তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। ম্যাজিস্ট্রেট বললো তুমি গ্রামের মানুষকে উত্তেজিত করছো।উত্তরে হরিনাথ বললো আমার গ্রামের ওপর অত্যাচার হলে আমি কি বলতে পারবো না? একটাই অপরাধ আমি গান লিখি আর গান গাই। জানি আমার পাশে আজ কেউ নেই।
কে এই হরিনাথ মজুমদার? পড়ুন পুরো জীবনটা। বাংলা ও বাঙালির গর্ব।
হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যা হল পার করো আমায়। এই গানের রচয়িতার নাম কাঙাল হরিনাথ। কাঙাল হরিনাথ তথা হরিনাথ মজুমদার (জন্ম: ২২ জুলাই, ১৮৩৩ - মৃত্যু: ১৬ এপ্রিল, ১৮৯৬) বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত বাউল সঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি সর্বসমক্ষে ফকির চাঁদ বাউল নামেও পরিচিত ছিলেন। লালন ফকিরের অন্যতম শিষ্য যাকে লালন মাথায় করে রাখতেন। উনার জন্য কুষ্টিয়া জেলা (অবিভক্ত বাংলা, ব্রিটিশ ভারত)। পেশায় বাউল শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের নদীয়া জেলার কুমারখালি (বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা) জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোটবেলায় তার পিতা-মাতা লোকান্তরিত হন। তার পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার। বাল্যকালে কৃষ্ণনাথ মজুমদারের ইংরেজি স্কুলে কিছুদিন অধ্যায়ন করেন। কিন্তু অর্থাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষায় বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেননি। তবে সারাজীবন অবহেলিত গ্রামবাংলায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন তিনি। অতঃপর গোপাল কুণ্ডু, যাদব কুণ্ডু, গোপাল স্যান্যাল প্রমূখ বন্ধুদের সাহায্যে ১৩ জানুয়ারি, ১৮৫৫ সালে নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন হরিনাথ মজুমদার। এরপর বেশ কিছুদিন ঐ বিদ্যালয়েই বিনাবেতনে শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তারই সহায়তায় ২৩ ডিসেম্বর, ১৮৫৬ সালে কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালিতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। এই সব বিদ্যালয় স্থাপনে বিদ্যাসাগর মহাশয় উনাকে যথেষ্ঠ সাহায্য করেছিলেন।অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ার স্বরূপ সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার। অল্পশিক্ষা নিয়েই তিনি দারিদ্র্য ও সচেতনতা বিষয়ক লেখনি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন। প্রথমে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন। প্রাচীন সংবাদপত্র হিসেবে বিবেচিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
পরবর্তীকালে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালি এলাকা থেকে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। মাসিক এ পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো। নিজগ্রামের লোকের উপর জোর-জুলুম, দুঃখ-অভাবের ঘটনা সাধারণের সামনে আনার উপলক্ষ্যে তিনি প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন কবি ঈশ্বরচন্দ্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ। কবির উপদেশে তার (কাঙাল) প্রবন্ধের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে প্রকাশ করা হতো। তারপর নিজ উদ্যোগে গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়ে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। তা ‘কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নর যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার-ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা।’ শেষে এক পয়সার সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এছাড়াও, কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণের কেচ্ছা-কাহিনীও প্রকাশিত হতো। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও দেশী জমিদারদের অব্যাহত হুমকিও তাকে এ-কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
নিঃস্ব কাঙ্গাল হরিনাথ সারাজীবনে সচ্ছলতার মুখ দেখতে না পেলেও ১৮৭৩ সালে কুমারখালির নিজ গ্রামেই গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮ বছর রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবী'র অর্থ আনুকূল্যে কাগজ চালানোর পর আর্থিক কারণে ও সরকারের মুদ্রণ শাসনের ব্যবস্থার জন্য পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে হয়।
আশৈশব জমিদার, মহাজন, কুঠিয়াল ও গোরা পল্টনের অত্যাচার ও উৎপীড়ন প্রত্যক্ষ করে হরিনাথের মনে যে প্রতিকার চিন্তা জাগে সেখান থেকেই তিনি সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রেরণা লাভ করেন। দীর্ঘ আঠারো বছর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা সম্পাদনা করার পর সাংবাদিকতা পেশা পরিত্যাগ পূর্বক ধর্ম সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। হরিনাথ মজুমদার আধ্যাত্মিক গুরু ও মহান সাধক ফকির লালনের গানের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। ধর্মভাব প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে তিনি নিজস্ব একটি বাউল সঙ্গীতের দল প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি কাঙ্গাল ফকির চাঁদের দল নামে পরিচিতি ছিল।
হরিনাথের স্বরচিত গানগুলোও আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর ছিল। গান রচনায় তিনি অসম্ভব পারদর্শিতা ও পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন। স্বলিখিত গানে কাঙ্গাল ভণিতার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ছিল। তাঁর রচিত বাউল সঙ্গীতগুলো ফকির চাঁদের বাউল সঙ্গীত নামে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। ধর্ম সাধনার অঙ্গরূপে তিনি বহু সহজ-সুরের গান রচনা করে সদলবলে সেই গান গেয়ে বেড়াতেন। হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হ'ল গানটি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। গানটির প্রথম চার চরণ নিম্নরূপ :-
হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পাড় কর আমারে।
এই গানটি সত্যজিৎ রায় তাঁর পথের পাঁচালিতে ব্যবহার করেছিলেন।
তুমি পাড়ের কর্তা জেনে বার্ত্তা তাই ডাকি তোমারে।
আমি আগে এসে ঘাটে রইলাম বসে।
যারা পরে এল আগে গেল আমি রইলাম পরে।
হরিনাথ মজুমদার ওরফে ফিকির চাঁদ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ, সমকালীন। হলে কি হবে হরিনাথ মজুমদারের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। কথিত আছে, সম্পর্ক এতটাই অবনতি হয়েছিল যে ঠাকুর পরিবার হরিনাথ মজুমদারকে তাঁর কুঠিবাড়িতে ধরে নেওয়ার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়েছিলেন।
সুফি বাউল লালন শাহ সে সময় লাঠিয়াল বাহিনী প্রতিহত করে শিষ্য হরিনাথ মজুমদারকে নিরাপদ করেছিলেন। শুধু একবার নিরাপদ করে শান্ত হননি। সাঁইজি দিনের পর দিন লোকজন নিয়ে পাহাড়া দিতেন হরিনাথ মজুমদারের বাড়ি।
নীলকরদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপোষহীন। সব ধরনের বাধা উপেক্ষা করে তিনি কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণ ও নিপীড়নের কাহিনী নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেন। ১৮৭৩ সালের পাবনার কৃষক বিদ্রোহের স্বপক্ষেও তিনি সরব ও সোচ্চার কণ্ঠস্বর ছিলেন।
প্রখ্যাত লেখক, গবেষক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ঠাকুর পরিবারের ‘জমিদারি নির্যাতন’-এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন কাঙাল হরিনাথ‚ বিস্মৃত এই সাংবাদিকই লিখেছিলেন ‘দিন তো গেল‚ সন্ধ্যা হল…’। তিনি ক্ষোভের সাথে আরো বলছেন, ‘তাঁর নাম কাঙাল হরিনাথ। তাঁকে আজকের বাঙালি চেনে না। আমাদের লজ্জা যে আমরা তাঁকে মনে রাখিনি। তিনি কিন্তু ভালবাসার মতো মানুষ। আর তিনি আমাদের বুকের কান্নাকে স্পর্শ করার মতো ও মানুষ। তাঁর জন্যে চোখের জল পড়ে বলেই তো গ্রাম বাংলার সেই প্রথম নায়ককে ভালবাসি।’ গবেষক অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী বলছেন, ‘তাঁর ভাগ্যদেবতা তাঁকে সকল রকমে কাঙাল করেছিলেন জীবনের শেষ পর্বে। তাই বোধহয় পারমার্থিক গান রচনা করে তাতে ভণিতা দিয়েছিলেন কাঙাল নামে। আশ্চর্য ও অনবদমিত এক মানবসত্তা এই কাঙাল হরিনাথ।’ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আরো লিখছেন, 'কাঙাল হরিনাথ মারা গেলেন ১৮৯৬ – এর ১৬ এপ্রিল। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ৫ বৈশাখ। তাঁর বয়েস তেষট্টি। কুমারখালির কাঙাল কুটিরেই মারা যান তিনি — তখন এক নিঃস্ব সন্ন্যাসী। কেউ তাঁর পাশে নেই। যে মানুষদের ওপর জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই‚ তারাও পাশে দাঁড়ায়নি- ভয়ে! বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর ‘গ্রামবার্তা’ সংবাদপত্র‚ অর্থের অভাবে। তিনি নিঃসঙ্গ‚ নির্লিপ্ত‚ উদাসীন এক বাউল‚ তাঁর শেষ জীবনে। আর তখনও ‘কাঙাল’! কিন্তু এক অদ্বিতীয় নায়ক!’
যদি ডাকার মতো পারিতাম ডাকতে, তবে কি মা এমন করে তুমি লুকিয়ে থাকতে পারতে- গানটি একসময় বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে শোনা যেত। এখন গানটি কেউ কি মনে করেন বা গানের রচয়িতা ফিকির চাঁদকে?
হরিনাথ ছিলেন ফকির লালন শাহর শিষ্য। তিনি অধ্যাত্মবাদ প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে ‘কাঙাল ফিকির চাঁদের দল’ নামে একটি বাউল দল গঠন করেন। বাউল গানের ক্ষেত্রে হরিনাথের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি বহুসংখ্যক বাউল গান রচনা করেন এবং সেগুলি খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি সহজ ভাষায় ও সহজ সুরে গভীর ভাবোদ্দীপক গান রচনা করতেন এবং সেগুলি সদলে গেয়ে বেড়াতেন। গানে ‘কাঙাল’ নামে ভণিতা করতেন বলে এক সময় কাঙাল শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১২৯০-১৩০০ বঙ্গাব্দের মধ্যে তিনি কাঙাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী নামে ১৬ খন্ডে বাউল সঙ্গীত প্রকাশ করেন। হরিনাথ শুধু গানেই নয়, গদ্য ও পদ্য রচনায়ও পারদর্শী ছিলেন।
সাহিত্যচর্চায় হরিনাথের শিষ্যদের মধ্যে অক্ষয়কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্রনাথ রায় এবং জলধর সেন পরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। হরিনাথের মোট গ্রন্থ ১৮টি। তন্মধ্যে উলেখযোগ্য কয়েকটি হলো: বিজয়বসন্ত (১৮৫৯), চারুচরিত্র (১৮৬৩), কবিতাকৌমুদী (১৮৬৬), বিজয়া (১৮৬৯), কবিকল্প (১৮৭০), অক্রূর সংবাদ (১৮৭৩), সাবিত্রী নাটিকা (১৮৭৪), চিত্তচপলা (১৮৭৬), কাঙালের ব্রহ্মান্ডবেদ (১৮৮৭-৯৫), মাতৃমহিমা (১৮৯৬) ইত্যাদি। মৃত্যুর পর তাঁর রচনাসমগ্র হরিনাথ গ্রন্থাবলী (১৯০১) নামে প্রকাশিত হয়।
কাঙাল হরিনাথের শেষ ইচ্ছে ছিল তাকে পুরোপুরি দাহ্য করা যেন না হয়। তার ইচ্ছে অনুযায়ী তার হাতের কনিষ্ঠা, মাথার খুলি আর বাম পায়ের বুড়ো আঙুলসহ দাহ শেষে ছাইভস্ম তার নিজের পূজার ঘরে সমাহিত করা হয়।
কাঙাল রচিত সঙ্গীতের সঠিক সংখ্যা সম্ভবত এখনও নিরূপিত হয়নি। কেননা ‘কাঙাল ফিকির চাঁদের বাউলসঙ্গীত’ গ্রন্থের নিবেদন অংশে রায় হরিনাথের জীবনীকার জলধর উল্লেখ করেছেন, ‘কাঙালের অসংখ্য গীতের মধ্যে অল্প কয়েকটিই এই গ্রন্থে দিতে পারিলাম; যদি কখনো সময় হয়, আর আমি যদি ততদিন বাঁচিয়া থাকি তবে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের চেষ্টা করিব।’
আজ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক অতিক্রমের পর সমগ্র উপমহাদেশসহ পৃথিবী ব্যাপী এক নিদারুণ সাম্প্রদায়িক বিষবাস্পের মুখোমুখি। ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান বারবার আমরা প্রত্যক্ষ করছি তাতে করে উদ্বেগের কারণ ক্রমবর্ধমান। প্রতিবাদ ও মুক্তচিন্তার অনুশীলনের উপর যে ধরনের নগ্ন আক্রমণ বিনিয়ন্ত্রণের কারণে শাখা বিস্তার করছে, তার পরিণতিতে ক্রমশই এক অভূতপূর্ব অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে। এসময় আমাদের প্রয়োজন নতুন এক হরিনাথ মজুমদারের, কাঙাল হরিনাথের। যিনি অন্ধকারে প্রজ্বলন করবেন আলোর মশাল, কলমে ছড়াবেন সত্যের দূত্যি।
(www.theoffnews.com - Harinath Majumder)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours