তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

ভারতের ঐক্য ও সংহতি তখনই আসবে যদি হিন্দু আর মুসুলমান হাতে হাত ধরে থাকে। কিন্ত রাজনৈতিক দলগুলি হিন্দু এবং মুসুলমানকে ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছে নির্বাচনের স্বার্থে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারা সবাই রবীন্দ্রনাথের উক্তি ব্যবহার করছে। আসুন দেখা যাক এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ কি বলেছেন।

রবীন্দ্রনাথের ধর্ম চিন্তা বলতে রবীন্দ্রনাথ রচনাবলী খুঁজে সম্ভবত এমন একটি বাক্য কিংবা শব্দও পাওয়া যাবে না, যাতে রবীন্দ্রনাথ মুসলমান সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হেয় করেছেন। মুসলমানের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি রবীন্দ্রনাথ, যদিও প্রসঙ্গ উঠলেই মুসলমানের সঙ্গে মিলতে না পারা হিন্দুর সমালোচনা করতে তিনি দ্বিধা করেননি।

“আমি এক ইংরেজিনবিশের কথা জানতেম, হোটেলের খানার প্রতি তাঁর খুব লোভ ছিল। তিনি আর-সমস্তই রুচিপূর্বক আহার করতেন, কেবল গ্রেট-ইস্টার্ণের ভাতটা বাদ দিতেন। বলতেন, মুসলমানের রান্না ভাতটা কিছুতেই মুখে উঠতে চায় না। যে সংস্কারগত কারণে ভাত খেতে বাধে সেই সংস্কারগত কারণেই মুসলমানের সঙ্গে ভালো করে মিলতে তাঁর বাধবে।” (কালান্তর)

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন, মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের সমকক্ষ হয়ে উঠুক। “ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তাহলে হিন্দু-মুসলমানে কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। সেই সমকক্ষতা তাল-ঠেকা পালোয়ানির ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়, উভয় পক্ষের সামাজিক শক্তির সমকক্ষতা।” (কালান্তর)

১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর মির্জা আলি আকবর খাঁর সভাপতিত্বে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘পয়গম্বর দিবস’। এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ বাণী পাঠান। তার বাণী সেদিন পাঠ করে শোনান সরোজিনী নাইডু। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘জগতে যে সামান্য কয়েকটি মহান ধর্ম আছে, ইসলাম ধর্ম তাদেরই অন্যতম। মহান এই ধর্মমতের অনুরাগীদের দায়িত্বও তাই বিশাল। ইসলামপন্থীদের মনে রাখা দরকার, ধর্ম বিশ্বাসের মহত্ত্ব আর গভীরতা যেন তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ওপর ছাপ রেখে যায়। আসলে, এই দুর্ভাগা দেশের অধিবাসী দুটি সম্প্রদায়ের বোঝাপড়া শুধু তো জাতীয় স্বার্থের সপ্রতিভ উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে না, সাহিত্যদ্রষ্টাদের বাণী নিঃসৃত শাশ্বত প্রেরণার ওপরও তার নির্ভরতা। সত্য ও শাশ্বতকে যারা জেনেছেন ও জানিয়েছেন, তারা ঈশ্বরের ভালবাসার পাত্র, এবং মানুষকেও তারা চিরকাল ভালবেসে এসেছেন।’

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিসত্তাকে অহং আর ব্যক্তির ভিতরের অর্থাৎ অন্তর্গত সত্ত্বাকে বলেছেন আত্মা। তুলনা দিয়েছেন, ব্যক্তিসত্ত্বাকে যদি বলি প্রদীপ, তো আত্মা হচ্ছে তার শিখা। অন্তর্গত সত্তার কথা রবীন্দ্রনাথের কবিতায়-গানে ফিরে ফিরে এসেছে। গানের দৃষ্টান্ত দিই, যেখানে অন্তর্বাসী সত্তাকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কবি—

‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে

একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-’পরে—

প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।’

অন্তর-সম্পদই মানুষকে মহৎ করে। আর অন্ধ ধর্মাচরণে ব্যক্তি হয়ে পড়ে অহংপ্রবণ। যেমন আমরা দেখেছি কাব্যনাট্য ‘বিসর্জনে’ রঘুপতির আচরণে। অপরপক্ষে জয়সিংহ মানবিক বিশ্বাসে স্থির থেকে প্রাণ দিয়ে প্রেমের ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করে। তখন রক্তপায়ী দেবী মুর্তিকে পরিহার করে মহৎ মানব-আত্মাকেই পুষ্পার্ঘ্য দেন কবি। ঘোষণা করেন, প্রেমধর্ম দীক্ষিত মানুষই আকাঙ্ক্ষিত মনুষ্যত্বের ধারক। যে কোনও মাঝ সমুদ্রের গভীরতায় ঘন ঘন ডুব দিতে পারে সেই যার কোনো ডাঙ্গার মায়া নেই। গভীরতার অমৃত রস সেই পাবে যার প্রতি মূহুর্তে নিশ্চিন্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে বিপদ জেনেও। আপনারা যারা সবাই মনীষীদের অমৃত রসের বাণী শোনাচ্ছেন এরা কেউই পাড়ের খেলোয়াড় নয়। সুতরাং আপনি যতই পড়ুন এর উপলব্ধির কাছে যেতে পারবেন না। সবই অর্জন করতে হয়। আপনারা শুধু বিকৃত করবেন হয়তো সচেতন ভাবে কিংবা না জেনে। ক্ষমতা ও নির্বাচনের স্বার্থে।

অন্যদিকে ধর্ম বিষয়ে ‌বিবেকানন্দের কথায় ধর্ম বাক্যাড়ম্বর নহে, অথবা মতবাদবিশেষ নহে, অথবা সাম্প্রদায়িকতা নহে। সম্প্রদায়ে বা সমিতির মধ্যে ধর্ম আবদ্ধ থাকিতে পারে না। ধর্ম আত্মার সহিত পরমাত্মার সম্বন্ধ লইয়া। ধর্ম কিরূপে সমিতিতে পরিণত হইবে?‌ ‌কতকগুলি ভোটের সংখ্যাধিক্য হইলেই কি মানুষ অধিক ধার্মিক হইবে, অথবা উহার সংখ্যাল্পতায় কম ধার্মিক হইবে?‌ মন্দির বা চার্চ–নির্মাণ অথবা সমবেত উপাসনায় ধর্ম হয় না, কোন গ্রন্থে, বচনে, অনুষ্ঠানে বা সমিতিতেও ধর্ম পাওয়া যায় না। আসল কথা— অপরোক্ষানুভূতি। ধর্ম অনুরাগে, বাহ্য অনুষ্ঠানে নহে। হৃদয়ের পবিত্র ও অকপট প্রেমেই ধর্ম।

বিবেকানন্দের প্রচারিত হিন্দুত্বের সঙ্গে আজকালকার স্বঘোষিত হিন্দুত্ববাদী নেতাদের হিন্দুত্বের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বিবেকানন্দ দেখেছিলেন হিন্দু, মুসলমান, মুচি, মেথরদের নিয়ে এক গৌরবময় ভারতের স্বপ্ন। তিনি বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহের সমন্বয়ে এক মহান ভারত গড়ার কথা বলে গেছেন। শুধু তা-ই নয়, বিবেকানন্দ প্রথম কুমারীপুজো করেছিলেন মুসলিম মহিলাকে। এখানেই এ-সব কিছু থেকে সহজেই বোঝা যায়, বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব ছিল মানবতাবাদী হিন্দুত্ব, তার সঙ্গে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের মিল নেই। বা অন্য ভাষায় আধ্যাতিক মানবতাবাদও বিশ্বজনীন ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিপূরক। একদিন সবাই বিবেকময় (মনীষীদের জন্মদিন) বাকি দিন বিবেকহীন। কি অদ্ভুত সময়ে আমরা আছি।

জয় গুরু। ডুব ডুব ডুব রূপ সাগরে আমার মন, তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেম রত্ন ধন। খুঁজ খুঁজ খুঁজ খুঁজলে পাবি হৃদয় মাঝে বৃন্দাবন, দীপ দীপ দীপ ঞ্জানের বাতি জ্বলবে হৃদে অনুক্ষণ।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটে। জাতীয় জীবনের এই পটভূমিতে রাজা রামমােহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ মনীষীগণ এক যুক্তিনিষ্ঠ মুক্ত বুদ্ধির চেতনা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তাদের মননধর্মী ধর্মচেতনা সর্বত্রগামী হয়নি। সমাজের উচ্চ সংস্কৃতিসম্পন্ন শিক্ষিত মহলেই তা আলােড়ন তুলেছিল—এনেছিল নবজাগরণের জোয়ার। সমাজের নিম্নস্তরের জীবন ছিল একই জায়গায় আবদ্ধ। এই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হয় ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে। যুক্তিবাদী একেশ্বরবাদের বিশ্বজনীনতা নয়, আচার সর্বস্ব, জাত-পাতের ভেদাভেদে জীর্ণ পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের বৈদান্তিক রূপকে স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলেন। আমেরিকার চিকাগােয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে (১৮৯৩) হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে নিজ পরিচয় দিতে উঠে বলেছিলেন, “যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমত সহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিতেছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই স্বীকার করি।” হিন্দু ধর্মের আপামর জনসাধারণ ও ধর্মপ্রবক্তাদের মতামত যাই হােক না কেন স্বামী বিবেকানন্দের হৃদয়ের এই আন্তরিক প্রকাশ সন্দেহাতীত।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, চিকাগােয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যােগদানকারী ভারতীয় হিন্দু হিসেবে বিবেকানন্দই কিন্তু একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন না। জন হেনরি বুরাে সম্পাদিত ১৬০০ পৃষ্ঠার দুখণ্ডে সম্পূর্ণ ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস পার্লামেন্ট অফ রিলিজিয়ানস্’ নামক ওই ধর্মসভার বিষয়ে সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থটিতে দেখা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থাৎ সিংহল সহ মূল ভারত ভূখণ্ড থেকে মােট ২০ জন গিয়ে ছিলেন ওই ধর্মর্সভাতে যােগ দিতে। ওই গ্রন্থের প্রতিবেদন অনুসারে যাঁর বক্তব্য শ্ৰোতামণ্ডলীতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ জাগিয়েছিল তার নাম সিংহল থেকে আগত এইচ ধর্মপাল। তিনি বলেছিলেন বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে, তার জন্য এই গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে ২৩ পৃষ্ঠা এবং শ্রোতামণ্ডলীদের কৌতুহল জাগানাের জন্যে গুরুত্ব দিয়ে বম্বের মণিলাল দ্বিবেদীকে ২০.৫ পৃষ্ঠা দেওয়া হয়েছে, তার বক্তব্যের বিষয় ছিল হিন্দুধর্ম— “Hinduism is a wide term, but at the same time a vague term’ বলে শুরু হয়েছিল তার ভাষণ; মণিলাল দ্বিবেদীর পরে যে ভারতীয়ের ভাষণ সাড়া ফেলেছিল তার নাম প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, তিনি গিয়েছিলেন কলকাতা থেকে, তার বিষয় ছিল ব্রাহ্মধর্ম, তিনি এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছেন ১৯ পৃষ্ঠা জুড়ে এবং সনাতন ধর্ম সম্বন্ধে ভাষণদাতা স্বামী বিবেকানন্দ এই গ্রন্থে ১৫ পৃষ্ঠাব্যাপী স্থান পেয়েছেন।

যেসব পত্রিকাতে ওই ধর্মসভার প্রতিদিনের কর্মসূচি ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হত সেগুলি ছিল—‘দ্য ডেইলি ইন্টার ওসান’, ‘দ্য চিকাগাে হেরাল্ড’, ‘নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন’ ও ‘দ্য নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড’। এইসব পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে মার্কিন বংশােদ্ভূত মুসলমান মহম্মদ আলেকজাণ্ডার ওয়েবের একাধিক বিবাহের পক্ষে সওয়াল যথেষ্ট উত্তেজনা ও বাকি বক্তব্য প্রচুর করতালি জাগিয়েছিল এবং অভিনব গেরুয়া সন্ন্যাসীবেশ পরিহিত তরুণ স্বামী বিবেকানন্দের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষক ও ‘ভগিনী’ বলে মার্কিন মহিলাদের প্রতি সম্ভাষণ মার্কিন নারীকুলকে বিশেষ অভিভূত করেছিল। স্বামীজীর সন্ন্যাসী পরিচয়টাই ছিল সকলের কাছে সবচেয়ে কৌতুহলােদ্দীপক ও আকর্ষণীয়। কী সুদর্শন কী সুবক্তা এই নবীন সন্ন্যাসী! একজন সন্ন্যাসীর বা ধর্মগুরুর কাছে আমাদের কী প্রত্যাশা ? অবশ্যই আধ্যাত্মিক উন্নতির পথনির্দেশ তথা ধর্মীয় শিক্ষা।

যাইহােক, সারাজীবন জাতিকে স্বামী বিবেকানন্দ অন্য ধর্মীয় মতবাদকে শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিতে দেখার শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। নিজ ধর্মের প্রতি অবিচল আস্থা, সুদৃঢ় বিশ্বাসই মানুষকে পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তােলে। দুঃখের বিষয়, স্বামীজীর এই শিক্ষার মর্ম আমরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হলাম কই? আজও আমরা পরধর্ম বিশেষ করে ইসলামকে একটা ‘বহিরাগত উৎপাত’ বলেই মনে করে থাকি। ইসলামের অসাধারণ বৈপ্লবিক গুরুত্ব আর তার বৃহত্তর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সম্বন্ধে আমাদের অধিকাংশেরই সামান্য ধারণাও নেই, তার সহৃদয় অনুশীলন তাে দূরের কথা। অথচ আমাদের কল্যাণের স্বার্থে এমন বিরূপ মনােভাবের অপনােদন জরুরী।

বিশ্বখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ও বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, “মহাপুরুষ মােহাম্মদের অনুশাসিত ইসলামের আকস্মিক উত্থান এবং নাটকীয় বিস্তৃতি মানবজাতির সভ্যতার ইতিহাসে একটা বিরাট চমকপ্রদ অধ্যায়। নিতান্ত নির্লিপ্ত ও নৈর্ব্যক্তিক মন নিয়ে মানব ইতিহাসের এই অধ্যায়টি পাঠ করলে দ্বন্দ্বসঙ্কুল বর্তমান ভারতের জন্য অনেক আশার আলাের সন্ধান পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক দিক থেকে এর অনুশীলনের মূল্য আপনার গুরুত্বেই অধিক; তাছাড়া একটা সাধারণ জ্ঞানানুসন্ধিৎসা নিয়ে পড়লেও যে কেউই এর থেকে প্রভুত উপকার লাভ করতে পারবে। কিন্তু ইসলাম ইতিহাসে তথা মানব সভ্যতার সংস্কৃতিতে কী দিয়েছে, তা বিশেষ করে ভারতীয় হিন্দুদের যথাযথভাবে জানা, পারস্পরিক বিদ্বেষ-বিষ জর্জরিত ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে একটা বিরাট আশার এবং অশেষ মঙ্গলেরই ইঙ্গিত দেয়।…

এ (ইসলামের বিজয়) যেন এক ভীষণ ঐন্দ্রজালিক কাণ্ড! কীভাবে আজগুবি ব্যাপার সম্ভব হল এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে গিয়ে ঐতিহাসিকেরা আজও হতভম্ব হয়ে যান। আজকে জগতের সত্যিকার শিক্ষিত লােকেরা ‘ইসলামের উত্থান শান্ত ও সহিষ্ণু লােকদের উপর গোঁড়ামির জয়’, এই ঘৃণ্য অভিমত পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ইসলামের এই বিজয় অভিযানের কারণ ছিল অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে লুকিয়ে। গ্রীস, রােম, পারস্য, চীন, এমনকী ভারতবর্ষেরও প্রাচীন সভ্যতায় ঘুণ ধরে যাওয়ায় বিপুল জনসাধারণ যে চরমতম দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হল তা থেকে বাঁচিয়ে ইসলাম এক আলাে ঝলকিত দেশের নির্দেশ তাদের দিতে পেরেছিল বলেই তার এই অসাধারণ বিস্তার সম্ভব হয়েছিল।”

বিশ্ব সংস্কৃতিতে ইসলামের অবদানের কথা তথা বিশ্ব ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে ইসলামের এই অনন্য জীবনীশক্তি সম্বন্ধে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন বলেই স্বামী বিবেকানন্দ ইসলামের গণতান্ত্রিক ও বলিষ্ঠ মনােবলের প্রশংসা করতেন। তিনি হিন্দু জাতির মধ্যে এই মনােবল সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ মহান ভারত গড়বার লক্ষ্যে ইসলামকে তাই যথাযােগ্য মর্যাদা না দিয়ে পারেননি। তাঁর লেখায় ও বক্তৃতায় ইসলাম, কোরান, মুসলমান ও মুসলিম সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রসঙ্গ বার বার এসেছে নানা আঙ্গিকে। যখনই তিনি ধর্মীয় আলােচনা করেছেন তখনই বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে ইসলাম প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। ইসলাম ধর্মের মহৎ গুণগুলি বারবার তিনি উল্লেখ করেছেন। বিশ্ব ইতিহাসে ইসলাম ও তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারক হজরত মােহাম্মদের (সঃ) স্থান এবং ভারতবর্ষে মুসলিম-শাসন সম্বন্ধে তিনি বহু কথা বলেছেন। ব্যক্তি জীবনেও বহু মুসলমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখেছেন : “স্বামীজীর লেখায় বা কথায় ইসলাম প্রসঙ্গ আপেক্ষিকভাবে মােটেই কম নয়। কিন্তু স্মরণ করিয়ে দেব, স্বামীজী মসীজীবী ছিলেন না বলে, যে কোন বিষয়ে রাশি রাশি লেখার প্রয়ােজন বােধ করতেন না। তাঁর রচনাবলী বলে পরিচিত বস্তুর বড় অংশ তার বক্তৃতা ও ঘরােয়া আলাপের নােট। বলাবাহুল্য এমন সংকলন সর্বাত্মক হতে পারে না। ঘরােয়া আলাপের ক্ষেত্রে নােট-লেখক তাঁর ব্যক্তিগত রুচি অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করে তাকে লিপিবদ্ধ করেছেন। সেকালের হিন্দুদের মুসলমান-ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল না বলে তারা স্বামীজী সে প্রসঙ্গ তুললেও, সেসব লিখে রাখার উৎসাহ দেখাননি, কিন্তু স্বামীজীর পাশ্চাত্য শিষ্যরা অপরপক্ষে ব্যাপকতর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি দেখতে সমর্থ ছিলেন বলে তাকে যথােচিত গুরুত্ব দিয়েছেন।

১৯২১-এর ৩০শে জানুয়ারী বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মােৎসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন গান্ধীজী। সেই উৎসবে গান্ধীজীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন খিলাফৎ আন্দোলনের প্রধান হােতা বিখ্যাত বিপ্লবী মাওলানা মহম্মদ আলি। গান্ধীজী স্বামীজীকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবার পর মাওলানা মহম্মদ আলি উচ্ছ্বসিত ভাষায় স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছিলেন। এতেই প্রমাণ হয় স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু সাধক পুরুষদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন বটে কিন্তু তার উদার ধর্ম দর্শনের প্রভাব তখনকার ভারতীয় মুসলমান সমাজে কম পরিব্যাপ্ত ছিল না। সেই জন্যই মাওলানা মহম্মদ আলির মত প্রখ্যাত মুসলমান নেতারা তাঁকে ভারতের অন্যতম নের্তৃস্থানীয় পুরুষ বলে স্বীকার করতেন।

এর প্রধান কারণ ছিল এই যে, স্বামী বিবেকানন্দ ইসলাম ধর্ম ও সাধারণভাবে মুসলমান সমাজকে ভারতের বাইরের কোনও বস্তু হিসাবে কখনও চিন্তা করতেন না। এ বিষয়ে স্বামীজী নিজের ধারণা পরিষ্কার করে বলেছিলেন : “যখনই কোনাে ব্যক্তি উঠিয়া বলে, আমার ধর্মই সত্য ধর্ম, আমার অবতারই একমাত্র সত্য অবতার, সে ব্যক্তির কথা কখনই ঠিক নহে, সে ধর্মের ‘ক’ পর্যন্ত জানে না। ধর্ম কেবল কথার কথা বা মতামত নহে অথবা অপরের সিদ্ধান্তে কেবল বুদ্ধির সায় দেওয়া নহে। ধর্মের অর্থ প্রাণে প্রাণে সত্য উপলব্ধি করা; ধর্মের অর্থ ঈশ্বরকে সাক্ষ্যভাবে স্পর্শ করা, প্রাণে অনুভব করা, উপলব্ধি করা যে, আমি আত্ম-স্বরূপ আর সেই অনন্ত পরমাত্মা এবং তাহার সকল অবতারের সহিত আমার একটা অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রহিয়াছে। …তােমরা সকল দেশের সকল যুগের ধর্মপ্রাণ মহান নরনারীগণকে চিনিতে শিখ আর ইহাও লক্ষ্য করিও বাস্তবিক তাহাদের পরস্পরের মধ্যে কোনাে পার্থক্য নাই।”

স্বামী বিবেকানন্দ ধর্ম-পুরুষদের এবং ধার্মিকদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। কাউকেই তিনি ছােট বা খাটো করে দেখেননি। ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে মানুষ ও মনুষ্যত্বকে হনন করার ঘাের বিরােধী ছিলেন তিনি। ‘ধর্ম’ নামক প্রবন্ধে তিনি সেই শ্রদ্ধাপূর্ণ কথা ব্যক্ত করেছেন : “বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে কখনও বিরােধ ছিল না, অথচ প্রত্যেক ধর্মই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কার্য-সাধন করিয়া গিয়াছে—সেইজন্যই এখানে প্রকৃত ধর্মভাব এখনও জাগ্রত।…সকল ধর্মে ভালাে ভালাে লােক আছে, এই কারণেই সেইসব ধর্ম লােকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়া থাকে, সুতরাং ধর্মকেই ঘৃণা করা উচিত নয়।” আসলে ধর্মের ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাগ নিয়ে বাড়াবাড়ি বা মাতামাতি না করে মূলত ‘দার্শনিক’ ভাগকে গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়েছেন বলেই স্বামীজী এমন সর্বধর্মসমন্বয়ী মানসিকতা পােষণ করতে পেরেছেন এবং এর ফলে পক্ষান্তরে তার প্রখর মানবপ্রেমী ও মানবতাবাদী মানসিকতার সুচারু প্রকাশ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

আজকের সঙ্কটের মুহূর্তে এই ভাবনা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি শেষে বললেন না বাইবেল না কোরান না বেদ, সবার সত্যের নির্যাস নিয়ে তৈরি হোক এক মানবিক সমাজ।

(www.theoffnews.com Hinduism Muslimism Rabindranath Vivekananda India)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours