তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর স্মরণে একটি সভা হয় রামমোহন মঞ্চে। ওইখানে রবীন্দ্রনাথ একটি দীর্ঘ কবিতা পাঠ করেছিলেন। ওই কবিতা শুনে নাট্যাচার্য্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী তাঁর এক বন্ধুকে বললেন, আমার জন্য যদি রবীন্দ্রনাথ এরকম একটা লিখে দেন তাহলে আমি মোটর গাড়ির তলায় চাপা পড়ে মরতে রাজি আছি। এই রামমোহন লাইব্রেরী রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর এইখানেই তিনি সংবর্ধনা নিতে রাজি হয়েছিলেন। যাই হোক রবীন্দ্রনাথ ও শিশির ভাদুড়ীর সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে শিশির ভাদুড়ী ছিলেন 'রঙ্গমঞ্চের পিতা'। তাঁর আবির্ভাবকে অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি। মৃত্যুর আগে তাঁর সাথে যখন ওনার শেষ দেখা হয় তখন তিনি শিশিরকুমারকে বলেছিলেন, 'শিশির আমার বইগুলো তুমি অন্তত একবার করো, নিদেনপক্ষে  রক্তকরবী আর মুক্তধারা।' কিন্তু দুঃখের বিষয় এই দুটির কোনটাই শেষপর্যন্ত তিনি করে উঠতে পারেননি। রক্তকরবী করার জন্য একসময় প্রায় সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ন হয়েছিল শিশিরকুমারের থিয়েটারে। কিন্তু নন্দিনী পছন্দ হয় না রবীন্দ্রনাথের। প্রভাদেবী এবং আরও যাঁরা ছিলেন সবাই মোটা হয়ে গেছে তখন। রবীন্দ্রনাথ কেবলই বলেন মোটা মেয়ে নিয়ে নন্দিনী হবে না হঠাৎই কী মনে হলো বিশ্বনাথ ভাদুড়ীকে ধরলেন । বললেন 'এই তো একে দিয়ে চমৎকার নন্দিনী হয়'। শিশিরবাবু যত বলেন বাংলার পেশাদার থিয়েটারে এসব হয় না কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নাছোড়বান্দা। শেক্সপীয়ারের যুগে, বার্বেজের যুগে সম্ভব হলে এখনও সম্ভব বলে মনে করতেন তিনি। দেশ বিদেশের নাট্যাভিনয়ের ইতিহাস টেনে এনে বলতেন 'স্ত্রী ভূমিকা স্ত্রীলোক দিয়েই করাইতে হইবে এ ধারনা স্থূল। এইরূপ বিলাতী বর্বরতা পরিহারের সময় আসিয়াছে।' নন্দিনী সমস্যা না মেটায় রক্তকরবীর পরিকল্পনা স্থগিত থাকে।

শিশিরকুমার যদিও মাঝে মাঝেই রক্তকরবী-র পরিকল্পনা করতেন। রক্তকরবীতে লাল আলো  ব্যবহারের ইচ্ছে যেমন ছিল তাঁর তেমনই রক্তকরবীর কোনও একটা সাজেশন রাখার ইচ্ছে ছিল তাঁর। রাজা-র ভূমিকায় অভিনয় করতেন নিজে, যদি শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়। আর রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, "মুক্তধারা"য় উনি ধনঞ্জয় বৈরাগী অভিনয় করেন। তাতে শিশিরবাবু বলেছিলেন, "গুরুদেব, আমি তো গান জানি না, গাইবো কী করে?" রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারকে উত্তর দিয়েছিলেন "তুমি যদি আমার ধনঞ্জয় করো, তাহলে গাইতে হবে না ---তুমি আবৃত্তি করে বলে দিও, তাহলেই হবে। দরকারে হয়তো একটু -আধটু বদলে নিও।" এই প্রয়োজন মতো পরিবর্তনের স্বাধীনতা রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারকে দিয়েছেন প্রচুর। শিশিরকুমার বলতেন "শরৎদার (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ) এসব বিষয়ে বাছবিচার ছিল খুব বেশি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত উদার।" 'সীতা' দেখার পর তিনি শিশিরকুমারকে বলেছিলেন, 'ওটি কোনও নাটকই নয়' এবং নিজে ওনার জন্য নাটক লিখে দেবেন এমনটাও বলেছিলেন, সেইমতো 'চিরকুমার সভা' শিশিরকুমারের জন্য লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ অসুস্হ হয়েছিলেন। 

শিশিরবাবুও যোগাযোগ করেননি রোগশয্যায় । কিন্তু সেই সময়ই আর্ট থিয়েটার নাটক চাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ তাদের একটি নাটক দিয়ে দেন। যদিও তিনি সুস্থ হওয়ার পর শিশিরকুমার তাঁর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, 'শিশির তুমি আগে এলে না কেন? তুমি আমার নাটক করো'। রবীন্দ্রনাথ এবার তাঁকে দিলেন 'গোড়ায় গলদ'। শিশিরবাবুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এতটাই সুমধুর ছিল যে কিছু কিছু জায়গা শিশিরের পছন্দ না হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ রাত জেগে তা বদল করেন। পরেরদিন সকালে পান্ডুলিপি তাঁর হাতে দিয়ে বলেন, 'যা করার করেছি, দরকার হলে তুমি বদলে নিও। দাঁড়াও। পান্ডুলিপিটা দাও তো, নামটা বদলে দিই।' অবাক হয়ে শিশির কুমার বললেন, 'সেকি! নাম বদলাবেন কেন? ওই নামে তো বিজ্ঞাপন হয়ে গেছে'। কবি বললেন, 'তা হোক। এর নাম দিলাম শেষ রক্ষা। গোড়ায় গলদ ছিল ঠিকই, কিন্তু শেষ রক্ষা তো হলো।'

রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই শিশিরবাবুকে বলতেন, 'পেশাদার থিয়েটার অন্য লোক চালাবে। তুমি একদল ছেলেমেয়ে নেবে, একটা আলাদা স্টেজ থাকবে আর সেখানে তুমি এক্সপেরিমেন্ট করবে'। আবার রবীন্দ্রনাথের অভিনয় প্রসঙ্গে শিশিরবাবু বলতেন , 'He was a great actor, no doubt a great actor. কিন্তু লিমিটেশন ছিল । দেহকে গোপন করতে জানতেন না যখনই কোনো ইমোশনের প্রকাশ থাকতো "রবীন্দ্রনাথ" তাঁর মাঝ দিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। গলার আওয়াজ ছিল সুন্দর। তবে যৌবনে সুরেলা অভিনয় করতেন। পরে সে দোষ কেটে যায়'।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিশির কুমারের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ন ও স্নেহের। দুজনেই দুজনের প্রশংসা যেমন করেছেন সমালোচনাও করেছেন কখনো কখনো। শিশিরকুমারকে 'নাট্যাচার্য'  উপাধি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই প্রদান করেন।

(www.theoffnews.com - Rabindranath Shishir Bhaduri)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours