তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সমকালীন মানুষ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ ঘটেনি। দুজনের সঙ্গে দুজনের যে একেবারেই দেখা হয়নি, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন উপলক্ষে দেখা হলেও কেউ কারও দিকে আগ্রহ বাড়িয়ে এগিয়ে যাননি।

একবারই সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথ গান গেয়েছিলেন। নন্দন বাগানে কাশীশ্বর মিত্রের বাড়িতে। ব্রহ্ম সমাজের বাৎসরিক উৎসব চলছিল। রবীন্দ্রনাথ উপস্হিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পিয়ানো বাজিয়ে 'আমায় মাথা নত করে দাও' এই গানটা শুনিয়েছিলেন। রাগ ইমন কল্যাণ,তাল তেওড়া, রচনা কাল ১৯০৬ (স্বরলিপি), স্বরলিপিকার কাঙলী চরণ সেন। ওই গান শুনে ঠাকুরের আনন্দের সীমা ছিল না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব দুজনেই প্রায় একই সময়ের দুই দিকপাল মহাপুরুষ।জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কিছু অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। সেখানেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়েছিল রামকৃষ্ণের কিন্তু সে পর্যন্তই। এদিকে রামকৃষ্ণের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের যোগাযোগ ছিল। ব্রাহ্মসমাজের অনেকেই তাঁকে দেখতে আসতেন, তিনিও যেতেন। ব্রাহ্মসমাজের বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে রামকৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৮৬৬ সালে, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর।

কলকাতায় কাশীশ্বর মিত্রের বাড়ি, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ও রামকৃষ্ণের দেখা হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথকে চিনেছিলেন মূলত তাঁর গানে। প্রিয় শিষ্য নরেন্দ্রর (স্বামী বিবেকানন্দ) কণ্ঠে বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত শুনে ভাবোন্মাদ হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। যেহেতু নরেন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন উচ্চমানের ধ্রুপদি, তাই রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদ আঙ্গিকের কিছু গান নিজের কণ্ঠে তুলে নিয়ে গাইতেন। আর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের পুরো অস্তিত্বই ছিল সংগীতময়। নিজে অনেক গান গেয়েছেন এবং অনেকের কাছ বহু গান শুনেছেন। এমন কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না, যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ-নরেন্দ্রর দেখা হয়েছে অথচ কোনো গান হয়নি। এমন গানের আসরে ঠাকুর নরেন্দ্রর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের যে গানগুলো শুনেছেন, সেগুলো হলো, ‘গগনের থালে রবিচন্দ্র-দীপক জ্বলে’ (শিখ ভজনের আশ্রয়ে রচিত রবীন্দ্রনাথের গান), ‘দিবানিশি করিয়া যতন’, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, ‘আমার মাথা নত করে দাও তোমার চরণ ধুলার তলে'।

এমনকি সরাসরি বসে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে গান শোনার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণের। ১৮৮৩ সালের ২ মে। কাশীশ্বর মিত্রের বাড়িতে ছিল নন্দনবাগান অনেক জ্ঞানীগুণীর সঙ্গে সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ২২ বছরের যুবক রবীন্দ্রনাথ এবং সবার ঐকান্তিকভাবে প্রার্থিত পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। বাড়ির সব থেকে বড় ঘরে সভার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রার্থনাসভার শুরুতে শ্রীরামকৃষ্ণের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ পিয়ানো বাজিয়ে গান শুনিয়েছিলেন ঠাকুরকে। আর সে গানটি হলো যুবক রবীন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসংগীত, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’। নিবিষ্ট মনে সেই গান শুনতে শুনতে রামকৃষ্ণ ভাবোন্মাদ হয়েছিলেন। সবাই পরম বিস্ময়ে এক অতীন্দ্রিয় মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিলেন সে সভায়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শ্রদ্ধায় বিমোহিত হয়েছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে ওই অবস্থা কাটিয়ে উঠে শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন সবার সঙ্গে লুচি, ডাল, তরকারি, মিষ্টি খেয়ে উপস্থিত সবাইকে, বিশেষ করে যুবক রবীন্দ্রনাথকে বিদায় জানিয়ে দক্ষিণেশ্বরে ফিরে যান।

তিন দিন পরে তৎকালীন ‘দ্য স্টেটসম্যান’ কাগজে ওই উৎসবের যে খবর বেরিয়েছিল, তার শেষ লাইনটি ছিল এ রকম, ‘The choir was led by baboo Rabindra Nath Tagore’। এই চাক্ষুষ দর্শনের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, ত্রিষ্টুপ মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে এই দেখার ঘটনাটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘পরমহংসদেবকে একদিন দশ মিনিটের জন্য দূর থেকে দেখেছি।'  রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশাল সৃষ্টিকর্মে এক-দুটি ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানেই করেছেন সেখানে গভীর তাৎপর্যপূর্ণভাবেই এনেছেন। এক দিকে রবীন্দ্রনাথ, যিনি ব্রহ্মবাদী। নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক। অন্যদিকে শ্রীরামকৃষ্ণ, যিনি সর্বধর্মে অবগাহন করে হয়েছেন এক ঋদ্ধ বিনম্রতার প্রতীক এবং সাকার বিশ্বাসী। ১৯৩৩ সালে ত্রিষ্টুপ মুখোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে কবি তাঁর ‘শ্রদ্ধেয়’ রামকৃষ্ণ সম্পর্কে কিছু লেখার বিষয়ে নিজের অপারগতার কথা জানালেও ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গ। উপন্যাসের তিনটি চরিত্র, আদিত্য, নীরজা ও সরলা। আদিত্য-নীরজা দুজনের বিরাট ফুল বাগান। স্বামী আদিত্যের ছিল ফুলের ব্যবসা। বাগানে ফুলের সুশোভিত সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলে মিশে থাকে দুজনের সংসার। এক সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয় নীরজা। এ সময় আদিত্যকে বাগানের কাজে সহযোগিতা করতে আসে তার মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে সরলা। ক্রমেই তাদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। শয্যাশায়ী নীরজা তা অনুভব করে। এদিকে স্বামী হারানোর আশঙ্কায় ছটফট করে ওঠে নীরজার মন। নীরজা রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ভক্ত। বিছানায় মাথার ওপরে টাঙানো পরমহংসদেবের ছবি। তাঁর কাছেই আশ্রয় খোঁজে দিনরাত। দেবর রমেনের সঙ্গে আলাপের সময়ে একবার নীরজা বলেছে, ‘যখন চোখের জল ভেতরে ভেতরে বুক ভেসে যায়, তখন ওই পরমহংসদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি।’ সব হারানোর যন্ত্রণায় একসময় নীরজা দুহাত জোড় করে ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘বল দাও ঠাকুর, বল দাও, মুক্তি দাও অধম নারীকে। আমার দুঃখ আমার ভগবানকে ঠেকিয়ে রেখেছে, পূজা অর্চনা সব গেল আমার।’ রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রবীন্দ্রনাথকে দেখা যায়।

১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসের পর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগবশত ১৯৩৬ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে শান্তিনিকেতনে বসে ‘পরমহংস রামকৃষ্ণদেব’ নামে ১২ লাইনের একটি কবিতাটি রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালের ১ মার্চ কলকাতায় শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আট দিনের এক বিরাট ধর্ম মহাসভা আয়োজন করা হয়। ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের দার্শনিক-সাহিত্যিক-শিল্পীরা শ্রীরামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ এই অমোঘ বাণী নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার তৃতীয় দিন ৩ মার্চ কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সভাপতি হিসেবে ইংরেজিতে তিনি একটি দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন। পরদিন ৪ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় পুরো ভাষণটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সেই ভাষণের প্রথম অংশটি উল্লেখ করলেই এটা স্পষ্ট বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথও উপলব্ধি করেছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মকেন্দ্রিক সমন্বয় ভাবনা সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া প্রয়োজন।

শ্রীরামকষ্ণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভক্তি ও শ্রদ্ধা কেমন ছিল তা আরও স্পষ্ট বোঝা যাবে, তাঁর মানবতাবাদী সাধনা দিয়ে রচিত ‘পরমহংস রামকৃষ্ণদেব’ কবিতাটির দিকে তাকালে যে কবিতার একটি ইংরেজি অনুবাদ কবি নিজেই করেছিলেন। সম্পূর্ণ কবিতাটি নিচে রইল।

"বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা

ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা

তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে

নতুন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে

দেশবিদেশের প্রণাম আনিল টানি

সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।”

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore Ramkrishna Thakur)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours