পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

(হাসপাতালে জঙ্গিহানা!) 

২০০৩ এর অক্টোবরের এক সন্ধে। সাড়ে সাতটা থেকে আটটা, জমে উঠেছে আমাদের সান্ধ্য আড্ডা। সিউড়ীর মসজিদ মোড়ে আমাদের আড্ডা বসত সংবাদ প্রতিদিনের সাংবাদিক নন্দনদাদের দোকানের সামনে। সঙ্গে আরও কিছু সাংবাদিক এবং অসাংবাদিক কয়েকজন। হঠাৎই আমার মোবাইলে একটি ফোন, হাসপাতালের কোনও এক ডাক্তার, উত্তেজিত গলায় জানালেন জঙ্গীহানা হয়েছে হাসপাতালে। সিউড়ী সদর হাসপাতালে জঙ্গি হানা! ফোনটা শুনে বেশ একটু ঘাবড়ে গেলাম। কেউ আমার সঙ্গে মস্করা করছে না তো। সামনে অন্যদের বলতে তারাও দেখলাম একটু সংশয়ে। যাই হোক দ্রুত আমার দুই সহকর্মী সুপ্রতিম এবং সঞ্জয়কে ফোন করে বললাম ক্যামেরাটা নিয়ে সরাসরি হাসপাতালে যেতে। আড্ডা ছেড়ে বাইক নিয়ে তরিঘড়ি রওনা দিলাম আমিও। 

হাসপাতালে পৌছেই দেখি জরুরী বিভাগের সামনে জটলা। হাসপাতালে অনেকেই মুখ চেনা। যেতেই এগিয়ে এল এক নিরাপত্তা কর্মী। দাদা জঙ্গি আক্রমণ। এও বলে জঙ্গি আক্রমণ! এত জায়গা থাকতে হঠাৎ এমন নিরীহ এক জায়গায় জঙ্গি আক্রমন কেন? দুশ্চিন্তা নিয়ে এগোতেই শুনলাম জঙ্গি রয়েছে পুরুষ বিভাগে। সব রোগীকে সে নাকি বন্দি করে রেখেছে। ধীরে ধীরে দোতলায় উঠতে যেতেই গুলির আওয়াজ, সঙ্গে আর্তনাদ। কানে এল হিন্দিতে হুমকি – ‘এদিকে কেউ এলেই মেরে ফেলব’। ক্যামেরা নিয়ে অতি ভয়ে এগিয়েছে সুপ্রতিম, চেষ্টা করছে কিছু একটু ছবি নেওয়া যায় কিনা। আমি আর সঞ্জয় দরজার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি, কি ঘটছে। যেটুকু দেখতে পেলাম একজন টুপি পরা লোক বন্দুক নিয়ে গোটা মেইল ওয়ার্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একজন বন্দিকে সে ইতিমধ্যে গুলিও করেছে। 

ঘন্টা খানেক অতিক্রান্ত, নটায় ইটিভি ছবিসহ খবরটি ব্রেক করতেই ফোনে ফোনে জেরবার আমি। স্থানীয় মানুষজনও টিভি দেখে চলে এসেছেন হাসপাতালে। চারিদিকে সাজো সাজো রব। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। পুলিশ প্রশাসনের বড় কর্তারাও হাজির। এরই মধ্যে একজন নার্স খবর নিয়ে এল জঙ্গির নাম নাকি টাইগার। আবার জঙ্গি বলে? এই জঙ্গি ব্যাপারটাই কিছুতে মেলাতে পারছি না। জঙ্গি টঙ্গি তো কাশ্মীরে জানতাম, এখানে কোত্থেকে এল? যাই হোক এর মধ্যেই সে দুটি বোমাও ফাটিয়েছে হাসপাতাল চত্বরে। পুলিশ তখন হাসপাতালে থাকা অন্য মানুষদের বের করতে সচেষ্ট হল। উৎসাহী জনগণ কিছুতেই যাবে না, শেষমেশ লাঠিচার্জ করে ফাঁকা করা হল হাসপাতাল। আড্ডা থেকেই গিয়েছি, তাই আটপৌরে পাজামা পাঞ্জাবি পরা আমাকে দেখে তেড়ে এল এক র‌্যাফ জওয়ান। লাঠি দিয়ে মারতে যাবে, কোনও মতে হাতের বুমটা দেখানোতে সরি বলে ফিরে গেল, না হলে হয়ে গিয়েছিল আমার। হাসপাতাল চত্বরে রয়েছি আমরা কয়েকজন সাংবাদিক এবং পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা। নিচে একটা থামের আড়ালে থেকে জঙ্গির কাজকর্ম দেখার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি প্রতি ঘন্টায় ই-টিভিতে আমরা আপডেট দিয়ে যাচ্ছি। 

প্রায় সামনেই এসে পড়ল একটা বোমা লাফিয়ে পিছনে যেতেই ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লেন এক ভদ্রলোক, আওয়াজ হল ক্যোঁৎ করে। আহা লাগল, বলে তুলতে গিয়ে দেখি অতিরিক্ত জেলা শাসক মদনবাবু। একটু বিরক্ত হয়েই বললাম- এখানে কি করছেন? ‘কি বা করতে পারি? আপনাদের মতই দেখছিলাম’ মদনবাবুর স্পষ্ট জবাব। পিছনে দেখি কাণ্ড দেখে খিলখিলিয়ে হাসছে জি টিভির পরিতোষ। ঝাঁঝিয়ে উঠলাম ‘এর মধ্যে তোর হাসি পাচ্ছে? বোমটা আর চার পাঁচ ফুট আগে পড়লেই…’

বার বার রফা করবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ, টাইগার সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে কাউকে ছাড়বে না। কিন্তু কি চাইছে সে সেটাও স্পষ্ট নয়। যে রোগীকে সে গুলি করেছে তার অবস্থাটাও জানা যাচ্ছে না।

‘রাত প্রায় বারোটা, এখন একটা বোমা পড়ল। আমরা দাঁড়িয়ে আছি হাসপাতাল চত্বরে’। মিহি গলায় কবিতা পাঠের মত এই আওয়াজ শুনে দেখি খাস খবরের সাংবাদিক কিশোরদা ক্যামেরায় তার গলা রেকর্ড করে রাখছে। কি হল? জিজ্ঞাসা করতেই নির্লিপ্ত উত্তর- ‘অফিস বুঝবে আমি রাতেও এখানে ছিলাম’। বোঝ কাণ্ড! ইতিমধ্যেই আমার টিভি জানিয়ে দিয়েছে তারা সারারাত খবর সম্প্রচার করবে। সেই প্রথম কোনও বাংলা চ্যানেলে লাইভ হল গোটা রাতের খবর। এখনও আপনারা যে বাংলা চ্যানেলগুলি দেখেন তাতে বিশেষ কোনও ঘটনা না ঘটলে রাত বারোটার পর থেকে ভোর ছটা বা সাতটা পর্যন্ত লাইভ খবর বা অনুষ্ঠান হয় না। যাই হোক পুলিশ ঠিক করল একটু শেষ রাতের দিকে তারা রেসকিউ অপারেশন চালাবে। আমাদের সেই মত এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলা হল। কিন্তু আমি তো সাফ জানালাম এলাকা ছেড়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, আমরা পুলিশেরও আগে এখানে এসেছি। হাল ছেড়ে দিয়ে জেলা পুলিশ সুপার জানালেন কোনও বিপদ ঘটলে কিন্ত আমাদের নিজেদের দায়িত্ব। সেই শর্তে রাজি হয়ে আমরাও অভিযানের সঙ্গী। সকলের মোবাইল বন্ধ বা সায়লেন্ট করে দিতে বলল পুলিশ। কলকাতার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এমনকি দিল্লী থেকেও ফোনের পর ফোন এসে আমার ফোনের ব্যাটারি প্রায় নেই বললেই চলে। 

রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ এগোলো পুলিশের কম্যান্ডো বাহিনী। আশপাশের ছাদ, হাসপাতালের অন্য ওয়ার্ডের জানালা দিয়ে স্নাইপাররা পজিশন নিল। সিড়ি বেয়ে এবং পিছনের পাইপ বেয়ে ধীরে ধীরে উঠতে লাগল কম্যান্ডোরা। ইতিমধ্যেই সারা রাত লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে টাইগার বোধহয় একটু ক্লান্ত তাই তার আওয়াজ কিছু মিলছিল না। চারিদিক নিস্তব্ধ, হাসপাতালের বাইরে হাজার খানেক মানুষও নিশ্চুপ, অপলক। আমরা সঙ্গে আছি, কিন্তু উপরে আমাদের উঠতে বারণ করা হয়েছে। বেশি বাড়াবাড়ি ভাল নয় বলে তা মেনেও নিয়েছি আমরা। একটু একটু করে সময় এগোচ্ছে, আমাদের উৎকণ্ঠায় প্রাণ ফেটে যাচ্ছে… এমন সময় গুলির আওয়াজ পর পর চার পাঁচটি, একটা আর্তনাদ। পরক্ষণেই দোতলার বারান্দায় পর পর বোমা এসে পড়ল। প্রচন্ড আওয়াজ, কেঁপে কেঁপে উঠল হাসপাতাল। আমাদের কাছাকাছিই ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, তার ওয়াকিতে খবর এল টাইগার উন্ডেড। গুলি লেগেছে টাইগারের। তবে এখনই ক্যাপচার করা যায়নি। আবার কিছুক্ষণ রুদ্ধশ্বাস বিরতি। যে যেখানে ছিল সেখানেই চুপ। মিনিট পনেরো পরে আবার এগনো শুরু, সাড়ে চারটে নাগাদ খবর এল আত্মসমর্পন করেছে টাইগার। একাই ছিল সে আর কোনও জঙ্গি বা দূস্কৃতী নেই। তবে গুলি লাগায় জখম টাইগারকে এই হাসপাতালেই চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হচ্ছে। 

রাত ভর রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের ইতি পড়ল সূর্যের আলো ফুটতে। এবার খোঁজ নেওয়ার পালা, কেন এই জঙ্গি হানা। ভুল বললাম আর টাইগারকে জঙ্গি বলাটা ঠিক নয়। যেটুকু যা খবর পাওয়া গেল টাইগার একজন কন্ট্রাক্ট কিলার। আসল নাম আফরোজ খান। কদিন আগে খয়রাশোলের পাঁচড়া এলাকায় সদানন্দ ঘোষ নামে একজনকে গুলি করেছিল সে। সেই সদানন্দই আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন এই হাসপাতালে। নিজের অসমাপ্ত কাজই শেষ করতে এসেছিল টাইগার। হাসপাতালে ঢুকে গুলিও করে সদানন্দকে। কিন্তু সন্ধেবেলায় চারিদিকে এত লোকজন থাকায় সে ফেঁসে যাওয়াতেই এই বিপত্তি। বিপত্তির উৎপত্তি কিন্তু সেই কয়লা খনি অঞ্চল। বীরভূমের খনি বেষ্টিত খয়রাশোল এলাকার সদানন্দকে কয়লা সংক্রান্ত বিবাদের জেরেই খুনের জন্যই হাসাপাতালে হৈচৈ। সেও এক রাত বটে…

(www.theoffnews.com - Suri hospital shoot out coal)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours