দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
শুধু শান্তিনিকেতন কেন, গোটা বিশ্বের কাছে শঙ্খ ঘোষ এক সংস্কৃতির নাম, এমনটাই মত, শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক, আশ্রমিক থেকে বহু মানুষ যাঁরা শঙ্খ ঘোষকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে ফেলো হিসেবে আসেন শঙ্খ ঘোষ। তার কয়েক বছর পর তদানীন্তন উপাচার্য নিমাই সাধন বসুর আমন্ত্রণে বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্র ভবনের অধ্যক্ষ পদ অলঙ্কৃত করেন। বছর খানেক ছিলেন। থাকতেন উপাচার্যের ঘরের সামনে পূর্বপল্লির বাড়িতে। তার আগে অবশ্য রতনপল্লীর আওয়াগড় রাজাদের তৈরী করে দেওয়া বাড়িতে থাকতেন। বিশ্বভারতীর বাংলা অধ্যাপক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন, “শঙ্খ ঘোষ একটা অনুভুতি। এভাবে দু’কথায় বলা যায় না। বড় মাপের কবি, লেখক, রবীন্দ্র গবেষক, সবাই জানেন। কিন্তু তিনি এক কথায় আমাদের সংস্কৃতির নাম। চারিদিকে যখন রাজনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয় চূড়ান্ত রূপে, মানুষের মনুষ্যত্ব তলানিতে, সবাই একটা গতিতে, লক্ষ্য সিংহাসন, আত্মপরায়ন মানুষ, সেখানেই দৃঢ শঙ্খ ঘোষ। চিৎকার করে নয়, খুব ভিতর থেকে একটা প্রতিবাদ। আমাদের যে একটা উদার হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি যা পরস্পরকে স্পর্শ করে দেখা, বেঁধে রাখা, শুশ্রুষার মত, সেটা উধাও। একটা মানুষ সেটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন, তিনি শঙ্খ ঘোষ। রাজনীতির লোক ছিলেন না, বাম, ডান, অতীত বর্তমান শাসক ভেদাভেদ না করে যখন অন্তরাত্মা বলেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। সাম্প্রতিক কালে সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণতা যা আমরা বুঝতেই পারছি না, কতবড় সঙ্কটের মধ্যে আমরা পড়েছি। সাম্প্রদায়িকতা মানুষকে ছোট করে। এমন দুঃসময়ে তিনি ছিলেন আমাদের বট গাছ। ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, রবীন্দ্রত্তোর যুগে শঙ্খ ঘোষের মত এমন ব্যক্তিত্ব আর হয় নি”। মানবেন্দ্রবাবু জানান, শঙ্খ ঘোষের অতিথিপরায়নতার কথা। ২০১৮ সালের মে মাসে বাগমারি রোডে তাঁর বাড়িতে যাওয়া কালানুক্রমিক রবীন্দ্র রচনাবলীর কাজে। সেটাই শেষ সাক্ষাৎ। শিশুমনের অধিকারী ছিলেন তিনি। খাওয়ালেন লুচি তরকারি। ২০১৬-১৭ সালে গীতাঞ্জলী অডিটোরিয়ামের উদ্বোধনের তিনি এসেছিলেন। কি চমৎকার বক্তৃতা দেন। শান্তিনিকেতনে সেটাই ছিল তাঁর শেষ বক্তৃতা।
শান্তিনিকেতনের সীমান্তপল্লীর বাসিন্দা গীতিকণ্ঠ মজুমদার প্রায়ই শঙ্খ ঘোষের কাছে যেতেন। এদিন তিনি বলেন, শঙ্খ ঘোষের মূল্যবান কথা—‘সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়’। অথচ কি সহজ মানুষ ছিলেন তিনি, একমাত্র তাঁরাই বলতে পারেন যাঁরা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন। যাদবপুরে উনার ক্লাস করেছি। পরে শান্তিনিকেতনে আসেন। সাহিত্য ছাড়াও, সেই সুবাদে আমি প্রায় যেতাম, যখন তিনি শান্তিনিকেতনে থাকতেন। সেটা আশির দশকের শেষে। তেলেভাজা ভালোবাসতেন। গেলেই চপ আনাতেন। আমার ত্রৈমাসিক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারের প্রশ্নের উত্তর নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। কত নিরহঙ্কারী মানুষ ছিলেন!
জানা গেছে, একবার গবেষক হিসেবে রবীন্দ্রভবনে অজিতকুমার পোদ্দারের দৃশ্য-শ্রাব্য বিভাগটি দেখে খুব খুশি হন শঙ্খ ঘোষ। সেই বিভাগের ভিজিটার্স বুকে তিনি লেখেন, ‘নিষ্ঠা এবং শ্রদ্ধার, সঙ্গে অজিত পোদ্দার/ বানাতে চান খনি, দৃশ্য এবং ধ্বনির।”
বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেন বলেন, “বিশ্বভারতীর কালানুক্রমিক রবীন্দ্র রচনাবলীর প্রধান ছিলেন তিনি। বিভিন্ন ভুল-ত্রুটি শুধরে দিতেন শঙ্খবাবু। সপ্তম খণ্ড দেখে দেওয়ার মাঝেই চলে গেলেন। সেই কাজে কলকাতায় উনার সাক্ষাতের জন্য যেতাম। আমরা এক বিশ্বাসযোগ্য অভিভাবককে হারালাম।”
(www.theoffnews.com Shantiniketan Shankha Ghosh)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours