সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

পশ্চিমবঙ্গের এক প্রান্তিক রাজনৈতিক হটসিটের নাম -- নন্দীগ্রাম। এই নন্দীগ্রামই ঠিক এক দশক আগে তদানীন্তন বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যের প্রশাসনিক শীর্ষ পদ মুখ্যমন্ত্রীত্বে বসিয়েছিল। সেই নন্দীগ্রামই ঠিক দশটা বছর পর আজকের অচেনা এক ক্ষয়িষ্ণু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মিথ্যাবাদীর পরিচয়ে চিহ্নিত করে দিল। তবে নিয়তির এই রাজনৈতিক লেখ্যপটের সৌজন্যে কিন্তু স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে নিজেই নিজের উপমা হয়ে গেলেন।

বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আজ একটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন রাজ্যবাসীর মুখে মুখে ঘুরছে। লেখিকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! কে প্রকৃত মিথ্যাবাদী। বিরোধীরাতো হামেশাই বলে থাকেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মিথ্যাবাদী। রাজনৈতিক কানাগলিতে এহেন ঠেস-বচন জনমানসে গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু একেবারে প্রকাশ্যেই যদি খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বেফাঁস মন্তব্য করে যদি নিজের মিথ্যের তৈরি করা জালে স্বয়ং ফেঁসে যান তাহলে মিথ্যাচার নামক বিতর্কটা নিঃসন্দেহে অন্য উচ্চতা পাবেই।

২০০৭ সালের ১৪ মার্চ। সিপিএম জমানার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অধীনস্থ পুলিশ নন্দীগ্রামে আচমকা ঢুকে নিরীহ মানুষের ওপর যথেচ্ছ গুলি চালালে লালে লাল হয়ে উঠেছিল সেখানকার মাটি। সেই নারকীয় প্রেক্ষাপটের পর বাংলায় ঘটে গেছে রাজনৈতিক পরিবর্তনের মসৃণ পালাবদল ২০১১ সালে। নন্দীগ্রামের বারুদের গন্ধকে পুঁজি করে মুখ্যমন্ত্রী হলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। রক্ত হিম করা গুলি বর্ষণের ওই দিন থেকে ঠিক ১৪ বছর ১৪ দিন পর গত রবিবারের সন্ধ্যায় নির্বাচনী প্রকাশ্য সভামঞ্চে ভাষণ দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।এই নন্দীগ্রামের বিরুলিয়া বাজারে। রাজ্যের চলতি বিধানসভা নির্বাচনে তিনি এবার নন্দীগ্রামকে ফের ঘোড়দৌড়ের বাজি বানিয়ে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে এদিন সভামঞ্চ থেকে তিনি উত্তেজিত হয়ে হঠাৎ বলতে শুরু করেন, "একটা দুটো কথা বলে রাখি। সেদিন যে নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢুকবে মার্চ করবে গন্ডগোল হবে সেটা কি ওই গদ্দার জানতো না?  কতবার বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে তাদের কথা হয়েছিল? আমি আজ একটা জায়গায় চিফ মিনিস্টার আছি। আমিও কিছু খোঁজ খবর রাখি।" পরক্ষণেই তিনি আরও বিস্ফোরক কথা বলেন, "সেদিন বাপ ব্যাটার পারমিশন ছাড়া নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢুকতে পারতো না। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি।" উল্লেখ্য, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইঙ্গিত অনুসারে এখানে বাপ ব্যাটা যথাক্রমে হলেন নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী ও তাঁর পিতা শিশির অধিকারী। তৃণমূল সুপ্রিমোর এহেন মন্তব্যের পরপরই শুভেন্দু অধিকারী কড়া প্রতিক্রিয়া দিতে বেশি সময় ব্যয় করেনি। তাঁর সাফ বক্তব্য, "উনি নিজে লিখেছেন না অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়েছেন জানি না, ওঁর নন্দী মা বইটি পড়ুন। তা হলেই বুঝতে পারবেন ওঁর দ্বিচারিতা। পুরোটাই তো মিথ্যা। পুরোটাই ৪২০। ফেরেব্বাজ মুখ্যমন্ত্রী।"

হ্যাঁ এই মূহুর্তে সমগ্র বাংলায় রাজনৈতিক সচেতন বইপ্রেমীদের কাছে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বইটির নাম নন্দী মা। লেখক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে বিতর্কিত মন্তব্য করে ভোটের বাজার এক লহমায় গরম করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, সেই বিতর্কের সত্যতা জানতে এখন রাজ্যবাসী নন্দী মা'র পাতা ওল্টাবেনই, এতে আর সন্দেহের কি আছে। কি রয়েছে বইটিতে? বইয়ের ১৯ পাতায় লেখিকা লিখেছেন, "১০ মার্চের সিদ্ধান্তের বিষয় জেলার সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের জানানো হয়। এই সংবাদ পৌঁছে যায় ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম বিধায়ক সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারী, তৃণমূলের জেলা সুপ্রিমো শিশির অধিকারীর কাছে।" একই বইয়ের ২২ পাতায় উল্লেখ রয়েছে, "১৪ মার্চ যে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে তার সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল অনেকেরই। এমনকী ঘটনা ঘটার আগের দিনও শুভেন্দু অধিকারী কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য সতর্ক করেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে।" 

নন্দী মা বইটির লেখিকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখ্য বক্তব্য আর রবিবারের নির্বাচনী সভামঞ্চে ভাষণরত তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য যে পুরুষ ও নারীর প্রকৃতিগত যৌনাঙ্গ ফারাকের মতো আড়াআড়ি প্রভেদ স্পষ্ট। লেখিকা শুভেন্দু অধিকারীর সম্পর্কে একদা লিখেছেন 'সেনাপতি'। আর নেত্রী এখন সভামঞ্চে তাঁকেই বলছেন একই ইস্যুতে 'গদ্দার', 'তাদের অনুমতি ছাড়া পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারত না।' এখানেই না থেমে নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী জনসভায় হেঁয়ালি মার্কা প্রশ্ন তুলে দিলেন, 'কতবার বুদ্ধদেববাবুর তাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল?' অথচ অদ্ভুত কথা হল এই হেঁয়ালির কি দরকার পড়লো নেত্রীর এখনই, অন্তত এই ভোটের আবহে। কারণ লেখিকা তো নিজেই লিপিবদ্ধ করেছেন সেই উত্তর। তিনি নিজের লেখা বইয়ের তথ্য অনুযায়ী জানতেন তো, 'শুভেন্দু অধিকারী আগের দিন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ফোন করেছিলেন যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।"

এতো সরাসরি মিথ্যাচার। কে সত্যটা বলছেন? আর মিথ্যেটাইবা কে বলছেন? লেখক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিখিত বিবরণে সত্য নিহিত রয়েছে নাকি নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে মিথ্যে লুকিয়ে আছে?

বিরোধীরাতো সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আঙ্গুল তুলেছেন। তাঁরা এটাও বলেছেন, শুভেন্দু অধিকারী যদি সেদিন নন্দীগ্রাম ইস্যুতে প্রকৃতই গদ্দারী করে থাকেন তবে মমতার বন্দ্যোপাধ্যায় তা জেনে বুঝেও বাংলার মানুষকে এতদিন ধোঁকা দিয়ে নিজের মন্ত্রীসভার ক্যাবিনেটে তাঁকে স্থান দিয়েছিলেন কোন স্বার্থ রক্ষার্থে। এটাতো নন্দীগ্রামের মানুষের বিশ্বাসের পিঠে চাকু চালাবার মতো কাজ করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলে বিরোধী নেতাদের অভিযোগ। একযোগে সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপি নেতৃত্ব দাবি করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর কোন বক্তব্যটি সঠিক তা এখনই জানাতে হবে ও মিথ্যাচারের জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে হবে। লেখিকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রচিত নন্দী মা বইতে ধাপ্পাবাজির আশ্রয় নিয়ে মিথ্যে বর্ণনা দিয়েছেন নাকি নির্বাচনী সভায় রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা দেখিয়ে অসত্য ভাষণ দিয়েছেন স্রেফ ভোট কুড়াবার লক্ষ্যে --কোনটা ঠিক? কোনটা অসত্য? কোনও একটা মিথ্যে নাকি দুটো বক্তব্যই মিথ্যে! রাজ্য জুড়ে বিধানসভা ভোট প্রচার যখন তুঙ্গমুখী ঠিক তখনই ভোটার-জনগণের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর এহেন নিজের কোনও একটা মিথ্যাচার সামনে নিয়ে আসার কিসের প্রয়োজনীয়তা হয়ে পড়ল আচমকা? আপনাকে এর আগে পরপর দু'বার জনগন ভোট দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী আসনে বসার জন্য। তাঁদের কিন্তু সত্যটা জানার অধিকার তাই সঙ্গত। মুখে কুলুপ এঁটে লাভ নেই এই প্রসঙ্গে। অন্যথায় আপনার সম্পর্কে শুভেন্দু অধিকারীর সাম্প্রতিক উক্তিটা বড্ড বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে না যায়! যেটা সাংবিধানিক পর্যায়ে আপনার পক্ষে খুবই অবমাননাকর হবে, তাই না?

(www.theoffnews.com - Nandigram Mamata Banerjee Suvendu Adhikari controversy)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours