দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও শিক্ষিকা, চন্দননগর, হুগলি:
পূর্ব বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনার প্রতাপেশ্বরের মন্দিরকে জলেশ্বর মহাদেবের মন্দির বা 'প্যারীকুমারী মঠ' যে নামই দেওয়া হোক সে মন্দির অসাধারণ টেরাকোটার কাজের এক অপূর্ব নিদর্শন।
বাঁকুড়ার সোনামুখী থেকে তৎকালীন প্রখ্যাত টেরাকোটা শিল্পী রামহরি মিস্ত্রীকে নিয়ে এসে বানানো এই মন্দির ১৮৪৯ এ প্রতিষ্ঠিত, উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, পূর্বমুখী, উড়িষ্যারীতির শিখর দেউলের প্রাচীন রীতির পরিবর্তিত ও সরলীকৃত রূপ। গর্ভগৃহে একটি মাত্র দরজা, পূর্ব দিকে। বাকি তিনদিকে আছে ভরাট করা দরজা। আয়তন ১৫ ফুট x ১৫ ফুট উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট (১৩.৭ মি.)। এর চারদিকেই রয়েছে খুব ছোট পরিসরের বারান্দা। গর্ভগৃহে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ নিত্যপূজিত। উচ্চতা প্রায় ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি ( ১৩৭ সেমি)।
মন্দিরে প্রবেশ পথের মাথায় রয়েছে রামসীতার অভিষেকের মুর্তি। নিচে বাদ্যবন্দনা। উত্তর দিকের কৃত্রিম দ্বারের মাথায় আছে লঙ্কাযুদ্ধ। যুদ্ধে সিংহবাহিনী দুর্গার আবির্ভাব। অন্য দিকে বানর সৈন্য। নিচে রণবাদ্য। পশ্চিম দিকে কৃত্রিম দ্বারের মাথায় রয়েছে কীর্তনদলসহ 'গৌড়-নিতাই' মূর্তি। আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ ও ললিতা-বিশাখা। অন্যান্য টেরাকোটা কাজের মধ্যে আছে দলবদ্ধ বিদেশিনী, বেহালা বাদিকা, কালী, রাধাকৃষ্ণলীলাদৃশ্য, অশ্বারোহী যোদ্ধা, সখীদ্বয়ের মাঝে শ্রীকৃষ্ণ, জগন্নাথ, শিব, মহিষমর্দিনী (ভগ্নপ্রায়), তীরন্দাজ, বীণাবাদক, গড়গড়ার নল হাতে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, ঘোড়-সওয়ার, মালা-জপ-রত বৈষ্ণব সাধু ও ফুলকারি নকশা ইত্যাদি। অনেকে বলেন, প্রতাপচাঁদের দুই মহিষী প্যারী কুমারী এবং আনন্দ কুমারীর অনুরোধে রাজপরিবারের তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এমন সুন্দর মনোমুগ্ধকর আকাশ চুম্বী মন্দির যাঁর নামে চিহ্নিত তাঁকে ঘিরে জালিয়াতির গল্প! প্রতাপেশ্বর শিব একমেবদ্বিতীয়ম্। বর্ধমান-রাজ প্রতাপচাঁদকে ঘিরে 'জাল প্রতাপচাঁদ' এর কাহিনি!
প্রতাপচাঁদের পিতা বর্ধমান-মহারাজ তেজচাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে নানা বদ অভ্যাস থাকলেও, প্রজাপালক হিসাবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন।
তেজচাঁদের আট রাণী। কিন্তু পুত্র সন্তান? বহু প্রতীক্ষার পর ষষ্ঠ রাণী নানকিদেবীর গর্ভে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নিলেন প্রতাপচাঁদ। জমিদারির একমাত্র উত্তরসূরি। পরিবার ও প্রজাদের চোখের মণি তিনি। ঠাকুমার আদরে প্রশ্রয়ে মানুষ। নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। নানারকম মানুষের সঙ্গে মেশেন। সাধুসন্তদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়াবাড়ি রকমের বেশি।
১৮১৩ সালে পিতার বর্তমানে অতি অল্প বয়সে জমিদারির ভার নিলেন প্রতাপ।
১৮২১ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি প্রতাপচাঁদ নাকি এক অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েন। তার ইচ্ছানুসারে কালনার গঙ্গার তীরে অন্তর্জলি যাত্রার আয়োজন করা হয়। এক তুমুল ঝড় বৃষ্টির রাত্রে শোনা যায়, প্রতাপচাঁদের মৃত্যু হয়েছে। অনেকের মতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে তিনি গঙ্গা সাঁতরে নৌকায় পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে এমন কথাও শোনা যায়, এই ঘোষণার পিছনে তেজচাঁদের পঞ্চম পত্নী কমলকুমারী ও তাঁর দাদা পরাণচাঁদ কাপুরের পরামর্শ ছিল। এমনকি এই সাজানো অন্তর্জলি যাত্রার মাধ্যমে প্রতাপচাঁদের গৃহত্যাগের পিছনে রানি কমলকুমারীর ষড়যন্ত্র ছিল। মহারাজ তেজচাঁদের প্রিয় পঞ্চম মহিষী কমলকুমারী ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমতী। রাজপরিবারের অনেক ঘটনার পিছনেই ছিল তাঁর মস্তিষ্ক। অনেকে মনে করতেন, রানি কমলকুমারী এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পরানচাঁদ কাপুরের অর্থলিপ্সা ও উচ্চাভিলাষের জন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেন প্রতাপচাঁদ। পরে তিনি অনুশোচনায় ভোগেন। প্রায়শ্চিত্তের উদ্দেশ্যে অন্তর্জলি যাত্রার কৌশল করে গোপনে চোদ্দ বছরের জন্য বর্ধমান ত্যাগ করেন। প্রতাপচাঁদের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু অথবা মৃত্যুর গল্প কমলকুমারী ও তার দাদা পরাণচাঁদ কাপুরের কাছে এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল। বর্ধমান রাজপরিবার হয়ে গেল বংশধরহীন। তেজচাঁদ বারংবার পুত্রের মৃত্যুকে অস্বীকার করলেও তারা বৃদ্ধ তেজচাঁদকে দিয়ে পরাণচাঁদের পুত্র চুনিলাল কাপুরকে দত্তক গ্রহণ করিয়ে ফেললেন। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তেজচাঁদ মারা যাবার পরে এই চুনিলাল কাপুরকে 'মহাতাবচাঁদ বাহাদুর' নাম দিয়ে রাজসিংহাসনে বসালেন কমলকুমারী ও পরাণচাঁদ।
প্রতাপচাঁদের মৃত্যুর খবর তেজচাঁদের মতো অনেকেই বিশ্বাস করেননি। এর ঠিক ১৪ বছর পর ১৮৩৫ সালে গোলাপবাগের গাছতলায় ফকির সন্ন্যাসী আলেক শাহকে দেখে 'গোপীনাথ ময়রা'র মনে হয় "ছোটো মহারাজ"এর কথা। কিন্তু ততদিনে তেজচাঁদ মারা গেছেন। জমিদারির ক্ষমতা দখল করেছেন মহাতাবচাঁদের নামে প্রতাপের বিমাতা কমলকুমারীর ভাই পরাণচাঁদ। সন্ন্যাসী রাজ পরিবারের সকল কথা বলতে পারেন। কিন্তু সে খবরে প্রমাদ গুনলেন পরাণ। এক দেওয়ানের নেতৃত্বে বিজয় ও রাম নামের দুজন লেঠেল পাঠিয়ে সন্ন্যাসীকে শহরের সীমানার বাইরে বের করে দিলেন। শহরের বাইরে সেই জায়গার নাম হল 'বাজেপ্রতাপপুর'। অর্থাৎ নকল প্রতাপের জায়গা। আর তার নিকটেই দুটি জায়গার নাম দেওয়ানদীঘি ও বিজয়রাম।
প্রতাপচাঁদ ওরফে আলেক শাহ গেলেন বিষ্ণুপুরের মহারাজার কাছে। তাঁর পরামর্শে বাঁকুড়ায় ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে আলাপ করলেন। আর সেখানে প্রজাবিদ্রোহ শুরু হলে গ্রেফতার করা হয় আলেক শাহকে। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের তখন শেষ অবস্থা। কোথাও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লেই কোম্পানীর দৃষ্টি যায় স্থানীয় ফকির সন্ন্যাসীদের দিকে। যাই হোক, মুক্তি লাভের পর তিনি গেলেন কলকাতা। সেখান থেকে সবান্ধব আবার বর্ধমান প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু কালনায় পৌঁছোতেই গ্রেপ্তার করা হল তাঁকে।
শুরু হয় জাল প্রতাপচাঁদের মামলা।
১৮৩৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ম্যাজিস্ট্রেট স্যামুয়েল সাহেবের অধীনে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হল।
সাক্ষ্য দিতে এলেন গণ্যমান্য নানান ব্যক্তি। বিষ্ণুপুরের মহারাজ, জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ, পাঞ্জাব থেকে রণজিৎ সিংয়ের সেনাপতি ফরাসি জেনারেল অ্যালার্ড।
সেকালে এই মামলা ঘিরে বর্ধমান এবং সারা বাংলা যথেষ্ট আলোড়িত হয়। রবীন্দ্র পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই মামলার একজন সাক্ষী হিসাবে আদালতে উপস্থিত হয়ে প্রতাপের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। অনেকের মতে, দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ‘কার এন্ড ট্যাগোর’ কোম্পানীর একজন কর্মকর্তা, বর্ধমান রাজপরিবারের আইনী পরামর্শদাতা ছিলেন ‘কার এন্ড ট্যাগোর’ কোম্পানী। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বর্ধমান রাজপরিবারের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
এই মামলায় ডেভিড হেয়ারও সাক্ষ্য দেন। তিনি সন্ন্যাসীকে প্রতাপচাঁদরূপে সনাক্ত করেন।
স্যামুয়েল সাহেব শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রতাপ বলে স্বীকার করলেন না।
অনেক সাক্ষ্য-প্রমানের পর ইংরেজ আদালতে সন্ন্যাসী দোষী প্রমাণিত হন। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ২০শে সেপ্টেম্বর রায় বের হল যে, জাল প্রতাপচাঁদের আসল নাম অলক শাহ অথবা কৃষ্ণলাল ব্রহ্মচারী। আদালত জাল প্রতাপচাঁদকে এক হাজার টাকার জরিমানা করে এবং অনাদায়ে ছ'মাসের জেলের আদেশ দেয়। কর্পদকহীন জাল-প্রতাপচাঁদ ছ'মাস জেল খেটে কলকাতা চলে যান। এরপর আইন মোতাবেক জাল-প্রতাপচাঁদ কলকাতা হয়ে শ্রীরামপুর চলে যান। সেখানে তিনি সন্ন্যাস জীবন পালন করেন। শ্রীরামপুর থেকে তিনি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৮৫৩) কলকাতার বরানগরের ময়রাডাঙা পল্লীতে আশ্রয় নেন। সেই বছরেই চরম দারিদ্র্য, হতাশা, ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য তাঁর মৃত্যু হয়।
মামলা শেষ হবার, হয়েও গেল। প্রজাদের মনে প্রতাপ রয়ে গেলেন। আইনত ক্ষমতালাভ না হলেও, প্রজারা অধিকাংশই প্রতাপের ফিরে আসার কথা বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন, তিনি জাল নয়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! কখনও সখনও ঘটে বুঝি! এই ঘটনার প্রায় সত্তর বছর পরে পূর্ববঙ্গে ঘটেছিল ভাওয়াল সন্ন্যাসীর ফিরে আসার ঘটনা। কাহিনির গতিপ্রকৃতিও প্রায় একই।
এই কাহিনিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা চলচ্চিত্র 'সন্ন্যাসী রাজা' তো কালজয়ী। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সুমিত্রা মুখার্জি অভিনীত "রত্নদ্বীপ" যাত্রাপালাটিতে একই ঘটনা বা ক্ষমতা দখলে জালিয়াতির গল্প। কালনা শহরই সৌমিত্র এবং সুমিত্রার অসাধারণ অভিনয়ের সাক্ষী হয়ে আছে।ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অবিকল এক না হলেও খানিকটা একভাবে ঘটে, এর প্রমাণ ইতিহাস নিজে।
ভাওয়াল সন্ন্যাসী আদালতে ‘আসল’ রাজকুমার বলেই প্রমাণিত হয়েছিলেন। আমাদের প্রতাপচাঁদ প্রজাদের মনে যত রেখাপাতই করুন, ইতিহাসের পাতায় থেকে গেছেন ‘জাল প্রতাপচাঁদ’ নামেই…আসল প্রতাপচাঁদকে অকালে বিদায় দিতে হয়েছে।
আমরা সেই সময়ের সাক্ষী নই। যদি বা মনের কোণে কোনো পক্ষপাতিত্বের টুকরো জমা হয় গান দিয়ে ভুলি—
"কেউ বা রাজা রাজপ্রাসাদে, কেউ ফকির হয়ে কাঁদে।
কেই বা এর করবে বিচার, নালিশ জানাব কাকে!"
(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)
(www.theoffnews.com - Pratapeshwar mandir Kalna Pratap Chand)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours