তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

গো মাংস খাওয়া ও রন্ধন নিয়ে নানা বিতর্ক কিন্তু আমাদের পরিচিত সমাজে একেবারে গভীরে প্রবেশ করে গেছে। প্রথমে বলে রাখি গো মাংস খাওয়া ও রন্ধন আইনত অপরাধ নয়। গরুর চামড়া দিয়ে জুতো, মানিব্যাগ, জ্যাকেট, বাদ্য যন্ত্র তৈরি হয়। মানে যিনি আমাদের গোমতা তিনি পায়ের তলায় কেন থাকবেন? অর্থাৎ গো মাংস খাওয়া অপরাধ  কিন্তু গরুর চামড়ার তৈরি চটি পায়ের তলায় থাকা অপরাধ নয়। এ এক অদ্ভুত ঐতিহাসিক স্ববিরোধিতা। কি উত্তর দেবেন এর?

সায়নী ঘোষের মন্তব্যে এবং দেবলীনা দত্তের কথায় কারও কারও হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে। কে কোন খাবার খাবে এটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্যভাবে দেখতে গেলে, হিন্দু ধর্ম বলে কিছু নেই। এই দেশে যেটা ছিলো সেইটা রিলিজিওন অর্থে ধর্ম নয়। এই দেশে ধর্ম মানে আইন যা যুগে যুগে বদলায়। পিতার সাথে পুত্রের সম্পর্ক, রাজার সাথে প্রজার সম্পর্ক, স্বামীর সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক এই সব বহুবিধ সম্পর্ক নিয়ে সামাজিক নিয়ম ছিল।

একমাত্র ধর্ম ছিল সনাতন ধর্ম। আসুন দেখা যাক হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রে কি বলা আছে গো মাংস খাওয়া সম্পর্কে। অনেকের মতে গো হত্যা করে গো মাংস খাওয়াকে হিন্দুরা পাপ হিসেবে গণ্য করে। এ প্রসঙ্গে আমরা হিন্দু ধর্মীয় অনুশাসনে গরুর অবস্থান সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে আসলেই কি গরু খাওয়া হিন্দু ধর্মে নিষিদ্ধ? স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন," এই ভারতবর্ষেই এমন এক দিন ছিল যখন কোন ব্রাহ্মণ গরুর মাংস না খেলে ব্রাহ্মণই থাকতে পারতেন না। যখন কোন সন্ন্যাসী, রাজা, কিংবা বড় মানুষ বাড়ীতে আসতেন, তখন সবচেয়ে ভালো ষাঁড়টিকে কাটা হতো। (Collected works of Swami Vivekananda, Advaita Asharama,1963, Vol III, page 172)। ঋগ্বেদের প্রাচীন ভাষ্যকার হিসেবে সায়না চার্যের নাম বিখ্যাত। তাঁর আগেও বিভিন্ন ভাষ্যকার, যেমন স্কন্দস্বামী, নারায়ণ, প্রমুখ ঋগ্বেদের ভাষ্য করেছেন।

আমি বেদের রেফরেন্সগুলো দেব বিখ্যাত অনুবাদক ও বেদ ভাষ্যকর শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদারের অনুবাদকৃত বেদ হতে। আশা করি এতে করে আমার এই পোস্টের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে আপনাদের মনে কোন রকম সন্দেহ থাকবে না। বেদে স্পষ্ট গো হত্যা ও মাংস রান্নার কথা আছে। ঋক বেদেও তার প্রচুর উদাহরণ আছে। এছাড়াও বেদের ক্লাসিকাল ভাষ্যকর আচার্য সায়নও একই কথা লিখেছে তার অনুবাদে তিনিও লিখেছেন, “হে ইন্দ্র গ্রহন কর সেসব গরুর মাংস যা তোমাকে তোমার ভক্তরা রন্ধন করে উৎসর্গ করেছে।” ঋকবেদেতেও গরু রান্না করার কথা পাওয়া যায়, প্রচুর হিন্দু শাস্ত্রে এমন কি উপনিষদে ও  তার প্রমান মেলে।

হিন্দু ধর্মের অনেক গ্রন্থেই গরু বলির ও গোমাংস খাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু বিশ্বাসী একটা বড় অংশের হিন্দুরা সাধারণত তা মানতে চান না। বিবেকানন্দের বাণী ও রচনাতে গোমাংস সম্বন্ধে তার বেশ কিছু উক্তি পাওয়া যায়। প্রাচীন হিন্দুরা যে গোমাংস খেত তার কথায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সত্য জানতে হলে সকল বিশ্বাসী হিন্দুদের গোমাংস সম্বন্ধে বিবেকানন্দের বক্তব্যগুলো জানা উচিত। নিচে তার উক্তিগুলো উল্লেখ করা হল-

1) "If we did not eat beef and mutton, there would be no butchers. Eating meat is only allowable for people who do very hard work, and who are not going to be Bhaktas; but if you are going to be Bhaktas, you should avoid meat."

[The Complete Works of Swami Vivekananda/ Volume 4/ Addresses on Bhakti Yoga/ The Preparation]

১) অনুবাদঃ আমরা যদি গোমাংস এবং মেষের মাংস না খেতাম তাহলে কোনো কসাই থাকতো না। যারা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী এবং যারা ভক্ত হবেন না একমাত্র তাদের ক্ষেত্রে মাংস খাওয়া গ্রহণযোগ্য কিন্তু আপনি যদি ভক্তি মার্গে থাকেন তবে আপনার মাংস পরিত্যাগ করা উচিত।

কিন্তু এক সময়ে হিন্দুরা গো মাংস ভক্ষণ বন্ধ করলো। কারণ ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ। গো মাংস ভক্ষণ বেড়ে গেলে কৃষকরা বিনষ্ট হবে। এই কারণেই গো ভক্ষণ নিষিদ্ধ হলো কারণ গরু আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল। 

কিন্তু আজ আর্থ সংস্কৃতির অগ্রগতির এই পর্যায়ে এসে গো মাংস রন্ধন ও ভক্ষণের ব্যাপারে যেভাবে সায়নী ঘোষ ও দেবলীনা দত্তকে সাম্প্রদায়িক মন নিয়ে হেনস্থা করা হলো, গণ ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হলো নির্বাচনের কিছু আগে, আমি তাঁর তীব্র ধিক্কার জানাই। এনারা যদি বলতো শুকরের মাংস রান্না করব এবং খাবো তাহলে আবার একাংশ হিন্দু প্রেমীরা রাগ করতো না, সিংহভাগ মুসলিমরা রেগে যেত। আসলে মনে প্রানে আমরা খুব সাম্প্রদায়িক।

না হিন্দু মৌলবাদ না মুসলিম মৌলবাদ কোনওটাই সমর্থন যোগ্য নয়। আর তাছাড়া সনাতন হিন্দুরা ভাবাবেগকে গুরুত্ব দেয় না। গুরুত্ব দেয় সনাতন ধর্মকে। যার মধ্যে ভাবাবেগ এবং উপরিউক্ত আলোচনা পরে না। সমস্ত ধর্মকে সন্মান জানিয়ে বলছি, ধর্ম আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্র চিন্তায় ও শাসনে ধর্মকে রাখাটা অগণতান্ত্রিক। কারণ ভারতবর্ষের সংবিধান অনুযায়ী আমাদের দেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।

একটু ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। ভারতে গোমাংস বিতর্ক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে বই প্রকাশ করতে গিয়ে ভয়ানক বিপদে পড়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঁ। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)'র একাংশ অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ রক্ষণশীল সমর্থকরা অধ্যাপক নারায়ণ ঝাঁকে বার বার মৃত্যুর হুমকি দিয়েছেন, ঈশ্বর-নিন্দার কারণ দর্শিয়ে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কোর্টের মাধ্যমে তার গবেষণার প্রকাশ বন্ধ করিয়েছেন। পরে অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঁ The Myth of the Holy Cow নামে তার গবেষণার সারবস্তু লন্ডন থেকে প্রকাশ করেন।

দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঁয়ের বক্তব্যের সারাংশ নীচে দেওয়া হলো। সম্প্রতি ভারতে গোরক্ষার নামে যেভাবে মুসলমান হত্যা চলছে তা আধুনিক জগতে চরম নিন্দনীয় ও অকল্পনীয়। গোধূলি লগ্নে চারণভূমি থেকে গরু নিয়ে ফেরার সময় গোহত্যার অভিপ্রায়ের অজুহাতে মুসলিম রাখাল বালক হত্যা, বাড়িতে গোমাংস রাখার অভিযোগে পুরো মুসলমান পরিবারকে পুড়িয়ে মারার কর্মকান্ডে সারা পৃথিবী বিস্মিত, স্তম্ভিত ও চিন্তিত।

কিন্তু প্রাচীন ভারতে গোহত্যা ছিল ব্রাহ্মণ-সেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ: প্রাচীনকাল থেকে ভারতে গোহত্যা ও গোমাংস আহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল উচ্চ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুর বাড়িতে, সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ব্রাহ্মণ-তুষ্টিতে এবং বিভিন্ন রাজকীয় ও ধর্মীয় গোমেধে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের সব ভারতীয় ধর্মীয় গ্রন্থ ও লোকসাহিত্যে উৎসব করে ভারতে গোমাংস আহারের প্রমাণ পাওয়া যায় জন্মানুষ্ঠান, মহাব্রত, শ্রাদ্ধ ও ব্রাহ্মণ-সেবায়। কামসংহিতায় উল্লেখ আছে, তান্ত্রিক ব্রাহ্মণদের শারদীয় সেবা করতে হতো ১৭টি অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী খর্বকায় ষাঁড় এবং তিন বছরের কম বয়সী গোশাবক হত্যা করে। অবশ্য নিম্নবর্ণের দরিদ্র হিন্দুদের কালে ভদ্রে গোমাংস আহারের সৌভাগ্য হতো। চন্ডাল ও অচ্ছুতদের গোহত্যা করে গোমাংস আহারের অধিকার ছিল না। তারা মৃত গরুর মাংস খেত এবং গরুর চামড়া দিয়ে জুতা ও অন্যান্য দ্রব্য তৈরি করত, তারা গরুর হাড়ের ব্যবহারও করত। এ প্রথা ভারতের নিম্নবর্ণের অচ্ছুত হিন্দুদের মধ্যে আজও বহাল আছে। পুষান দেবতার পছন্দ কালো গাই, রুদ্রের প্রিয় লাল গরুতে। বৈদিক দেবদেবীরা বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীতে অনুরক্ত ছিলেন কেউ বা মহিষ, কেউ বা ছাগল, কেউ ভেড়ায়। ইন্দ্রের পছন্দ গোলাকার শিংযুক্ত ষাঁড় ও সাদা হাতিতে, অগ্নিদেবতার আকর্ষণ ছিল অশ্ব ও গোমাংসে। ঋগ্বেদে কী করে তলোয়ার বা কুড়াল দিয়ে গরু হত্যা করতে হবে এবং পরে রান্না করে খেতে হবে তার বর্ণনা আছে। বৈদিক ও বৈদিক-পরবর্তী যুগে ভারতীয়রা গোমাংস কেবল আহার করত তাই নয়, তাদের বিশ্বাস ছিল পিতা-মাতার শবদেহ দাহনের সময় একই সঙ্গে হৃষ্টপুষ্ট ষাঁড় পোড়ালে মৃত ব্যক্তি ষাঁড়ে আরোহণ করে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবেন। এরূপ ঘটনার উল্লেখ আছে অথর্বেদের বর্ণনায়। ভারতে আগত আর্যরা ছিল যাযাবর ও কৃষিতে অনভ্যস্ত। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সাল থেকে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তুরস্ক ও পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, রুমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ থেকে আর্যরা ভাগ্যের অন্বেষণে স্থলপথে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছে। অবশ্য দ্রাবিড়রা ভারতে বসতি গড়েছিল আর্যদের আগমনের কয়েক হাজার বছর আগে ৮০০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে। যাযাবর জীবনের পরিসমাপ্তিতে আর্যরা পরিচিত হয় সহজলভ্য খাদ্য হিসেবে গোমাংসের সঙ্গে। বৃহৎ জনবসতির কারণে ভারতে বনজ প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল। তবে গৃহপালিত ষাঁড়, মহিষ, গরু ও ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল দ্রুতগতিতে। ব্রিটিশ প্রশাসক উইলিয়াম ক্রুক ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত তার ব্যাপক গবেষণা গ্রন্থ The Veneration of the cow in India- তে দেখিয়েছেন যে, আর্যরা কেবল গোমাংসভোগী ছিলেন তাই নয়, তাদের গোমাংসে বিশেষ আকর্ষণ ছিল।

মহাভারত ও রামায়ণ-চরিত্রদের গোমাংসপ্রীতি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দ্রৌপদী দেবতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পঞ্চপা-বের বনবাসের অবসান হলে যুধিষ্ঠির সহস্র ষাঁড় ও গরু বলিদান করে দেবতাদের তুষ্ট করবেন। পঞ্চপা-বের তাদের বনবাসকালে সহজলভ্য গৃহপালিত গরুর মাংস সংগ্রহ করতেন এবং গোমাংস আহারে তাদের শক্তি সঞ্চিত হতো। গোবর ও গোমূত্রের ব্যবহারও ছিল তাদের জীবনযাত্রায়। মহাভারতে আরও উল্লেখ আছে, রাজা রতিরত্নদেব প্রতিদিন সহস্র গরু জবাই করে ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলি করে পুণ্য অর্জন করতেন।

বাল্মীকির রামায়ণে এ-জাতীয় আরও ঘটনার বিবরণ আছে। জনশ্রুতি যে, ব্যাপকসংখ্যক গরু বলিদানের ফলে রাজা দশরথের সন্তান রামের জন্ম হয়। রামপত্নী সীতা যমুনা নদী অতিক্রমকালে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, রাম তার পিতৃ আদেশ সফলভাবে পালন করতে পারলে তারা যমুনা নদীতে দেবীকে সহস্র গাই-গরু ও সহস্র ভাঁড় মদ উৎসর্গ করবেন। অবশ্য সীতা নিজে গোমাংসের চেয়ে হরিণের মাংস বেশি পছন্দ করতেন।

চরক-সংহিতা ও সুশ্রুত-সংহিতায় ওষুধ হিসেবে গোমাংস আহার এবং গোমূত্র সেবনের উপকারিতার বিবরণ আছে। গরুর লেজ ও হাড়ের ঝোলের বিধান আছে বিভিন্ন প্রদাহের চিকিৎসা হিসেবে। চরক সর্দি, সাধারণ জ্বর, পেটের গন্ডগোল নিরাময়ে গোমাংস পথ্য হিসেবে বিধান দিয়েছেন। সুশ্রুতের মতে, শ্বাসকষ্ট, শ্লেষ্মাজনিত সমস্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জ্বরে গোমাংস ওষুধের কাজ করে। সুশ্রুত গরুর মাংসকে ভগবানের পবিত্র দান রূপে চিহ্নিত করেছেন। গর্ভবতীকে গোমাংস খাওয়ালে গর্ভস্থ শিশু বলবান হয়।

সপ্তম শতাব্দীতে চিকিৎসক ভগবত গোমূত্র ও গোকণা (Bile) বিবিধ রোগ নিরাময়ের জন্য বিধিপত্র (প্রেসক্রিপশন) দিতেন। গরুর পঞ্চ উপাদানে প্রস্তুত পঞ্চগর্ভের আধুনিক সংস্করণ পঞ্চমর্ত্য যা পূজা-পার্বণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পাসর, বৈষ্য ও শংকরের মতে, গরুর মুখ ছাড়া সব অংশ আহারযোগ্য ও পাপমোচনে ব্যবহারযোগ্য। শল্যবিদ সুশ্রুত ১ হাজার ২০টি রোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন সুশ্রুত-সংহিতায়। সুশ্রুতকে প্লাস্টিক সার্জারির জনক বলা হয়। তিনি শতাধিক মেডিকেল যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেছিলেন। প্রাচীন ভারতে গোমাংস ভক্ষণের বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে পি ভি কেইন সম্পাদিত বৈদিক যুগের পাঁচ খ- ধর্মশাস্ত্রের ইতিহাসে। ভারতের জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও গোমাংসে তৃপ্তি পেতেন, গৌতম বুদ্ধও একসময় গোমাংস আহার করতেন। জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীরও গোমাংস ভক্ষণ করতেন। পরে তারা উভয়ে গোহত্যা নিষিদ্ধ করেছেন ধর্মীয় কারণের জন্য নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের পার্থক্য সৃষ্টি ও রাষ্ট্রীয় শাসন সুবিধার জন্য।

গোহত্যা প্রাচীন যুগে মহাপাপ বলে স্বীকৃত হয়নি। বৈদিক যুগে মনুসংহিতায় গোহত্যা সাধারণ পাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে ব্রাহ্মণের গরু অব্রাহ্মণ বধ করলে কঠিন শাস্তির বিধান হয়- গোশালায় রাতযাপন করে কেবল গরুর পাঁচ উপাদান (পঞ্চগর্ভ) ভক্ষণ করে। গোহত্যাকারীকে ২৫ দিবারাত্রি অনাহারে থাকতে হতো। ঋগ্বেদ ও উপনিষদের সাতটি মহাপাপ হলো- ১. ব্রাহ্মণকে অপমান ২. ব্রাহ্মণ হত্যা ৩. চৌর্যবৃত্তি ৪. প্রতারণা ৫. মদ্যপান (সুরাপান) ৬. গুরুস্ত্রীর সঙ্গে যৌনাচার ও ৭. ব্যভিচার। আরবরা ভারতে পৌঁছে গোমাংস আহারে পরিচিত হয়। ভাগ্যের অন্বেষণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাজা ও দলপতিরা ভারত বিজয় করেছেন বিভিন্ন শতাব্দীতে। এদের কেউ এসেছেন ইরান থেকে, কেউ আফগানিস্তান থেকে, কেউ তুরস্ক থেকে, কেউ মধ্যপ্রাচ্য, কেউবা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তাদের দীর্ঘ পথযাত্রায় খাদ্যের জোগান এসেছে বনজ প্রাণী, হরিণ, ঘোড়া, উট, দুম্বা, গন্ডার ও মহিষ থেকে। রোদে শুকিয়ে এসব প্রাণীর মাংস দীর্ঘদিন রেখে খাওয়া যায়। গোমাংস কখনো এদের যাত্রাপথের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো না। ধাই মাতার সঙ্গে আরবদের দীর্ঘ বন্ধন ছিল। তাই দুধদানকারী প্রাণী হত্যায় তাদের মানসিক অস্বস্তিবোধ ছিল।

মুসলমানরা ভারতে গোহত্যা আরম্ভ করেননি, গোমাংস আহারের প্রচলনও করেননি। বরং মুসলমান শাসকরা গোহত্যা সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন কৃষিকাজের উন্নয়ন ও শিশুস্বাস্থ্য রক্ষার নিমিত্ত। সম্পুর্ন গো হত্যা নিষিদ্ধ হলে চামড়া শিল্পের কি দশা হবে তাঁর উত্তর নেই সংঘ পরিবারের কাছে।

কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টসের পূর্বাঞ্চলীয় চেয়ারম্যান রমেশ জুনেজার দাবি, পশ্চিমবঙ্গে চর্মশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচা চামড়ার মাত্র ২০% স্থানীয়। বাকি ৮০% আসত অন্য রাজ্য থেকে। তার মধ্যে আবার ২৫ শতাংশের জোগান দিত একা মহারাষ্ট্রই। কিন্তু গো-হত্যা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই জোগান কার্যত শুকিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ চামড়া ব্যবসায়ীদের। তাঁদের কথায়, অনেক রাজ্য থেকে কাঁচা চামড়া আসা ৪০-৫০% কমে গিয়েছে। কোথাও থেকে আসা একেবারে বন্ধ। এই অবস্থায় জোড়া সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।

প্রথমত, কাঁচা চামড়া কেনার পরে বিভিন্ন ধাপে তার প্রক্রিয়াকরণ করা হয় ট্যানারিতে। তৈরি হয় চামড়ার চাদর। তার থেকে ব্যাগ-জুতো-বেল্টের মতো বিভিন্ন চর্মপণ্য তৈরি করে সংস্থাগুলি। এখন ভিন্‌ রাজ্য থেকে কাঁচামালের জোগানে টান পড়ায় বিদেশ থেকে তা আমদানিতে বাধ্য হচ্ছে তারা। কিন্তু সমস্যা হল, বিদেশ থেকে সরাসরি প্রক্রিয়া করা চামড়াই কিনতে হয়। ফলে ট্যানারির কাজ কার্যত থাকছে না। আমদানি বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ী ও শ্রমিক, দু’পক্ষই সমস্যায়। বানতলার চর্ম ব্যবসায়ী ও কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টসের সদস্য জিয়া নাফিসের অভিযোগ, এই কারণে দেশে প্রায় দু’লক্ষ কর্মী রুজি-রুটি হারানোর মুখে।

দ্বিতীয়ত, এই কারণে সমস্যায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরাও। কলকাতা লেদার ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম কর্তা ইমরান আহমেদ খান জানান, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় নগদ টাকায় টান পড়ছে। কারণ, ভিন্‌ রাজ্য থেকে কাঁচা চামড়া কেনার টাকা মেটাতে সময় পাওয়া যেত। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানির টাকা মেটানোর পরে তবে সেই কাঁচামাল হাতে আসে। ফলে বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমাচ্ছেন অনেকে।

আর এই ছবি শুধু এ রাজ্যের নয়। সারা দেশেরই। গো-হত্যা নিয়ে রাজনীতির আকচাআকচিতে সঙ্কটে ১,৫০০ ট্যানারি। অথচ চর্মশিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্তত ১০ লক্ষ মানুষের রুজি-রোজগার। রাজনীতি আর সরকারি ফরমান নিয়ে বিভ্রান্তি চর্মশিল্পকে কতখানি অসুবিধায় ফেলেছে, তা স্পষ্ট জুনেজার কথাতেই। তাঁর অভিযোগ, ‘‘গো-হত্যা অনেক জায়গায় নিষিদ্ধ। কিন্তু অন্য রাজ্য থেকে মোষ এমনকী ছাগলের চামড়া নিয়ে আসতেও বাধা দিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। মোটা অঙ্কের তোলা চাইছে। চাহিদা না-মিটলে মারধরও করা হচ্ছে।’’

এছাড়াও আলবিরুনী একাদশ শতাব্দীর লোক ছিলেন। আলবিরুনির ভারত ভ্রমণের বিবরণ হতে জানা যায়(বইয়ের নাম ভারত তত্ত্ব) হিন্দুরা আগে গোমাংস খেত। যজ্ঞে গরু বলি দেওয়া হত। কোনও কারণে গোমাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এর কারণ হিন্দুরা সঠিক ভাবে জানতো না। হিন্দুদের কাছ থেকে তিনি গোমাংস নিষিদ্ধকরণের কারণের দু রকমের মতবাদ জানতে পারেন। তবে এই মতগুলি তার গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তিনি অনুমান করেছেন অর্থনৈতিক কারণেই গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, ধর্মীয় কারণে নয়। সম্ভভত রাজা অশোকের রাজত্বে গো মাংস নিষিদ্ধকরণ শুরু হয়। অর্থাৎ  প্রধানতঃ অর্থনৈতিক কারণে গো মাংস খাওয়া শুরু হয়, আর অর্থনৈতিক কারণেই বন্ধ হয়, কোনো ধর্মীয় কারণে নয়। ওই কারণে বিবেকানন্দ বলেন যদি ব্যক্তি বিশেষ করে শুদ্ররা গো মাংস ভক্ষণ করেন অর্থনৈতিক কারণে গো মাংস ভক্ষণ করেন সেইটা কোনো অপরাধ নয় আর তাঁকে বাধা দেওয়া উচিত নয়।

সর্ব শেষ জানা যাক আদালতের রায় কি?

গো-হত্যা বন্ধ করার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট৷ তবে কোনো রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হবে না বলেও জানা গেছে৷ অর্থাৎ যে সব রাজ্যে এখনো নিষিদ্ধ নয়, সে সব রাজ্যে গবাদি পশুর মাংস বিক্রি চলবে৷

ভারতের মোট ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২২টিতেই গবাদি পশুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ৷ আইনে থাকলেও নিষেধাজ্ঞা এতকাল কার্যকর ছিল না, তবে ২০১৪ সালে বিজেপি আবার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে৷ কিছু কিছু রাজ্যে নিষেধাজ্ঞা কড়াকড়িভাবে কার্যকর করা শুরু হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়৷ ২০১৫ সালে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের দাদরি এলাকার একটি গ্রামে ৫০ বছর বয়সি এক মুসলমানকে ঘরে গরুর মাংস রাখা ও খাওয়ার অভিযোগ তুলে পিটিয়ে মারে হিন্দু মৌলবাদীরা৷

বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সারা ভারতে গরুর মাংস বিক্রি এবং খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগও নেওয়া হয়৷ এর ধারাবাহিকতায় হিমাচল প্রদেশ রাজ্যের হাইকোর্টও একবার কেন্দ্রীয় সরকারকে বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে৷

কিন্তু শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট সারা দেশে গো-হত্যা বন্ধের একটি আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে৷ রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ‘‘কোনো রাজ্য (গবাদি পশু) হত্যা নিষিদ্ধ করতে পারে, অন্য রাজ্যগুলো তা নাও করতে পারে৷ আমরা রাজ্যের আইনে হস্তক্ষেপ করবো না৷''

(প্রতিবেদনটি কাউকে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি। কয়েকটি আলোচিত বিষয়ের উপর রেখাপাত করা হয়েছে মাত্র)

(www.theoffnews.com - beef)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours