাঁরা এটা করেছিলেন? বিজেপির সভাপতি থেকে অন্যান্য কেন্দ্র স্তরের নেতারা দল বেঁধে আসবেন দলকে জেতানোর জন্য এটাতো কাঙ্খিতই। তাই বলে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন ভাবে ঘনঘন বাংলায় দৌড়ে আসলেন, পশ্চিবঙ্গ কি এই দৃশ্য আগে কখনও দেখেছে? এই প্রশ্নটা কিন্তু রাজ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গোপনীয় প্রাসঙ্গিকতা। আচ্ছা, তবে কি নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ তস্য বোকা? কেন, কি কারণে, কোন ভরসায় তাঁরা এভাবে বারবার বাংলায় এসে নিজেদের মুখ পোড়ানোর ঝুঁকিটা নিলেন? তবে কি পিএমও অফিসের গোপন রিপোর্ট ভুল প্রমাণিত হল বিজেপির জেতাকে উল্লেখ করে? গেরুয়া জয়ের সঠিক দিশা দেখাতে তাহলে কি ব্যর্থ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র গোয়েন্দা দফতর?

আরও অনেক এরকম অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে বঙ্গ রাজনীতিতে তৃণমূলের এই বিপুল জয়কে কেন্দ্র করে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার আগেই রাজ্য পুলিশের গোপন রিপোর্ট কিন্তু সন্তুষ্ট করতে পারেনি নবান্নকে। সাংবাদিকতার সূত্রে এই খবরের নিশ্চয়তা পেয়েছিলাম পুলিশ মহল থেকেই। অন্যদিকে তৃণমূল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেতারা বিজেপিতে এসে ভিড় জমিয়েছিলেন। কেন বলুনতো? যাঁরা দলবদল করেছিলেন তাঁদের কি সবারই দূরদর্শিতার অভাব? সবাই সুযোগসন্ধানী ও নির্বোধ? তাই যদি হবে তবে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী দলবদলকারী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হেরে যাবেন কেন? আসল কথা হল, রাজনীতিতে ফুটো নৌকায় কেউ থাকাটা নিরাপদ মনে করেন না। এটা সর্বকালীন সর্বস্তরের রাজনীতির অন্যতম দস্তুর সূত্র। আবার উল্টো কথা আসতেই পারে। তৃণমূল যদি ফুটো নৌকাই হবে তবে যে ফলাফল বলে দিল ঘাসফুল শিবির এক বিরাট মাপের রণতরী। তার উচ্চতা হিমালয় সম। আপাতত এটা একদম ঠিক কথা। খোলা চশমার বাইরের দৃষ্টিতে।

আবার ফিরে আসি আরও অনেক 'কিন্তু' খুঁজতে। বিজেপির সভা সমিতিতে কি বিপুল জনোচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছে নানান ভোট প্রচারের আসরে, তা কি মিথ্যে? মুখ্যমন্ত্রীর জনসভায় উনার ববি ল্যাঙ্গুয়েজে ও ভাষা ব্যবহারে অতীতের নির্বাচনগুলোর থেকে এবারের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনেক বেশি ম্রিয়মান দেখিয়েছে, এটাও কি অসত্য? তবে, তবে, তবে...

এতো 'তবে'র যাবতীয় উত্তর কিন্তু লুকিয়ে আছে একটিমাত্র প্রশ্নের গর্ভে। কি সেই কোটি টাকা মূল্যের প্রশ্ন? প্রশ্নটা হল, সিপিএম কেন এবার শূন্য আসন পেল? সিপিএমের মিটিংগুলিতে তো কম ভিড় হয়নি। ব্রিগেড সভার জমায়েত তো সিপিএম বিরোধীদের হাড়ে হলুদ ধরিয়ে দিয়েছিল ততদূর জানি। রাজ্যের প্রতিটি গলিতে খুঁজলে এখনও সর্বত্র পাবেন সিপিএম গাদা গাদা সমর্থক। তবু একটিও আসন এবার পেল না সিপিএম। অবাক হচ্ছেন তাই না? আসলে নিন্দুকেরা কিন্তু অন্য গোপন ফিসফাস করছেন, সিপিএম একটিও আসন পেল না এটাও আসলে একটা রাজনৈতিক জাগলারি। সিপিএম ইচ্ছে করে জেতার পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়ে পুরোটা ওয়াকওভার দিয়ে দিল তৃণমূলকে। সেকি?

একদম সঠিক শুনছেন। বাস্তব অনুঘটক জানতে আপনাকে পিছিয়ে যেতেই রাজ্যে ঠিক গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাস ছয়েক অতীতের ফোকাসে। তখন শুরু হয়েছিল বেলাগাম তৃণমূলের অত্যাচার। তদানীন্তন সময়ে তৃণমূলের সবচেয়ে বেশি সফট টার্গেট ছিল সিপিএম। তুলনামূলক কম বিজেপি। যদিও তখন থেকেই অত্যাচারের পাল্টা ডোজ দিতে শুরু করে বিজেপি। কিন্তু সিপিএমের কোনও নেতৃত্ব দলীয় কর্মীদের সেভাবে আশ্রয় দিতে বাস্তবে এগিয়ে আসেননি তখন থেকেই। সিপিএম নেতারা শুধু প্রেস বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব খালাস করতেন। প্রত্যাশিত ভাবেই ধীর লয়ে একসময় এসে গেল লোকসভা ভোট। তৃণমূলী সন্ত্রাসের অভিমুখ তখন খানিকটা পাল্টে ফিভটি ফিভটি। বিজেপি ও সিপিএম সমান আক্রান্তের শিকার। যথারীতি বিজেপি নেতৃত্ব খোলাখুলি প্রতিরোধের পূর্ণ অধিকার নিয়ে ময়দানে নেমে পড়লেন। দিলীপ ঘোষও তখন দলের নিচুতলার কর্মীদের নিদান দিলেন হাতে বাঁশ রাখতে। কিন্তু আলিমুদ্দিন নেতৃত্বের শীতের ঘুম আর কাটে না। না নড়ে না চড়ে। সুজন চক্রবর্তী টিভি বাইট দিয়ে একটু যা প্রতিবাদী হন ক্যামেরার সামনে। কিন্তু সিপিএমের প্রান্তিক কর্মীরা সুজন- বাইটে ভরসা রাখতে আর পারলেন না। নিজেদের সুরক্ষার কারণে ও পিঠ বাঁচাতে লোকসভায় উজার করে তাঁদের চিরশত্রু 'চাড্ডি হিন্দু মৌলবাদী' বিজেপিকেই ভোট দিয়ে বসলেন পরিকল্পিত ভাবে। বিজেপি যেন তখন তাঁদের কাছে একমাত্র পরম আশ্রয়ের ঠিকানা। মনের ফুল্লরার মতো। বিজেপিকে প্রদানকারী ওই বাম ভোটগুলি ছিল সিপিএমের গ্র্যাসরুট লেবেলের। তাঁদের অটুট বিশ্বাস ছিল, এমতাবস্থায় সিপিএম নেতৃত্ব উপযুক্ত নিরাপত্তা দলের নিচুতলার কর্মীদের দিতে পারবে না। তাই চাচা আপনা প্রাণ বাঁচা শর্তে দে বিজেপিকে ভোট। ফলে লোকসভা ভোটের থেকেই সিপিএমের শতকরা প্রাপ্ত ভোট এসে ঠেকলো তলানিতে। সিপিএমের ফিনিক্স পাখি বিজেপির বাসায় উপছে পড়ল হঠাৎ। গেরুয়া শিবিরে যেন তখন অশ্বমেধ যজ্ঞ জয়ের আনন্দ। আর বিমর্ষ তৃণমূল কারণ খুঁজতে ব্যস্ত কেন এমন গৈরিক উত্থান ঘটে গেল।

আসলে লোকসভায় বিজেপির রকেট উত্থান যেমন পুরো পদ্ম শিবিরের মুন্সীয়ানা নির্ভর ছিল না, তেমনি তৃণমূলের পিছনে ছিটকে যাওয়াটাও ঘাসফুলের ব্যর্থতা ছিল না। আসলে সবটাই ছিল সিপিএমের এক্স ফ্যাক্টর ভোটদানের রসায়ন। যেমনটা এই বিধানসভা ভোটেও একই পটপরিবর্তন ঘটে গেছে বাম আসন শূণ্যতায়। শুধু সিপিএমের প্রান্তিক ভোটটা বিজেপি বাক্স থেকে নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটিয়ে চলে গেছে তৃণমূলের বোতামে। সিপিএম বেশ রপ্ত করে নিয়েছে, প্রকাশ্যে জ্বালাময়ী ভাষণ দাও কিন্তু নিজের ভোট নিজেকে নয়, দরকারে অন্যকে ভোট দাও গোপনে আর নিজেদের সুবিধাবাদী স্বার্থ রক্ষা করে চলো। তাতে রাজনৈতিক গিরগিটি হতে হয়তো নো পরোয়া।

এখানেও প্রশ্ন আসে, কেন এই সিপিএমের গোপন স্যুইং। উত্তরটা খুব স্পষ্ট। মনে রাখতে হবে, দেশের সবচেয়ে নীতিবাগিশ সুবিধাবাদী দল হল সিপিএম।

বিধানসভা সভা ভোট যত এগিয়েছে তৃণমূলের আক্রমণের ধার ক্রমশঃই কেন্দ্রিভুত হয়েছে বিজেপির দিকে। কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া সিপিএম কিন্তু এই ভোটের আবহে তুলনামূলক তৃণমূলের আক্রমণ থেকে নিরাপদেই ছিল। তাই লোকসভা ভোটের আগের সেই নিজেদের পিঠের চামড়া বাঁচানোর দায় এই বিধানসভা ভোটে প্রান্তিক সিপিএমের ছিলও না। যথারীতি নীতির বুলিও পাল্টে গেছে সিপিএমের রাতারাতি। ফলে যা হবার তাই হল। একদা প্রাণ বাঁচাতে গেরুয়াকে ভোট দেওয়া তাঁদেরই কথায় 'চাড্ডি হিন্দু মৌলবাদী' বিজেপি আর নয় দরকার। এরা তাই সাম্প্রদায়িক। সর্বশক্তি দিয়ে এদের ঠেকাও। প্রয়োজনে আপত্তি নেই মুসলিম তোষণকারী দুধেল গাই তৃণমূলের ফিরতি শাসনের। কারণ তাঁরা এই নির্বাচনী দেওয়ার লিখন স্পষ্ট পড়ে ফেলেছিল, এবার আর বিজেপিকে ঠেকানো না একা সিপিএমের পক্ষে সম্ভব না তৃণমূল একক ভাবে কমুন্ডলকে আটকাতে পারবে।

বিধানসভা আসনে নিজেদের শূণ্য করে সিপিএম তাই তৃণমূল ঝুলিতেই গোপন ভেট নিঃস্ব করে দিয়ে দিল। যা বিজেপি ও তৃণমূল কেউই বুঝতে পারলো না। এতটুকু এই বাম চালাকি বা বেইমানি ধরতেই পারলো না পিএমও দফতর ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। অন্ধ তৃণমূল তাই আস্ফালনেই মসগুল, এই জয় নাকি দিদির একক কৃতিত্বের জয়। আবার অর্ধ বিকারগ্রস্থ বিজেপি কারণ খুঁজতে হন্যে হচ্ছে, এত বিপুল সমর্থন পেয়েও লোকসভার জয়টাও কেন অধরা থেকে গেল। উত্তর একটা, সিপিএমের এক্স ফ্যাক্টর ভোটের চরম বেইমানি ও সুবিধাবাদী নোংরা ভোলবদল। 

শেষে একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে বারবার, চাড্ডি হিন্দু মৌলবাদী বিজেপি যদি সিপিএমের কাছে সাম্প্রদায়িক হয়, তবে কোন যুক্তিতে মুসলিম তোষণকারী দুধেল গাই তৃণমূল তাঁদের কাছে সাম্প্রদায়িক হল না? নচেৎ পিঠ বাঁচানোর স্বার্থ ফুরিয়ে যাওয়ার পর তাঁরা বলবে কেন, ধর্মীয় মেরুকরণের লড়াইয়ে আমরা জিতলাম! ধর্মীয় মেরুকরণ কে করেনি এই ভোটে। অবশ্যই বিজেপি করেছে। তৃণমূল সেও একই দোষে দুষ্ট। আর সিপিএম? মুসলিম ধর্ম প্রচারক আব্বাস সিদ্দিকীর গালে চুমু খেয়ে সিপিএম আজ নিজেই সাম্প্রদায়িক পোষক। 

এরপরও কে তার জবাব দেবে, সিপিএম নিজের ভোট নিজেকে দিল না কেন? বেইমানির সুবিধাবাদী রাজনৈতিক জাগলারি যে দলের ধমনীতে অক্সিজেন সম বইছে, তাঁরা কি উত্তর দেবে? 

(www.theoffnews.com West Bengal election CPM BJP TMC)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours