তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
ধূর্জটি ধাম হলো স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। ধূর্জটি ধাম ঠিক বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশনের কাছে।বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশনের অটো স্ট্যান্ডের পাস দিয়ে যে রাস্তাটি গেছে, একটু এগুলেই চোখে পড়বে বনেদি কলকাতার ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য কলার একটি সুন্দর নিদর্শন। নাম ধূর্জটি ধাম। বাড়িটি খুব বেশি পুরোনো নয়।
কলকাতার মার্টিন বার্ন বিংশ শতকের গোড়ায় বাড়িটি তৈরি করেন। বাড়িটির বর্তমান মালিক শৈলেন্দ্রনাথ মল্লিকের কন্যা স্বপ্না সেনগুপ্ত। এই বংশের পরিচয় সমন্ধে যা জানা যায় তা হলো, তাঁরা প্রবাদ পুরুষ গৌরী সেনের বংশ ধর। বাড়িটির প্রতিষ্ঠাতা নারায়ন কৃষ্ণ সেন। এই বংশের আদি ইতিহাস পাওয়া যায় সুধীর কুমার মিত্রের হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গ সমাজ বইতে। হুগলির বালি অঞ্চলে গৌরী সেনের আদি বাড়ি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বনেদি কলকাতার ঘর বাড়ির লেখক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ধূর্জটি ধামের তৎকালীন (২০০২) মালিক শৈলেন্দ্রনাথ মল্লিকের সাথে কথা বলে জানতে পারেন নারায়ন কৃষ্ণ সেনের পূর্বপুরুষ রামনাথ সেন বাংলা ১৩১১ সালে তাঁদের একটি বংশতালিকা প্রস্তুত করেন। অবাক কথা এই বংশ তালিকায় গৌরী সেনের নাম পাওয়া যায়নি।
"লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন" এই প্রবাদ যাঁর নামের সাথে যুক্ত তাঁর সমন্ধে তথ্যের বড়ই অভাব। নারায়ন সেনের মৃত্যুর পরেই গৌরী সেনের বংশ পরিচয় লুপ্ত হয়ে গেছে। নারায়ণ কৃষ্ণের ছোট ভাই প্রিয়লালের বাড়িটি ছিল ধূর্জটি ধামের পাশে। আবার সেই বাড়িটিও বিক্রি হয়ে গেছে। এখন ওই বাড়িতে মেডিকেল ছাত্রদের হোস্টেল আছে। ওই বাড়িটির পুরোনো স্থাপত্য কলার আর একটি সুন্দর নিদর্শন। এখন ধূর্জটি ধামে যিনি বাস করেন তিনি গৌরী সেনের কন্যা তরফে বংশধর বলে দাবি করেন।
এই ধূর্জটি ধাম নাকি গৌরী সেনের শেষ বংশধরের শেষ বসত বাটি। ধূর্জটি ধামে গিয়ে জানা যায় উনি শিবের উপাসক ছিলেন। বাড়ির কাছেই দৃশনন্দন শিব মন্দির আছে। এই গৌরী সেনের কলকাতায় প্রায় ২০০ বাড়ি ছিল।
নারায়ন কৃষ্ণ সেন মারা যান ১৯৩৫ সালে। সিনেমার শুটিংয়ের জন্য এই বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়। বাড়িটির প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে বাড়ির ভিতরে ঢুকলে বোঝা যায় কত উঁচু দরের স্থাপত্য ছিল। এইখানে পিকক রুম আছে, মানে ময়ূর থাকার ঘর। ওই ঘর সংলগ্ন পূর্ব ও পশ্চিম দিকের কাঁচ বসানো দুটি ঘর দিয়ে আলো এসে পড়তো সিঁড়ির ওপর। আলো যে রঙের কাঁচের উপর পড়তো সেই রঙে সিঁড়ি আলোকিত হতো। অর্থাৎ সেই সময়ে রোদকে লাইটিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হতো। সত্যি কি শৈল্পিক ভাবনা। সিঁড়ির পাশের দেয়ালের ঠিক মাঝখানে ছিল নারায়ন কৃষ্ণের এক বিশাল তৈল চিত্র। সুশোভিত বারান্দার ওপর বসানো আছে শ্বেত পাথরের হাতি ও কাঠের ভাল্লুক। ভিতরে আছে নাচ ঘর, বৈঠকখানা ঘর আর ওপরে বিশাল ঝাড়বাতি ঝুলছে। নারায়ন কৃষ্ণ ছিলেন সৌখিন মানুষ। আর আছে অসংখ রুপার ও তামার মিনাকারী ফুলদানি, আর দেয়ালগুলো ওয়াল পেন্টিংয়ে ভর্তি। কাট গ্লাসের কাকাতুয়া মনিমুক্তা খচিত ময়ূর শোভিত বাতিদান যা ঊনবিংশ শতাব্দীর বনেদীআনাকে প্রতিফলিত করতো। এই বাতিদানগুলি ঘরের বিভিন্ন কোনে সাজিয়ে রাখা হতো।
প্রতিটি ঘরে ভিক্টরিয়ান গদি মোড়া চেয়ার। দরজা পেরোলেই দেখা যাবে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের আবক্ষ পাথরের মূর্তি। ভবনটিতে তিনটি সিঁড়ি। প্রথমটি সিমেন্টের দ্বিতীয়টি লোহার আর তৃতীয়টি শ্বেত পাথরের ঝুলন্ত সিঁড়ি। এই মহলের ঘরের প্রত্যেকটি দরজার বেলজিয়াম কাঁচের ইতালিয়ান হরফে লেখা এনকেএস মানে নারায়ন কৃষ্ণ সেন।পূর্ণেন্দু পত্রীর স্ত্রীর পত্র চলচিত্রের প্রায় পুরোটাই এখানে শুটিং করা হয়। ঘরের মাঝখানে চৌকো বড় উঠোন যেখানে প্রায়শই নাটক ও যাত্রা অনুষ্ঠিত হতো। সত্যজিৎ রায় থেকে পূর্ণেন্দু পত্রী, জহর গাঙ্গুলী, ছবি বিশ্বাস এমন কি হাল আমলের ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এই বাড়িটির প্রেমে পড়ে গিয়েছেন। নারায়ন কৃষ্ণ সেনের পিতামহ ছিলেন মদনমোহন সেন, উনি বেঙ্গল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। তবে এই সব পরিচয় নিয়েও বিতর্ক আছে। শেষ বিচারে বেলগাছিয়ার ধূর্জটি ভবনের গঠন শৈলি দেখলেই বোঝা যায় এই বাড়িটির অতীত বনেদিয়ানা। এই ২৬ বেলগাছিয়া রোডের ওপর ধূর্জটি ধাম দেখলে মনে হয় যেন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জীবন্ত ঊনবিংশ শতাব্দী।
২০০৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যোগেন চৌধুরী, বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, গণেশ হালুই প্রমুখ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গের উপস্থিতে প্রাসাদ অলিন্দের এক অনুষ্ঠানে পাইকপাড়ার অন্তর্গত বেলগাছিয়া ধূর্জটি ধামকে ঐতিহ্যশালী ভবন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নারায়ন কৃষ্ণ সেনের দৈহিত্ৰ শৈলেন মল্লিকের হাতে ঘোষণা পত্রটি তুলে দেওয়া হয়। এই ভবন বা ধামটি অধিগ্রহনের চেষ্টা চলছিল বিধান রায়ের আমল থেকে কিন্তু রাজ্য সরকার নানা কারণে উৎসাহ দেখায়নি। এক কথায় এই ধূর্জটি ধাম হলো ইউরোপীয় ,ইসলামি স্থাপত্য শিল্প আর তাঁর মিশে আছে বাঙালিয়ানা।
গৌরী সেনের নাম মনে এলেই বন্ধুদের আড্ডায়, গরিবের আক্ষেপ মেটাতে, ধনীর বিলাসিতায় প্রায়ই শোনা যায় একটি বাক্য- ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’। এটি প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অনেকেই জানেন না- কে এই গৌরী সেন? তিনি কি পুরুষ, না মহিলা- এ নিয়েও আছে বিতর্ক। এই নামে সত্যি কি কেউ ছিলেন? নাকি এটি কাল্পনিক চরিত্র?
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, প্রবাদপ্রতিম গৌরী কিন্তু কোনো মহিলার নাম নয়। ‘বাংলা প্রবাদের গঠন ও উৎসকথা’ গ্রন্থে কমল কুমার পাল লিখেছেন: ‘গৌরী সেন, যার মূল নাম গৌরীকান্ত সেন। সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী তিনি। ১৫৮০ সালে হুগলিতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম নন্দরাম সেন। থাকতেন ৩৫ নম্বর কলুটোলা স্ট্রীটে। তাঁর আদি নিবাস সম্পর্কে দুটি ভিন্ন মত আছে। অধিক গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী তিনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বালি শহরের মানুষ। যা বর্তমানে হাওড়া জেলার অন্তর্গত। অন্য মত অনুযায়ী তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের মানুষ।’
এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা- ৯: প্রবাদ-প্রবচন’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, গৌরী সেন হরেকৃষ্ণ মুরলীধর সেনের পুত্র। আমদানী-রপ্তানীর পারিবারিক ব্যবসায় গৌরী সেন অনেক টাকা উপার্জন করে বণিকসমাজে প্রসিদ্ধ হন। দু-হাতে টাকা বিলিয়ে অনেক লোককে তিনি ঋণমুক্ত করেন অথবা বকেয়া রাজকর মেটাতে সাহায্য করেন। কেউ চাইলেই তিনি টাকা দিতেন। এ থেকেই ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন’ প্রবাদের জন্ম। সেকালে দেনার দায়ে কারও জেল হলে ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তারা মুক্তি পেতেন না। অনেকের জেলেই মৃত্যু হতো। এ অবস্থায় গৌরী সেন ছিলেন তাদের ত্রাণকর্তা। তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে তিনি অনেকের ঋণের টাকা পরিশোধ করে কারামুক্তির ব্যবস্থা করতেন। কলকাতার আহিরিটোলায় গৌরী সেনের বিশাল বাড়ি ছিল বলে জনশ্রুতি আছে।
সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘বাংলা প্রবাদ ও প্রবচন’ গ্রন্থে গৌরী সেনের ইতিহাসে লেখা হয়েছে, তাদের পারিবারিক ব্যবসা জাহাজে মাল আমদানী-রপ্তানি করে অল্প বয়েসেই গৌরী সেন ব্যবসায়ী মহলে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব চরণ শেঠের ব্যবসার অংশীদার। তারা দুজনে মিলে একবার ডুবে যাওয়া জাহাজের দস্তা নিলামে কেনেন। পরে দেখা যায় আসলে দস্তার নিচে রুপা লুকিয়ে পাচার করা হচ্ছিল। গৌরী সেন এই রুপা ঈশ্বরের কৃপা বলে গ্রহণ করেন। সবাই জানেন গৌরী সেনের দানের হাত দরাজ ছিল। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার জন্য তার দরজা ছিল অবারিত। শুধু তাই নয়, যে সব ব্যক্তি জমিদারদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারতেন না, তাদের তিনি অবাধে দান করতেন। এই জনহিতকর কাজের জন্য গৌরী সেন আজও লোকমুখে প্রচলিত প্রবাদের মধ্য দিয়ে অমর হয়ে রয়েছেন। ১৬৬৭ সালে প্রখ্যাত এই দানবীরের মৃত্যু হয়।
গৌরী সেন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ. কে. এম মাহবুবুল হক বলেন, ‘গৌরী সেন আসলে একটি রূপক চরিত্র। অনেক সময় সমাজের নানা দিক তুলে ধরার জন্য আমরা প্রবাদ প্রবচন বা রূপকথার কাউকে সামনে নিয়ে আসি। তবে যদি বাস্তবে কেউ থেকে থাকে, তা ছিল সেই সময়ের অপরিহার্য চরিত্র।’
১৮৫০ সালে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় তিনি এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধেই মেলে গৌরী সেনের কথা। জানা যায়, রাতারাতি বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন তিনি। আসলে গৌরী সেন ছিলেন বৈষ্ণবচরণ শেঠ নামে এক ভদ্রলোকের ব্যবসার অংশীদার। এই বৈষ্ণবচরণও এক আশ্চর্য মানুষ। সেকালের অন্যতম ধনী এই মানুষটি একবার গৌরী সেনের নামে কিছু দস্তা কিনলেন। পরে দেখা যায়, সেই দস্তায় মিশে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে রুপো! তা বৈষ্ণবচরণের মনে হল, গৌরী সেন অংশীদার ছিলেন বলেই অদ্ভুত ভাবে ধনলাভ করেছেন তিনি। তিনি গৌরী সেনকেই দিয়ে দিলেন সমস্ত লাভের অংশ! আর তার ফলেই রাতারাতি বিপুল ধনী হয়ে গৌরী সেন।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ বইতেও আমরা গৌরী সেনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে অল্পই। পড়া যাক— ‘কোম্পানির আমলে বহরমপুর নিবাসী স্বনামধন্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। কলিকাতার আহিরিটোলায় ইহার ভদ্রাসন এখনও বিদ্যমান আছে। দেনার দায়ে যাহারা জেলে যাইত এবং অর্থাভাবে যাহাদের উদ্ধারের আর উপায় থাকিত না তাহাদিগকে গৌরী সেন নিজের টাকায় ঋণমুক্ত করিয়া দিতেন। দাতাকর্ণের ন্যায় তাঁহারও নাম প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছে।’
(www.theoffnews.com - Gouri Sen Dhurjati Dham Narayan Krishna Sen)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours