পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
২০০৪ সাল। লাল মাটির দেশ বীরভূম তখন রাজনৈতিক ভাবেও লালে লাল। কংগ্রেস বা তৃণমূল একটু আধটু মাথা তুললেই থেঁতলে দেওয়া হচ্ছে তাদের ফনা। ছোট আঙারিয়া, নানুরে সূচপুরে গণহত্যা সে সবেরই নৃশংস উদাহরণ। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তো দূরের কথা বোলপুর তথা বীরভূমের মানুষই অনুব্রত মণ্ডলের নাম শোনেননি। যারা চেনেন তারা কেষ্টা বা কেষ্ট হিসেবেই চেনেন, কেষ্টদার যে এমন সুন্দর একটা বাপ মা প্রদত্ত নাম আছে তা বোধহয় কেষ্টদারও মনে নেই। এমন একটা পরিবেশে লোকসভা ভোট এল। বাম প্রার্থী ১৯৮৫ সাল থেকে বোলপুর কেন্দ্রে একটানা জিতে আসা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। এবারেও জেতা নিয়ে তেমন কোনও সংশয় নেই যার। তৃণমূলের প্রার্থী নির্মল মাজি, যাকে এখন চিকিৎসক নেতা হিসেবেই সকলে চেনেন। কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন ধনঞ্জয় সাহা, যাকে কংগ্রেসের লোকেরাও ভাল করে চিনতেন না। ই টিভির তখন দুর্দান্ত বাজার। প্রায়শই খবরে উঠে আসছে শাসক দলের নানা ব্যর্থতার কথা। অভাব অভিযোগ। স্থানীয় সাংসদ হিসেবে বেশ কয়েকবার সেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে সোমনাথ বাবুকেও। ফলে লাল দল ইটিভির বীরভূম জেলার দায়িত্বে থাকা আমার উপরে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না। থাকার কথাও নয়। ভোট কভার করতে গেলাম বোলপুরে।
আগে থেকেই বলা ছিল সোমনাথবাবুকে। বললেন বাড়িতেই চলে আসুন। গেলাম, যেতেই আপ্যায়ণ শরবৎ দিয়ে। চা খাব না শুনে লস্যি। তারপর লুচি তরকারি। ঠিক এতটা আশা করিনি। ঠিক ছিল একটু প্রচারের ছবি নেব, একটা কচি সাক্ষাৎকার ব্যাস তারপরে তৃণমূলের ওখানে। সোমনাথবাবু বললেন তা হয় নাকি। আমার কাছে আগে আসা মানে আমার অতিথি। আমার এই জামাই আদর স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্ব বা কর্মীরাও যে খুব ভাল ভাবে নিচ্ছিলেন না তা তাদের মুখ দেখেই বুঝেছি। কি আর করা, পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। তা সেই খানা খেতে খেতেই জিজ্ঞাসা করলেন আচ্ছা আমাদের কি কিছুই ভাল নেই। সবই তো খারাপ দেখান আমাদের, ভাল কাজ কি কিছু দেখানো যায় না? এবারে পারিষদেরা বেশ খুশি খুশি মুখ, যাক দাদা তাহলে ধরেছে ব্যাটাকে। নির্বিকার মুখে উত্তর দিলাম, “কোনও মানুষ চুরি করলে সেটা দোষ, চুরি বা অপরাধ না করলে সেটা গুন নয় স্বাভাবিকতা। শাসক দল বা সাংসদ ভাল কাজ করবেন সেটাই তো স্বাভাবিক, তার মধ্যে তো কোনও অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে না। না করলেই তো সেটা অপরাধ, তখনই সেটা খবর”। এক মুহুর্ত থমকালেন, হাতের খাবার হাতেই তখন, বললেন – “ওয়েল সেইড। খুব ট্যাক্টফুলি বললেন তো! আপনিই রাজনীতিতে এসে যান”। আবার আমিও থমকালাম, হেসে বললাম ওটা আপনাদের জন্যই থাক। মাঝে মধ্যে বাইট নেব আমি। এতক্ষণ উজ্জ্বল মুখে থাকা পারিষদদের মুখ ফের ম্রিয়মান।
কাজ সেরে এবার ঢু মারলাম পুরসভায়। পুরসভা তখনও তৃণমূলের, বর্তমান মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা তখন চেয়ারম্যান। সেখানেই দেখা কেষ্টদার সঙ্গে। আমাদের হঠাৎ আগমনে শশব্যস্ত সকলেই। নির্মল মাজিকে কোথায় পাব, কি পরিস্থিতি ইত্যাদি খোঁজ খবরের পর সেখান থেকে বিদায়। দেখা হল তৃণমূল প্রার্থী নির্মল মাজির সঙ্গেও। সেখানেও অবশ্য আতিথেয়তা পেয়েছিলাম ভালই, দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণও ছিল। ভোটের ফল তো সকলেরই জানা, প্রায় ৩ লক্ষ ১০ হাজারেরও বেশি ভোটে সোমনাথবাবু জিতেছিলেন।
এর পরেও কিন্তু বিরুদ্ধে খবর অব্যাহত ছিল। সোমনাথবাবু স্পিকার হয়েছেন, খোয়াই-এ বেআইনি নির্মান নিয়ে খবর করতে গিয়ে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নাম থাকায় দিল্লির স্পিকারের দফতর থেকে সেই খবরের সত্যতা নিয়ে প্রচ্ছন্ন হুমকি ফোনও এসেছে আমার কাছে, আমাদের হায়দরাবাদ অফিসেও। কিন্তু শিষ্টাচারটা ছিল। সোমনাথবাবু কোনওদিন আপনি থেকে তুমি বলেননি, জনসমক্ষে সরাসরি খবর নিয়ে কোনও অভিযোগ করেননি। স্পিকার হওয়ার পরে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়াতে কম আসতেন, সে নিয়েও খবর হয়েছে কিছু বলেননি। কিন্তু এই শিষ্টাচার এখন তেমন দেখি না। এখন তো বহু রাজনৈতিক নেতাই সাংবাদিকদের তুই সম্বোধন করে কথা বলেন। হয় তো এতে সাংবাদিকদেরও প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে। কিন্তু আমাদের আমলে খুব ঘনিষ্ঠ হলে কেউ কেউ একটু আধটু তুমি বললেও অধিকাংশরাই আপনি করেই বলতেন। সোমনাথবাবুদের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও বয়সে অনেক বড় হওয়া স্বত্বেও সেই শালীনতার সীমা কোনও দিন অতিক্রম করেননি। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - election Bolpur Somnath Chatterjee)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours