তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
মনে ও মুখে এক হওয়ার থেকে বড় সাধনা আর নেই, বলেছিলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব পরমহংস।
আর সেই এক হওয়া যে চাট্টিখানি কথা নয়, তা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। বিশেষত, তা যখন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে। বহু ধর্মপালনের এ-দেশে যিনি বহুত্বের প্রচার করবেন- জানাবেন, মত অনুযায়ী পথ পৃথক হলেও অন্তিম দর্শনে সকলই এক, তাঁকে অবশ্য কেবল তত্ত্বকথায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকলে চলত না। শ্রীরামকৃষ্ণ তাই তত্ত্বে বাঁধা হয়ে থাকেনওনি। বরং আপনি আচরি ধর্ম জগতকে বার্তা দিতে চেয়েও ছিলেন তিনি, পেরেও ছিলেন তিনি।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ নাগাদ রামকৃষ্ণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর গুরুর নাম গোবিন্দ রায় (জানা যায়, পরে তাঁর নাম হয়েছিল ওয়াজেদ আলি খান)। শান্ত, ভক্তিমান এই মানুষটিকে কালীবাড়িতে দেখে, ঠাকুরের প্রতীতি হল যে, ইনি সাক্ষাৎ ভগবান লাভ করেছেন। তাই এঁর কাছে ইসলামে দীক্ষা নিয়ে, সেই ধর্মমতের শেষে কী আছে, তা দেখে নিতে চাইলেন তিনি নিজে। নিলেন দীক্ষা। এবং ইসলাম মতেই শুরু হল সাধন। সে-সময় হিন্দু দেবদেবীর দিকে তিনি তাকাতেন না। পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা খাবার খেলেন। একজন অ-হিন্দুর মতোই মন্দির সীমানার বাইরে এসে বাস করতেন। খাওয়া-পরা থেকে প্রার্থনা – সবকিছুতেই তিনি হয়ে উঠলেন একজন খাঁটি অ-হিন্দু। স্বামী নির্বেদানন্দ তাঁর ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ও আধ্যাত্মিক নবজাগরণ’ বইটিতে জানাচ্ছেন, ‘হিন্দু দেবদেবী –সংশ্লিষ্ট সমস্ত চিন্তা, দর্শন ও ভাবাবেগ তাঁর মন থেকে তখনকার মতো একেবারে লুপ্ত হল এবং তাঁর পবিত্র চিত্ত নিস্তরঙ্গ সরোবরের মতো ইসলাম ভাবের অন্তর্নিহিত সত্যের প্রতিফলনের জন্য প্রতীক্ষারত হয়ে রইল। তিনি ‘আল্লা’ মন্ত্র জপ করে চললেন, শ্রদ্ধাবান মুসলমান ফকিরের মতো নিয়মিতভাবে নামাজ পড়তে লাগলেন।’
চলল সাধন। তিন দিনের মাথায় এক গম্ভীরানন পুরুষের দর্শন হল তাঁর। ভক্তদের অনুমান, স্বয়ং মহম্মদের দেখা পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। এবং সেই দর্শনে নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের অনুভব পেলেন তিনি। এর আগে অদ্বৈত সাধনমার্গেও একই অনুভূতির স্তরে পৌঁছে ছিলেন তিনি। অর্থাৎ, এই অদ্বৈত অনুভূতিই দুই ধর্মের সাধারণ ভূমি। তফাৎ শুধু পালনীয় আচরণবিধিতে। সে কথা রামকৃষ্ণ জানালেন, ইসলাম গ্রহণ করে এবং সেই ধর্মমতে সাধন করেই।
সেই সময়ে তো বটেই, আজও রামকৃষ্ণের এই ধর্মাচরণের এক গভীর তাৎপর্য আছে। আজ দেশে দেশে বিভিন্ন মতাদর্শের পতন দেখা যায়। কারণ, তত্ত্ব ও ফলিতে কোনো মিল থাকে না। এমনকী ধর্ম নিয়ে আজ যে বিভাজন দেখা যায়, তার ভয়াবহতা রামকৃষ্ণের মতো দার্শনিক উপলব্ধি করেছিলেন বহু আগেই। বহুত্বের মধ্য দিয়ে একতার স্বরূপটি তাই তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে কখনও তত্ত্বের সীমাবদ্ধতায় নিজেকে আটকে রাখেননি। আজ যে ভাবে বিভাজনের ন্যারেটিভ সযত্নে তৈরি হচ্ছে, তার কাউন্টার ন্যারেটিভ যেন রামকৃষ্ণ মানুষের হাতে তুলেই দিয়ে গিয়েছিলেন। আজও সমস্ত তত্ত্বগত উদারতা সত্ত্বেও এই যে বিভাজনের লতাপাতা ফনফনিয়ে উঠছে তার কারণ অবশ্যই তত্ত্বের সঙ্গে আচরণের বিস্তর প্রভেদ। তার কারণ, একেবারে অন্তরের অন্তঃস্থলে কোথাও থেকে গিয়েছে সংরক্ষণ। রামকৃষ্ণ তা আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, অ-হিন্দু পথে সাধনের জন্য তিনি ইসলামের পরে খ্রিস্ট ধর্মেও দীক্ষিত হয়েছিলেন। কোনও ভেদাভেদকে প্রশ্রয় দেননি। এই সংকীর্ণতা পেরোনো যে আজ জরুরি তা অনেকেই অনুভব করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সে বার্তা দিয়েছিলেন ইসলাম ও খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করেই। সব ধর্ম শেষে মুক্তি বা মোক্ষর কথা বলে। কিন্তু কিভাবে এই মুক্তি বা মোক্ষ লাভ হবে সেই সব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথ আছে। তাই কারুর বলা ঠিক হবে না
যে এই ধর্মই একমাত্র শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং সেটাই সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া। উনি বুঝে ছিলেন এটা
বহুত্ববাদের দেশ। তাই যত মত তত পথ
ধরুন কেউ ধর্ম মানেন না, বেদ মানেন না,ঈশ্বর
মানেন না তাতে কি ক্ষতি আছে? সেও
মানুষ, তাঁর মধ্যেও ঈশ্বর বোধ আছে, বৈরাগ্যেরও বোধ আছে, তাঁরও মৃত্যু আছে, তাঁর মধ্যে মানবিকতা সুপ্ত আছে (ঈশ্বর ঘুমিয়ে আছে)। শয়তানতবু জেগে আছে। শুধু তাঁর ক্ষেত্রে একটাই কথা বলবো, "তোমাদের চৈতন্য হোক"।
(ছবি প্রসঙ্গে কিছু তথ্য:
শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর ১৬ অগাস্ট ১৮৮৬ তারিখে বেঙ্গল ফটোগ্রাফার্সের তোলা এই আলোকচিত্র। সামনের সারিতে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ছবিতে দৃৃৃশ্যতঃ কারা কারা ছিলেন ওই সময় কাশিপুর উদ্যান বাটিতে। এই ছবিতে যাঁদের শনাক্ত করা গিয়েছে, তাঁরা হলেন: (১) অতুলচন্দ্র ঘোষ, (২) অমৃত, (৩) বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল, (৪) ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়, (৫) বাবুরাম (স্বামী প্রেমানন্দ), (৬) নরেন্দ্রনাথ (স্বামী বিবেকানন্দ), (৭) রামচন্দ্র দত্ত, (৮) গোপালচন্দ্র ঘোষ (স্বামী অদ্বৈতানন্দ), (৯) শরৎ (স্বামী সারদানন্দ), (১০) বলরাম বসু, (১১) লাটু (স্বামী অদ্ভুতানন্দ), (১২) শশী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), (১৩) রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), (১৪) নিত্যগোপাল বসু, (১৫) যোগীন্দ্র (স্বামী যোগানন্দ), (১৬) দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার, (১৭) তারক (স্বামী শিবানন্দ), (১৮) হুটকো গোপাল, (১৯) নিত্যনিরঞ্জন (স্বামী নিরঞ্জনানন্দ), (২০) নারায়ণ, (২১) মণিলাল মল্লিক, (২২) ফকির, (২৩) সুরেন্দ্রনাথ মিত্র, (২৪) ভূপতিনাথ মুখোপাধ্যায়, (২৫) হরিশচন্দ্র মুস্তাফি, (২৬) গিরীন্দ্রনাথ মিত্র, (২৭) বিনোদবিহারী ঘোষ, (২৮) শ্রীম (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত), (২৯) কালী (স্বামী অভেদানন্দ), (৩০) নবগোপাল ঘোষ, (৩১) গঙ্গাধর (স্বামী অখণ্ডানন্দ), (৩২) মহিমাচরণ চক্রবর্তী, (৩৩) মনমোহন মিত্র।)
(www.theoffnews.com - Ramakrishna paramhansa)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours